সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

শূন্য থেকে কোটিপতি ছাত্রলীগ নেতা শওকতের পেছনের গল্প কী

প্রকাশিতঃ ৮ অগাস্ট ২০২২ | ১১:০২ পূর্বাহ্ন


জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার : মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন কক্সবাজার ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এইচ এম শওকত; তিনি পেকুয়া উপজেলার বারকিয়া ইউনিয়নের দিনমজুর মৃত নন্না মিয়ার ছেলে।

অথচ স্থানীয়দের তথ্যমতে, বছর তিনেক আগেও মাত্র ১০-২০ টাকা রিকশাভাড়া দিতে পারেননি শওকত। এখন তার সংগ্রহে রয়েছে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি ও একাধিক দামি বাইক। কিনেছেন কোটি টাকার জমি। শূন্য ভিটায় গড়েছেন কোটি টাকার অট্টালিকা, বিলাসবহুল অফিস। সম্প্রতি ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পেকুয়া বাজারে জুবাইদা কনস্ট্রাকশন নামে (মায়ের নামে) একটি রড সিমেন্টের বিশাল দোকান খুলেছেন। গত বছর প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা দিয়ে পেকুয়া বাজার ইজারা নিয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, কক্সবাজারের একজন এমপির ছত্রছায়ায় ইয়াবা কারবার, চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিকে পরিণত হয়েছেন শওকত। এ নিয়ে ছাত্রলীগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতা শওকতের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন দাবি করে পেকুয়া বাজারের ১২০ জন ব্যবসায়ী পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। শওকতের বেতনভুক্ত কিশোর গ্যাংয়ের ইভটিজিংয়ের কারণে স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ুয়া অনেক ছাত্রী এখন ঘরবন্দি বলেও অভিযোগ আছে।

পেকুয়ার স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেছেন, শওকত জীবিকার তাগিদে একসময় মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। ২০১৫ সালের দেশে ফিরে আসেন। এসেই জড়িয়ে পড়েন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররাজনীতিতে। এরপর ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে শুরু করেন চাঁদাবাজি। ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর পেকুয়া থানার একজন পুলিশ অফিসারের মাথা ফাটিয়ে আটক হন শওকত। পরে একই দিন পুলিশের ওপরে হামলা ও সরকারি কাজে বাধা প্রদানের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। তার পরিবার আর্থিকভাবে এতটাই দুর্বল ছিল যে স্থানীয়রা চাঁদা তুলে শওকতের জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন।

জানা যায়, অতীতে ছাত্রলীগের কোন পদ-পদবীতে না থাকলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একজন সাবেক শীর্ষ নেতার তদবিরে ২০২০ সালের ২২ নভেম্বরে গঠিত কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পেয়ে যান শওকত। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যে শওকতের উত্থান রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে।

উপরোক্ত সম্পদ ও বিনিয়োগের পাশাপাশি চলতি বছর পেকুয়া বাজারের পূর্বে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এস এম গিয়াস উদ্দিনের বাড়ির পাশে ২ কোটি টাকা মূল্যের একটি জমি কিনেছেন বলে স্থানীয়রা তথ্য দিয়েছেন। এছাড়া পেকুয়া বাজারের এসডি ডেভেলপারের পিছনে দুই কানি জমি কিনেছেন শওকত, যার মূল্য তিন থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এর আগে স্থানীয় লায়ন মুজিবসহ একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে শওকত কয়েক কোটি টাকার মূল্যের জমি কিনেছেন বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের।

সম্প্রতি খতিয়ানভুক্ত জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগে শওকতের বিরুদ্ধে পেকুয়ায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন আজম, আবু সিদ্দিক, মনছর আলমসহ আরও কয়েকজন। তারা সবাই শওকতকে ইয়াবা কারবারি বলে দাবি করেছেন। এছাড়া পেকুয়া বাজারের ১২০ জন ব্যবসায়ী শওকতের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ইউএনও বরাবর অভিযোগ করেছেন।

বিষয়টি স্বীকার করে পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা বলেন, ‘আমি যোগদান করার পর থেকে শওকতের বিরুদ্ধে অনেকেই আমাকে অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি পেকুয়া বাজারের শতাধিক ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ আমাকে দিয়েছেন। আমি অভিযোগটা তদন্তের জন্য পেকুয়া থানার ওসিকে দিয়েছি।’

দুদক সূত্রে জানা গেছে, শওকতের বিরুদ্ধে মাদকের কারবার, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, নারী পাচারের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ তাদের কাছে জমা পড়েছে। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

শওকতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে পেকুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওসমান সরওয়ার বাপ্পি বলেন, ‘শওকত আমার বাল্য বন্ধু। সে চট্টগ্রামের মহসীন কলেজ শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু টাকার অভাবে সে এইচএসসি পাস করতে পারেনি। পরে ধার দেনা করে জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়া পাড়ি জমায়। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে ২০১৫ সালে দেশে ফিরে আসে। এবং একজন প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করে। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার পর মাত্র বছর দেড়কের ব্যবধানে শওকত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ ধরা পড়েছে শওকতের অনুসারী পেকুয়ার মগনামার সোনালী বাজার এলাকার রমিজের ছেলে দুলাল ও বারবাকিয়া ইউনিয়নের শাহাবুদ্দিনের ছেলে শাহাদাতুল কবির। শওকতের অনুসারী হিসেবে পরিচিত আরও অনেকেই ইয়াবা ও অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন।’

শওকতের ব্যবসায়িক পার্টনার বাঁশখালী উপজেলার সাবেক ছাত্রলীগের সভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. ইমরান বলেন, ‘পেকুয়ায় নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটিতে জিওব্যাগের কাজসহ নির্মাণসামগ্রীর সাপ্লাইয়ের কাজ করতাম। সেখানে সময় দিতে না পারার কারণে ছাত্রলীগের কর্মী বিবেচনায় ২০১৯ সালে শওকতকে পার্টনার হিসেবে নিই। তখন আমি তাকে সাড়ে ২৬ লক্ষ টাকা দিলেও সে ১ টাকাও দিতে পারেনি। পরে দেখলাম আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সে প্রতারণার মাধ্যমে ওয়ার্ক অর্ডার তার নামে করে নেয়। এরপর থেকে আমাকে একটা টাকাও দিচ্ছে না। এখন আমি নিঃস্ব আমার আর কিছুই নেই।’

ইমরান বলেন, ইয়াবা কারবার ছাড়া শওকতের এত টাকা আয়ের কোনও সুযোগ নেই। শওকতের কয়েকজন অনুসারী ইতিমধ্যে ইয়াবা নিয়ে আটক হয়েছেন, এসব ইয়াবার চালান শওকতের বলে শুনেছি। শওকত চট্রগ্রামের দিদারের কাছ থেকে ৫৫ লক্ষ টাকা, পেকুয়ার এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এক কোটি ৮০ লক্ষ টাকা, কাউসার নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা মেরে খেয়েছে। তারা কেউ তেল, কেউ এস্কেভেটর, কেউ ইট-কংকর সাপ্লাই করেছেন।’

চট্রগ্রামের বাসিন্দা মোরশেদ নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘শওকতের কাছ থেকে ডাম্পার ও এস্কেভেটর ভাড়া বাবদ আমি ২১ লক্ষ টাকা পাই। তার জন্য পেকুয়া থানায় জিডি করেছি। কিন্তু সে জিডি নেওয়ার কারণে উল্টো পুলিশকে হুমকি দিয়েছে। জেনেছি সে একজন এমপির শেল্টারে আছে, তাই বেপোরোয়া। আমি আমার টাকা ফেরত পেতে চাই। আমার কাছে সব ডকুমেন্ট রয়েছে।’

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে পেকুয়া থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ইয়াবা নিয়ে আটক অন্তত দুইজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শওকতের নাম বলেছেন। কিন্তু একজন এমপির হস্তক্ষেপের কারণে তাকে আসামি করা যায়নি। এ ছাড়াও ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে অযৌক্তিকভাবে শওকতের পক্ষে বিভিন্ন সময় জায়গা দখল করতে ওই এমপি পুলিশকে চাপ প্রয়োগ করেন।’

তেল সরবরাহ করে ২৭ লক্ষ টাকা শওকতের কাছ থেকে আদায় করতে না পেরে হার্ট অ্যাটাক করে পেকুয়া বাজারে আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে ব্যবসায়ীরা।

এ ছাড়াও প্রতিবেদককে বক্তব্য দেওয়ার পর শওকতের হুমকি ধমকির কারণে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন আরও কয়েকজন।

এ বিষয়ে পেকুয়া থানার ওসি ফারহাদ আলি বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। তাই এত কিছু জানি না। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসব অভিযোগ উল্লেখ করে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা শওকত বলেন, ‘আমি কোন মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত নই। আমি একজন জনপ্রিয় নেতা। সবার সঙ্গে আমার ছবি থাকতে পারে।’ জন্ম থেকে কোটিপতি উল্লেখ করে শওকত তার কাছে কোটি কোটি টাকা পাওনা দাবি করা সবাইকে মিথ্যাবাদী ও প্রতারক বলে দাবি করেন।

কোনও জবর-দখলের সঙ্গেও তিনি জড়িত নন দাবি করে এসব বিষয়ে নিউজ করে তাকে কিছু করা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন শওকত। পরে দু’জন সাংবাদিককে দিয়ে প্রতিবেদকে ম্যানেজ করা চেষ্টা করেন তিনি। ব্যর্থ হয়ে ছাত্রলীগের সাবেক একজন শীর্ষ নেতাকে দিয়ে ফোন করিয়ে নিউজ না করার অনুরোধ জানান।

ছাত্রলীগ নেতা শওকতের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় এমপি জাফর আলম বলেন, ‘আজম নামের পেকুয়ার একজন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি কাউকে শওকতের পক্ষে দখলবাজি করতে বলিনি। বরং পেকুয়ার ওসি ও ইউএনও আমাকে একাধিকবার বিচার দিয়েছেন তার একটি জমির বিষয়ে। যেটি সন্ত্রাসী আজম দখল করতে চায়। এ জন্য দুইজন এসিল্যান্ড ও একজন ইউএনও বদলি করা হয়েছে।’ ছাত্রলীগ নেতা শওকতের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে সরাসরি তাকে জানানোর জন্য ভুক্তভোগীদের অনুরোধ করেছেন এমপি জাফর আলম।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হাসানুজ্জমান বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতা শওকতের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে আমি আগে জানতাম না। এখন খোঁজখবর নেব।’