চট্টগ্রামের নগর ভবন ঘিরে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি, রক্ষাকবচ কাউন্সিলর


জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস এলাকার জিলাপি পাহাড় এবং বাটালী পাহাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বসতি। সময়ের সঙ্গে এসব এলাকায় বাড়ছে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণের কাজ। পাহাড় দুটির দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে হাজারখানেক সেমিপাকা ও অস্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছেন ছিন্নমূল ও খেটে খাওয়া মানুষেরা। যদিও পাহাড় দুটির মাঝখানেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কার্যালয়। চসিকের নাকের ডগায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে উঠলেও নির্বিকার প্রতিষ্ঠানটি।

অভিযোগ আছে, স্থানীয় কাউন্সিলর, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও কর্পোরেশনের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে পাহাড়ের পাদদেশে ঘর তৈরি করে নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। বেচাকেনা হয় পাহাড়ি জায়গাও। যেখানে দরখাস্ত দিয়েও গ্যাস, ওয়াসার পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে গ্রাহকদের পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি, সেখানে পাহাড়ের প্রতিটি ঘরে বিদ্যমান এসব সুবিধা। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সহজলভ্য ও তুলনামূলক কম টাকায় থাকা যায় বলে নিম্ন আয়ের লোকজন এসব ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস করে আসছেন বছরের পর বছর।

সোমবার (২০ জুন) সরেজমিন দেখা গেছে, নগর ভবনের ঠিক পেছনে বাটালী পাহাড়ের টিলা, খাজ ও পাদদেশে রয়েছে শত শত ঘরবাড়ি। এসব ঘরে বসবাসকারীদের অধিকাংশই পেশায় দিনমজুর, রিকশাচালক। পাহাড়ে নির্মিত এসব বসতির প্রায় প্রতিটিতেই রয়েছে ওয়াসার পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ। আছে পাকা সড়কও। এসব পাহাড়ের চূড়ায় মোটরসাইকেল ও সিএনজি অটোরিকশা নিয়েও উঠতে দেখা যায়।

পাহাড়ে নির্মিত এসব বসতিতে প্রবেশের জন্য রয়েছে অসংখ্য প্রবেশপথ। চট্টগ্রাম রেলওয়ের সহকারী প্রকৌশলী সিজিডি এবং রেলওয়ের উপ সহকারী প্রকৌশলী পানি-পূর্ত’র কার্যালয়ের পাশে দিয়ে পাহাড়ে প্রবেশের জন্য রয়েছে পাকা সিঁড়ি। এছাড়া নগর ভবনের সামনে ও পেছন দিয়ে মাটি কেটে বেশকিছু পথ বানানো হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের লোকজনের উপস্থিতিতেই অনায়াসে পাহাড়ে উঠানামা করতে দেখা গেছে তাদের।

জিলাপি পাহাড় এবং বাটালী পাহাড়ের (মতিঝর্ণা পাহাড়) মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ২৬ একরের বাটালী পাহাড় ঘিরে গড়ে উঠা বসতিগুলো। প্রায় তিন বছর আগেই এই পাহাড় থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব স্থানের বাসিন্দা ও প্রভাবশালী নেতাদের কাছে প্রশাসনও অনেকটা অসহায়। উচ্ছেদ অভিযান দূরের কথা মাইকিং করতেও এসব এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে পারে না বলে আলোচনা আছে।

শুধু তাই নয়, অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ রোধে একটি সংগঠনও রয়েছে এই পাহাড়ের বাসিন্দাদের। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরাই নিয়ন্ত্রণ করেন এই কমিটি। নিজেদের কার্যালয়ও রয়েছে এই কমিটির। জানা যায়, মাসিক ভাড়া ও অন্যান্য চাঁদা ‘মতিঝর্ণা অবৈধ উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যানারেই নেওয়া হয়। আর এই কমিটির আহ্বায়ক লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলাল নিজেই! শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তবতা।

বাটালী পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে পরিবারসহ বসবাস করছেন নেয়ামত উল্লাহ। পেশায় কামার তিনি। একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের এক লোকের কাছ থেকে লিজ নিয়ে এখানে বসতি স্থাপন করেছি। তারাই বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ এনে দিয়েছেন। আমাদের যাবতীয় সহযোগিতাও তারাই করেন। ঝুঁকিপূর্ণ বুঝতে পারছি কিন্তু আমরা কই যাবো। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় তারা এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তুলেছেন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তারপর তারাই আগে এসে দৌড়াদৌড়ি করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো তারাই এসব নিয়ন্ত্রণ করেন। বিষয়টি মেয়র মহোদয় জানেন না। জানলে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নিতেন।’

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বাটালী পাহাড় ও আশপাশের প্রায় সব জায়গার মালিক রেলওয়ে। ২০১৬ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাটালী (মতিঝর্ণা) পাহাড় সংলগ্ন ওই এলাকায় অবৈধ স্থাপনার মধ্যে ১ হাজার ৫০টি কাঁচাঘর, ৩৫০টি সেমিপাকা ঘর এবং ৫১০টি কাঁচা ও সেমিপাকা দোকান এবং বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনা আছে। ওই সময় নানা প্রতিকূলতায় মধ্যে জরিপ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বিগত ৫ বছরে অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেড়েছে।

যদিও ২০১৯ সালের শেষের দিকে মতিঝর্ণা পাহাড়সহ চট্টগ্রামে বেহাত হয়ে পড়া বিপুল পরিমাণে জমি, পাহাড়, রেললাইন উদ্ধারে অভিযানে নামে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য আফসারুল আমিনের ডিমান্ড অব অর্ডার চিঠিতে (ডিও লেটার) এই অভিযান আলোর মুখ দেখেনি বলে অভিযোগ আছে। তারও আগে জেলা প্রশাসনের একটি দল অবৈধ বসতিগুলো উচ্ছেদ করতে গেলে বিএনপি নেত্রী ও তৎকালীন নারী কাউন্সিলর মনোয়ারা বেগম মনি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুমের বাধার মুখে পিছু হটে। তারপর থেকেই প্রায় প্রতি বর্ষায় ওই পাহাড়ের পাদদেশে ধস নামলেও কোনো উচ্ছেদ অভিযানই পরিচালনা করেনি রেলওয়ে কিংবা অন্য কোনো সংস্থা।

পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ বসবাসকারীদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে ‘মতিঝর্ণা অবৈধ উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র আহ্বায়ক ও লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলালকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

যদিও পাহাড়ের এসব বসতি অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ নয় দাবি করে ‘মতিঝর্ণা অবৈধ উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র সমন্বয়ক তপন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আর আমরা যদি অবৈধ হতাম তাহলে পিডিবির বিদ্যুৎ, ওয়াসার পানি, কর্ণফুলীর গ্যাস সংযোগ কীভাবে পেলাম? যখনই আমাদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করা হয় তখনও এই কমিটি থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কাউন্সিলর বেলাল আমাদের যেভাবে দিক নির্দেশনা দেন আমরা সেভাবেই কাজ করি।’

এদিকে, আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় ধসের পর গত শনিবার সকাল থেকে পাহাড়ের আশেপাশের এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে বসবাসরতদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। যদিও তা পাত্তাই দেয়নি পাহাড়ের দখলদাররা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড় ধসে কেবল প্রাণহানি ঘটলেই জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের টনক নড়বে। অভিযোগ, পাহাড় দখলকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় না আনায় দখল ও বসতি বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মহানগর এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার দায়িত্ব ও আইনত এখতিয়ার রাখে সিটি কর্পোরেশন। এই কাজটা আমাদের না, দায়িত্বশীলরা নিজেদের কাজ করছেন না বলেই আমাদের করতে হচ্ছে। তারপরও মানুষের নিরাপত্তার জন্য যা যা আমাদের করা প্রয়োজন, আমরা করবো।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আকবরশাহ এলাকায় আগে কেউই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি। কিন্তু আমরা তা করেছি, ১৫০টি ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ভেঙে দিলাম, কেউ আটকাতে পেরেছে? উচ্ছেদের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি (কাউন্সিলর) কিংবা প্রভাবশালী যেই হোক না কেন, কেউই বাধার কারণ হতে পারবেন না। আগেও আমাদের কেউ আটকাতে পারেনি, এখনও পারবে না।’

চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা তাদের প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছি, মাইকিং করছি। কিছুদিন আগেই মেয়র মহোদয়ের পিএস নিজে গিয়ে তাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার কথা বলে এসেছে। যেহেতু তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই আমরা চাচ্ছি অন্তত ঝুঁকির সময় যাতে তারা নিরাপদ স্থানে চলে যায়। কিন্তু দিনে গেলেও তারা রাতে ফিরে আসে। এসব বসতি ভেঙে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

এমন ঘটনা চসিকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নগর ভবনের আশেপাশের এসব বসতি উচ্ছেদের জন্য আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে চেষ্টা করে আসছি। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী এসব বসতিতে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তাহলে আমরা কি জবাব দেব! আমার অতিসত্ত্বর এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

এদিকে শীঘ্রই এসব পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হবে জানিয়ে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমি পাহাড়ের এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতি তুলে দেওয়ার পক্ষপাতি। কারণ সাময়িকভাবে সরিয়ে নিলেও তারা পুনরায় চলে আসে। উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমার পিএস’কে বলেছি। উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করতে প্রয়োজনে আমরা ফোর্স এপ্লাই করবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘আর এসব প্রতিরোধ কমিটি কোনো ব্যাপার না। বিষয়টা যেখানে মানুষের জীবনের সেখানে এসব কমিটির কথা চিন্তা করার সময় নেই। আই ডোন্ট কেয়ার। যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি আছে সেখানেই উচ্ছেদ হবে। আমি পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই জায়গা যারই হোক, পাহাড়ের চূড়া কিংবা পাদদেশে কেউ থাকতে পারবে না। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনারের সাথেও আমি আলাপ করবো।’