জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ ফরিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থামছেই না। এতদিন অবৈধভাবে জমিদখল, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে সমঝোতার নামে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এবার সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শেখ ফরিদের বিরুদ্ধে।
চেয়ারম্যানের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে সরফভাটায় সন্ত্রাসীবাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। ওই এলাকার অনেক পরিবারের কাছ থেকে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো মোটা অংকের চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ আছে। চেয়ারম্যান ফরিদের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। উল্টো অভিযোগকারীদের তথ্য সন্ত্রাসীদের দিয়ে তাদের মাধ্যমে নানাভাবে হয়রানি ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অবস্থা এতোটাই বেগতিক যে, চাঁদা দিতে না পেরে প্রাণভয়ে সরফভাটা ইউনিয়নের ২ শতাধিক পরিবার এখন এলাকা ছেড়েছেন। এসব পরিবার উপজেলার পোমরা, ইছাখালী ও বিভিন্ন এলাকায় বাসাভাড়া করে থাকছেন। বেশিরভাগ ভুক্তভোগী নিরবে এ ধরনের নির্যাতন সহ্য করলেও অনেকেই অতিষ্ঠ হয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
ভুক্তভোগীদের দেওয়া সন্ত্রাসীদের হুমকির বেশকিছু তথ্য-প্রমাণ ও অডিও রেকর্ড একুশে পত্রিকার হাতে এসেছে। শুধু তাই নয়, শেখ ফরিদের সাথে সন্ত্রাসীদের কথোপকথনের কল লিস্টও একুশে পত্রিকার কাছে সংরক্ষিত আছে। এসব নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় কামাল ওরফে গলাকাটা কামাল ও তার ভাই তোফায়েল। এছাড়া তাদের সাথে সরাসরি যুক্ত আছেন মদন কামাল। তাদের পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন মো. ফয়সাল, মো. কায়কোবাদ, হারুন, মো. আরিফ, মো. মফিজ, গুলু, মো. হাসেম।
সন্ত্রাসী কামালের ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার মিন্টুর সাথে কথা হয় একুশে পত্রিকার। রোববার (৭ জুলাই) একুশে পত্রিকা কার্যালয়ে এসে তার অসহায়ত্ব ও নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন মিন্টু; বলেন, ‘একসময় চেয়ারম্যান শেখ ফরিদের সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে তার সাথে আমার আর্থিক লেনদেনও হয়। ফরিদের কাছে আমি দেড় লাখ টাকা পাই। এই টাকা চাওয়ার পর থেকেই আমি তার চক্ষুশূল হয়ে যাই। এরপর তিনি আমাকে মামলা-হামলার হুমকিও দেন।’
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বেশ কয়েকটি পরিবারের কাছে সন্ত্রাসীবাহিনী চাঁদা দাবি করলে আমি প্রতিবাদ করি এবং চেয়ারম্যান শেখ ফরিদের কাছে এ বিষয়ে বিচার দিতে বলি। ভুক্তভোগী পরিবার শেখ ফরিদের কাছে বিচার নিয়ে গেলে ফরিদ তাদের কাছে জানতে চান কে তাদের পাঠিয়েছে। তারা সরল মনে আমার কথা জানায়। এরপরই গত ২৮ জানুয়ারি আমাকে এলাকা থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে ফিল্মি স্টাইলে তুলে নিয়ে যায় সন্ত্রাসী কামাল।
‘নির্জন একটি জায়গায় আমাকে নিয়ে কামাল ও তার লোকজন লোহার রড দিয়ে আমাকে বেধড়ক মারধর করে। এরপর আমাকে তাদের চাঁদার বিষয়ে চুপ থাকতে বলে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমাকে জানে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। এমন সময় কামালের নাম্বারে একটি ফোন আসে, ফোনটি লাউডস্পিকারে থাকায় আমি তাদের কথোপকথন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম।’
‘ফোনের অপর প্রান্তের মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে আমি থমকে যাই। আমি বুঝতে পারি শেখ ফরিদের সাথেই কামাল কথা বলছে। এসময় শেখ ফরিদ কামালের কাছে আমাকে কী করেছে জানতে চায়। কামাল বলে তাকে বেশ মেরেছি, এখন ছেড়ে দিবো। পালটা জবাবে শেখ ফরিদ বলে, সে তোমাদের সবাইকে চিনে ফেলেছে। আমাদের ব্যাপারেও জেনে গেছে। এখন তাকে বাঁচিয়ে রাখা বিপদজনক। তাকে শেষ করে দাও- বলেই ফোন কেটে দেয়।’
‘এরপর তারা আমাকে পুনরায় মারধর করতে থাকে। এসময় কামাল তার বাহিনীর এক সদস্যকে বলে একটা বড় ছুরি আনতে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখা বিপদজনক, তাই আমাকে জবাই করে দিতে হবে। সেই সদস্য ছোরা আনতে যায়। এমন সময় কামালের নাম্বারে আরেকটি ফোন আসে। এসময় এক ব্যক্তি তাকে বলে- ওইদিকে পুলিশ আসছে তোমরা তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও। পরবর্তীতে তারা আমাকে রেখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।’
‘এ ঘটনার পর আমি প্রায় ২ মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। পরবর্তীতে আমি কিছুটা সুস্থ হলে আমার পরিবার এ বিষয়ে আদালতে একটি মামলা করে। থানায় মামলা করে কোনো সুরাহা পাবো না জানি, তাই থানায় যাইনি। আমি ও আমার পরিবার এখন ভয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমি জানি তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার পর আমাকে আরও নির্যাতন সহ্য করতে হবে। আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, আজকের পর যদি আমার কোনও ক্ষতি হয় এর জন্য দায়ী থাকবেন চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মীরেরখীল এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘সরফভাটার মানুষ রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারে না। সন্ত্রাসীরা কখন কীভাবে কার ঘরে ঢুকে পড়ে সেই ভয়ে থাকে সবাই। মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা তারা চাঁদা নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের চেয়ারম্যান এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না। চেয়ারম্যানের কাছেও কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। কারণ তাকে কিছু বললেই সেই তথ্য সন্ত্রাসীদের কাছে চলে যায়। তাই প্রাণভয়ে সবাই চুপ করে আছে।’
আরেকজন বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মানুষের কষ্ট দেখে স্থানীয় এক ইউপি সদস্য ফেসবুকে এক ভিডিওবার্তায় এর প্রতিবাদ করেছেন। অথচ চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতারা একদম চুপচাপ। তারাও কোনও পদক্ষেপ নেন না, দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। কিন্তু তারা সবাই এ বিষয়ে জানেন। আমার তো মনে হয় চেয়ারম্যান এবং নেতাকর্মীরাও এর সাথে যুক্ত। প্রশাসনের উচিত বিষয়টি তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা।’
এদিকে সন্ত্রাসী বাহিনীর তাণ্ডবের কথা উল্লেখ করে ঈদুল ফিতরের দ্বিতীয় দিন গত ৫ মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভিডিওবার্তা দেন ১নং মীরেরখীল ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. দিলদার হোসেন। স্থানীয় সাংসদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এলাকার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করেন তিনি।
ভিভিওবার্তায় তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে কল করে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রতিনিয়ত চাঁদা দাবি করে যাচ্ছে। স্থানীয় নেতা ও এলাকাবাসী এতে নির্বিকার। এগুলোর বিরুদ্ধে কেউ কোনও ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কেন হচ্ছে না সেটাও জানি না। এখানে একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গুটিকয়েক সন্ত্রাসী শান্ত মীরেরখীল এলাকাকে অশান্ত করে তুলেছে।’
এলাকাবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে দিলদার হোসেন বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কেউ চাঁদা দাবি করলে আপনারা চাঁদা দিবেন না, আপনারা আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। চেষ্টা করব এগুলো প্রতিরোধ করার জন্য। একজনের দেখা-দেখিতে আরেকজন চাঁদা দিয়ে দিচ্ছে, এভাবে আমরা গণহারে ওই চাঁদা দেয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছি। কেউ চাঁদা দাবি করলে আমাকে ফোন দিবেন, পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন দিবেন। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের নিজেদেরকে দাঁড়াতে হবে। সন্ত্রাসীদের হাত যত লম্বা হোক না কেন, এলাকাবাসীর সাথে কখনো পেরে উঠবে না। আপনারা সাহস জোগান।’
এসময় সরফভাটার আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের এগিয়ে এসে মীরেরখীলবাসীকে রক্ষা করার আহ্বান জানান দিলদার হোসেন। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে সহযোগিতার অনুরোধ জানান তিনি।
একুশে পত্রিকাকে ইউপি সদস্য দিলদার হোসেন বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ করার পর থেকে আমাকে কামালবাহিনী নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছে। প্রাণভয়ে আমাকে পর্যন্ত এলাকা থেকে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা ও এমনকি চেয়ারম্যান শেখ ফরিদও আমার ডাকে সাড়া দেননি, সহযোগিতা করেননি। উল্টো চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে পরামর্শ দিলেন নিরাপদে থাকতে। প্রয়োজনে এলাকার বাইরে থাকার পরামর্শ দেন আমাকে। অথচ তাদের উচিত ছিল আমার পাশে থাকা।’
তিনি বলেন, ‘এতো হুমকি, স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের অসহযোগিতার পরও আমি থামিনি। ভিডিওবার্তা দেওয়ার পর আমি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করি। সন্ত্রাসীবাহিনীর সাথে আমাদের এলাকার বেশ কয়েকজন নেতার কথোপকথনের তথ্য আমি জানতে পারি। বেশ কয়েকজন রাঘববোয়ালের সাথে সন্ত্রাসীদের যোগাযোগের প্রমাণ আমি পেয়েছি। সঙ্গতকারণে আমি নামগুলো প্রকাশ করছি না। তবে এগুলো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।’
জানা যায়, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ও ভুক্তভোগীদের প্রতিকার চেয়ে তথ্যমন্ত্রীর সাথে সম্প্রতি দেখা করতে যান ইউপি সদস্য দিলদার হোসেন। এসময় চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ ওই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। এসময় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান ফরিদের নিশ্চুপ ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দিলদার। এসময় চেয়ারম্যান ফরিদ তাকে বলেন- ‘এখন যদি আমি এ বিষয়ে কথা বলি তাহলে আমি প্রশাসনের কাছে কালার হয়ে যাবো। সন্ত্রাসীরাও আমার বিরুদ্ধে চলে যাবে।’
জানতে চাইলে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সরফভাটা এলাকায় সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি ও হামলা চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি সেই গ্রুপের এক সদস্য কামাল ওরফে মদন কামালকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে সে আমাদের কাছে ওই সন্ত্রাসী তার দলের ১৪ জনের নাম জানিয়েছে। আমাদের তদন্ত চলমান আছে।’
তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা তাদের ট্রেস করতে পারছি না। তারা পাহাড়ে এমন জায়গায় থাকে যেখানে তাদের চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। আর দুর্গম ওই এলাকার নাড়ি-নক্ষত্র তাদের জানা। তাই তারা খুব সহজেই পালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ৩ জন অপহৃত ব্যক্তিকে আমরা ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর একটি ডেরা থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। যদিও আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে কামালবাহিনী আগেভাগেই পালিয়ে যায়।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব সন্ত্রাসী বাহিনীকে নিশ্চয়ই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা আশ্রয় দিচ্ছেন। তা না-হলে তারা এভাবে তৎপরতা চালাতে পারতো না। যদিও কে বা কারা এই কাজ করছে তা আমরা জানতে পারিনি। চেয়ারম্যান শেখ ফরিদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আমরা নিশ্চয়ই তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরফভাটা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সরফভাটা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরফভাটায় আমিই সর্বপ্রথম সাহস করে মুখ খুলেছি। থানার সাথে যোগাযোগ করে এলাকাবাসীকে যাবতীয় সহযোগিতা করছি। সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’