এমপি মোসলেমের ইচ্ছায় স্কুলের শ্রেণীকক্ষ ভেঙে মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া


জিন্নাত আয়ুব, বোয়ালখালী (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গেইটের সামনে কোন ধরনের দোকান না রাখার জন্য সরকারি নির্দেশনা রয়েছে; অথচ চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচটি শ্রেণীকক্ষ ভেঙে তিনতলা মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এতে ওই বিদ্যালয়ের আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে ক্লাস করতে হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে গাদাগাদি করে বসে।

বুধবার (১০ আগস্ট) সরেজমিন দেখা গেছে, গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের গেইটের দুইপাশে বাণিজ্যিকভাবে বহুতল ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। স্কুল গেইটের পশ্চিম পাশে বিদ্যালয় সীমানা প্রাচীরের ভেতরে স্কুলের একটি ভবনকে করা হয়েছে দোকানঘর এবং এই ভবনের উপরে আরও দুইটি তলা তৈরি করে ব্যাংক ও বীমা অফিসকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। পূর্ব পাশে আরেকটি ৫ তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে।

গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষের সংকট রয়েছে। বিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ না করে তৈরি করা হচ্ছে বাণিজ্যিক ভবন। অথচ আমরা একটা শ্রেণিকক্ষে ১০০ থেকে ১২০ জন শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে বসে ক্লাস করছি। তাছাড়া বাণিজ্যিক ভবনগুলো সড়কের সঙ্গে এমনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে ফুটপাতে জন্যও একটু জায়গা রাখেনি। যার কারণে বিদ্যালয় ছুটি হলে আমাদের সরাসরি সড়কে উঠতে হয়। এতে দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা অনেক বেশি। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী বুঝে এসব করছে আমরা জানি না।’

বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে প্রধান শিক্ষককে পাওয়া গেল না। অফিস কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা হয় অফিস সহকারি সৈয়দ ফখরুদ্দিন আহমেদের সাথে। শ্রেণীকক্ষ ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি কি জানেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি কে? এমপি মোসলেম উদ্দীন আহমেদ। তারপরেও আসছেন যখন এমপির সাথে ফোন করে কথা বলুন। হেডস্যার আজকে আসবে না।’

এরপর বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক বিপ্লব সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সামনে যে বাণিজ্যিক ভবনটা গড়ে তোলা হয়েছে এটা সরকারিভাবে করা একতলা বিশিষ্ট ভবন ছিল। এখানে পাঁচটি শ্রেণীকক্ষ ছিল। এখন এই ভবনের নিচে দোকান করা হয়েছে। উপরে আরও দ্বিতল করে ব্যাংক-বীমা অফিসকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।’ এতে শিক্ষার্থীদের অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি এসব প্রশ্ন আমাকে না করে স্কুল কমিটিকে করুন। আমি মিডিয়ায় কথা বলছি জানলে আমার চাকরি থাকবে না।’

একই বিষয়ে স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক প্রলয় চৌধুরী মুক্তি বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাইরে আরও ১৮ জন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ বহন করার জন্য এই বাণিজ্যিক ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া এই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন যাবত এমপি মহোদয় (মোসলেম উদ্দিন) সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। এসব তো ওনার পরামর্শে করা হয়েছে।’

বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করে দোকান ভাড়া দিয়ে অনিয়ম করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে প্রলয় চৌধুরী মুক্তি বলেন, ‘এসব নিয়ে অনেক ডিপার্টমেন্ট থেকে লোকজন এসেছিল। এসব এমপি মহোদয় ম্যানেজ করে নেন। আপনি এমপির নাম্বার নেন, সরাসরি ওনার সঙ্গে কথা বলুন।’

বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক বিষু বড়ুয়া বলেন, ‘এই বিদ্যালয়ের সভাপতি যত দিন মোসলেম উদ্দীন থাকবেন, ততদিন কেউ এসব অনিয়ম নিয়ে মুখ খুলবে না। এসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলে বেইজ্জত হবে কে? বর্তমান প্রধান শিক্ষক এমপির দোহাই দিয়ে বিদ্যালয়টিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আর অল্প কয়দিন আছি। মানসম্মান নিয়ে যেতে চাই।’

জানতে চাইলে গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবুল মোহছেন বলেন, ‘আমি থাকাকালীন এসব দুর্নীতি ও বাণিজ্য করতে পারেনি। এখন বর্তমান প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোসলেম উদ্দীন আহমেদ মিলে বিদ্যালয়টিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছে। এখন যে ভবনটি তিনতলা করে দোকান, ব্যাংক ও বীমা অফিস ভাড়া দিয়েছে, সেটা ছিল একতলা ভবন। সেখানে পাঁচটি শ্রেণীকক্ষ ছিল। ওই ভবনটা সরকারিভাবে করা হয়েছিল।’

বিদ্যালয়ের সামনে বাংলাদেশ স্পোর্টস এন্ড জেন্ডস কালেকশন নামের একটি দোকানের মালিক মো. ওসমান বলেন, ‘স্কুলটাকে এখন দেখলে একটা মার্কেট মনে হয়। আগে এই ভবনের পাশে সারি সারি গাছ ছিল। ভবনে ক্লাসরুম ছিল। বিদ্যালয়টি তখন এক প্রকার শোভাবর্ধন করতো। তাছাড়া রাস্তার পাশে কোনও প্রকার ফুটপাত না রেখে একেবারে রাস্তার সাথেই এই ভবন হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের ছুটি হলে সবাই রাস্তার উপর চলে আসে। আসলে এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।’

গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে অপর পাশে সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজ। কথা হয় ওই কলেজের শিক্ষার্থী অর্পিতা চৌধুরীর সাথে। অর্পিতা বলেন, ‘এরকম স্কুলসীমার ভেতর এরকম মার্কেট বেমানান। তাছাড়া স্কুলের শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে বসে ক্লাস করতে হয়। এসব বাণিজ্যিক ভবন না করে স্কুলের শ্রেণীকক্ষ বাড়ানো প্রয়োজন। এতে স্কুলের পরিবেশটা সুন্দর হতো।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মঈনুল আবেদিন নাজিম মুঠোফোনে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে অর্থ দিয়ে আয়বর্ধনের জন্য এটা করা হয়েছে। এসব এমপি মহোদয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে করা হয়েছে। আমার একক কোনও সিদ্ধান্ত নয়। ২০১৪ সাল থেকে এমপি মহোদয় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি।’ এ কথা বলেই অসুস্থ জানিয়ে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার চেষ্টা করেও সংযোগ স্থাপন করা যায়নি।

স্কুলের শ্রেণীকক্ষ ভেঙে মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বোয়ালখালী পৌর মেয়র জহুরুল ইসলাম জহুর বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমার কোনও মাথাব্যাথা নেই। আপনি এমপি সাহেব ও ইউএনও সাহেবের সাথে কথা বলুন।’

জানতে চাইলে বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। স্থানীয় এমপি মহোদয় ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি। আপনি এমপির সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’

তবে বোয়ালখালীর এমপি মোসলেম উদ্দিন আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

চট্টগ্রাম শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারি প্রকৌশলী মধু চাকমা বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছি। কিন্তু কীভাবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিক ভবন করেছে বুঝতে পারছি না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তরকে জানায়নি। তাছাড়া আমরা বিদ্যালয়ের কোনও ভবন করলেও তা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর আর কোনও দায়িত্ব থাকে না। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলে এডিসি ও ইউএনও ব্যবস্থা নেবেন। এ বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।’