লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ‘স্ক্যাবিস’-এ আক্রান্ত


জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার : কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ছোঁয়াচে চর্মরোগের প্রার্দুভাব বাড়ছে। ইতিমধ্যে ক্যাম্পের নারী ও শিশুসহ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা স্ক্যাবিস নামক এক ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে। অল্প জায়গায় ধারণ ক্ষমতার বেশি লোক বসবাসের কারণে একজনের কাছ থেকে অন্যজনের মাঝে দ্রুত ছড়াচ্ছে এ রোগ।

স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এটি প্রশমনে এগিয়ে এলেও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। এটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে স্ক্যাবিস সংক্রমণের একটি মূল্যায়নের জন্য ক্যাম্পে কাজ করা স্বাস্থ্য অংশীদারদের নিয়ে এপ্রিলে জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। প্রাথমিক জরিপে প্রাদুর্ভাবের হার গড়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ এক লাখ রোহিঙ্গা স্ক্যাবিস আক্রান্ত বলে দাবি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাস। আশ্রয় শিবিরের ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারকে। ক্যাম্পগুলোতে, ঘেঁষাঘেঁষি বসবাসের ফলে এ রোগ দ্রুত ছড়াচ্ছে। ঝুঁকি কমানো যাচ্ছে না।

এদিকে ক্যাম্পে একেকটি টয়লেট ব্যবহার করেন ২০ থেকে ২৫ জন লোক। যেখানে একই সাবান বা অন্য ব্যবহার্য একে-অপরে ব্যবহার করেন। একটি টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন ৩০০ থেকে ৪০০ জন। এতে জটলা ও লাইন পড়ে যায়। ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে এ রোগ নিয়ন্ত্রণহীন বলে দাবি স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের।

ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবা দেয়া বেসরকারি সংস্থা মেডিসিন সেন্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) কমিউনিকেশনের মেডিকেল অ্যাক্টিভিটি ম্যানেজার ডা. কামাল উদ্দিন জানান, স্ক্যাবিস রোগ- স্থানীয়ভাবে খোসপাঁচড়া বলে পরিচিত। এই রোগের প্রধান উপসর্গ চুলকানি। চুলকানির কারণে ক্ষত হতে পারে এবং দ্রুত চিকিৎসা না পেলে কিডনি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত বিছানা ভাগাভাগি ও একই কাপড় বা ব্যবহার্য পণ্য একাধিকজন ব্যবহার করলে এবং আক্রান্ত কেউ থাকলে এই রোগ দ্রুত ছড়ায়। তাই দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।

তিনি আরও জানান, স্ক্যাবিস ত্বকে বাসা বাঁধা এক ধরণের জীবাণুর কারণে হয়ে থাকে। আবর্জনা হতে এ জীবাণু ত্বকে বাসা বাঁধে এবং ডিম পেড়ে বংশ বৃদ্ধি করে আর চুলকানি ছড়ায়।

১৪ নং হাকিমপাড়া ক্যাম্পে এমএসএফের একটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ রোগীই স্ক্যাবিসে আক্রান্ত। এমএসএফ হাসপাতালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র গত ১৪ মার্চ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত ১৪ এবং ১৫ ক্যাম্পে এমএসএফ হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছে ৩৬ হাজার স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোহিঙ্গা। এছাড়াও অন্যান্য ক্যাম্পের হেলথ সেন্টারগুলোতেও কয়েক হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে এমএসএফ। এরমধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা বেশি।

এমএসএফ কমিউনিকেশন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্ক্যাবিসে আক্রান্তের সংখ্যা গত তিন বছরের মাঝে এবছর সবচেয়ে বেশি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে গড়ে ৪৩ হাজার চর্মরোগের রোগীর চিকিৎসা করেছে সংস্থাটি। ২০২১ সালে চর্মরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৭৩ হাজারে পৌঁছে যায়। চলতি বছরের ১৪ মার্চ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত স্ক্যাবিস সংক্রমণ গণনা করা হয়। এই সময়ে তাদের পরিসংখ্যানে আসে- হাকিমপাড়া ও জামতলী হেলথ সেন্টারে ৩৬ হাজার স্ক্যাবিস রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়াও ক্যাম্প-৮ ডব্লিউ এবং গোয়ালমারা হেলথ সেন্টারে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪ হাজার ২০০ জন স্ক্যাবিস রোগী। পাশাপাশি কুতুপালং, বালুখালি এবং উচিপ্রাং-এ আরও অনেক স্ক্যাবিস রোগী এমএসএফ হতে চিকিৎসা নিয়েছেন।

উনচিপ্রাং ক্যাম্পের এ ব্লকের বাসিন্দা ইসমাইল জানান, তার তিন বছরের ছেলে মিজান গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চর্মরোগে আক্রান্ত। চুলকানির যন্ত্রণায় কাতর থাকে দিনরাত। মিজানের মতো পরিবারের ৫ সদস্যের আরও ৩ জন এই রোগে আক্রান্ত।

১৪ নাম্বার হাকিমপাড়া ক্যাম্পের বি ব্লকে গিয়ে দেখা যায়, জাফর আলমের পরিবারের ৬ সদস্য ছোট দুটি কক্ষে বাস করছেন। রান্নাও হয় এখানে৷ এমন পরিস্থিতিতে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত পরিবারের সদস্য ও এক সন্তানকে আলাদা রাখার সুযোগ নেই বলে জানান জাফর।
জাফরের মতো পরিস্থিতিই ক্যাম্পের প্রায় সব স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের।

এ ক্যাম্পের বাসিন্দা মৌলভী আবু হানিফ ও আহমদ হোসেন জানান, ক্যাম্পে অপর্যাপ্ত পানি এবং স্যানিটেশনের কারণে এ রোগের প্রার্দুভাব বাড়ছে। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ ও শিশু সকলে এ রোগে আক্রান্ত। আক্রান্তরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বঞ্চিত। আক্রান্তদের শরীরে দগদগে ঘা হওয়ায় কেউই তাদের সঙ্গে মিশছে না। আক্রান্তদের পাশে দোকানে, মসজিদে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ বসে না। এক ধরণের মানবেতর জীবনযাপন তাদের। কিন্তু ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে একলা থাকারও কোন উপায় নেই। সব ক্যাম্পে আক্রান্তের সংখ্যা শিশুসহ লাখ ছাড়াবে।

ডা. কামাল উদ্দিনের মতে, চলতি বছরের শুরুর দিকে স্ক্যাবিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকন্দ্রের মধ্যে একটি অস্থায়ী স্ক্যাবিস ট্রিটমেন্ট সেন্টার চালু করা হয়েছে। যেখানে আক্রান্তদের আলাদা করে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়।। স্ক্যাবিস পরিস্থিতি দিনদিন অবনতির দিকে যাচ্ছে, তাই জরুরি মানবিক সহায়তা আরও বাড়ানো দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ক্যাম্পে স্ক্যাবিস রোগী বাড়ছে বলে খবর পেয়েছি। তবে এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বিষয়টি মারাত্মক পর্যায়ে গেলে আরআরআরসি ও ক্যাম্পে নিয়োজিত স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা আমাদের অবহিত করবেন। এরপর বিষয়টি নজর রাখা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সিভিল সার্জন।