রবিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১

ডেটলাইন কাতার : উত্তাপ আর প্রতাপে নিরীহদের বলি

| প্রকাশিতঃ ১১ জুন ২০১৭ | ৬:৫৩ অপরাহ্ন

নুর মোহাম্মদ (নুর), কাতার : ৫ জুন সকালে সংবাদপত্রে চোখ রাখতেই ভ্রু কুচকে গেল। অভূতপূর্ব এক পদক্ষেপের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামপন্থী মৌলবাদী দলগুলোকে সমর্থনকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে কাতারের সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলো একে একে সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর।

এমনটা নতুন কিছু নয়, ২০১৪ সালে মার্চ মাসে সৌদি আরবের নেতৃত্বে এসব উপসাগরীয় দেশগুলো সাবেক মিশরীয় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুরসিকে সমর্থনের অজুহাতে কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছিল। কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের আট মাস পর অনেক জল গড়িয়ে সম্পর্ক পুনস্থাপিত হয়েছিল। তবে এবারের দৃশ্যকল্প একটু ভিন্ন। তিন বছর আগের ঐ পদক্ষেপে শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু এবারের মত জল, স্থল ও আকাশপথ অবরোধের ঘোষণা দিয়ে অর্থনৈতিক ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়নি।

সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর দেশত্যাগের জন্য কাতারি কূটনীতিকদের ৪৮ ঘণ্টা এবং নাগরিকদের ১৪ দিন সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। বিরোধপূর্ণ দেশগুলির উপর দিয়ে কাতার এয়ারওয়েজের আকাশপথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাথে এয়ার এরাবিয়া, ফ্লাই দুবাই, আল ইত্তেহাদ, গালফ এয়ার, এমিরেটস এয়ারলাইন, সৌদি এয়ারলাইন্স, ইজিপট্ এয়ার কাতারে ফ্লাইট অপারেশন বাতিল ঘোষণা করেছে।
একই সাথে স্থল ও জলপথে চলাচলে এসেছে নিষেধাজ্ঞা।

এসব কারণে জড়িত দেশগুলির অর্থনৈতিক সূচক যে ঊর্ধ্বগামী হবে না তা বলে দিতে গণক হবার প্রয়োজন নেই। তবে এখনো পর্যন্ত প্রভাবের প্রকট দৃশ্যমান হয়েছে তাও বলা যাবে না। সৌদি-জোটের জন্য সুখবর হল এশিয়ায় মালদ্বীপ ছাড়া আর কোনো দেশের সমর্থন না পেলেও আফ্রিকার দ্বীপপুঞ্জ কমরোস, ইয়েমেন (একাংশ), মরিতানিয়া, জিবুতি, সেনেগাল, লিবিয়া কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের তালিকায় ইতিমধ্যে যোগ হয়েছে। জর্ডানও নাম লিখিয়েছে এই তালিকায়। নামমাত্র হোক তবুও তালিকা লম্বা হচ্ছে আপাতত সৌদি-জোটের জন্য সান্ত¦না একটুকুই। প্রতিদানে সৌদি-আমিরাত এই দেশগুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করে দেখার বিষয়।

মুসলমানদের পবিত্র দুই ঘর কাবা ও মদিনা শরীফের জিম্মাদার বা খাদেম নামের আগে উপাধি লিখে সৌদি বাদশাহ পবিত্র রমজান মাসে লক্ষ লক্ষ মুসলিম উষ্মার জন্য পানি আনার ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়াতে কাতারিদের মনোভাব সুস্পষ্ট প্রকাশিত না হলেও এদেশে কর্মরত ভারতীয় মহাদেশ ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে দাগ কেটেছে নিঃসন্দেহে।

উল্লেখ্য, কাতারের সাথে একমাত্র স্থলপথে সংযুক্ত সৌদি আরব। কাতারের আমদানি পণ্যের ৪০ শতাংশ সরবরাহ আসে সৌদি স্থলপথে। বোতলজাত পানি এসবের মধ্যে অন্যতম। কোনো উসকানি ছাড়াই শুধু অভিযোগের উপর ভিত্তি করে এমন প্রতিহিংসাপরায়ন ব্যবস্থাকে ভাল চোখে দেখছে না অনেক সাধারণ মুসলিম; বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসে যখন কাতার থেকে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলিমেরা ওমরা পালন করতে সৌদি আরব যায়। পবিত্র রমজানে সৌদি আরব, আমিরাত এবং বাহরাইনের এই অন্যায় ও ভ্রাতৃঘাতি আচরণ কাতারবাসী ভুলবে না।

এই ঘটনা হঠাৎ হলেও সংঘাত এক দিনের নয়। ফিলিস্তিন ভূখ-ে সশস্ত্র লড়াই করে দুটি দল হামাস আর ফাতাহ। সৌদি-আমিরাত মনে করে হামাস জঙ্গি সংগঠন তাই ফাতাহ-ই ফিলিস্তিনদের বৈধ সংগঠন, অন্যদিকে কাতার মনে করে উল্টো। এ নিয়ে সৌদি ও কাতারের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক দিনের পুরনো। যেহেতু হামাস ফিলিস্তিন ছাড়া অন্য কোনো দেশে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে না আর এই যুক্তিতে কাতার তাদের জঙ্গি আখ্যা দিতে নারাজ।

কাতারের ভাষ্য, নিজের দেশের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে; পশ্চিমা দেশের মিডিয়ার সাথে একেক হয়ে আমরা তাদের জঙ্গি আখ্যা দেব না। নিজেদের ভিটেমাটি উদ্ধারে যে লড়াই, সেটা যদি জঙ্গিবাদ হয় তবে পৃথিবীর সব মুক্তিযুদ্ধ জঙ্গিবাদ হতে বাধ্য। কাতার হামাসকে সমর্থন করে, কিন্তু তাই বলে হামাসবিরোধী ফাতাহকে কোনোদিন জঙ্গি সংগঠন বলে অভিযুক্ত করেনি কাতার। তাছাড়া এযাবৎ সংঘটিত সবগুলো আরব বিপ্লবে কাতার গণমানুষের পক্ষে থেকেছে।

অন্যদিকে সিরিয়ার বাসার আল আসাদের পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে আমিরাত, ইয়েমেনের পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট এবং হুথি নেতা আব্দুল্লাহ সালেহের পরিবার বসবাস করে আমিরাতে, মোসাদের অনেক গুপ্তচর থাকে আমিরাতে এমন অভিযোগ থাকলেও এসব উদাহরণকে যুক্তি বানিয়ে টানাটানি করেনি কাতার।
জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের ভাবমূর্তি তৈরিতে নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে চায় কাতার। তাদের মতে আয়তনে বড় বলে সৌদি-আমিরাতকে মুরব্বি মানার প্রথা অনেক আগেই ভেঙেছে কাতার।
এদিকে কাতারে অবস্থান করে আমারা যা উপলব্ধি করছি না, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম তা নিয়ে বাগাড়ম্বর করছে অব্যাহতভাবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমও মেতেছে এই খেলায়। আমাদের দেশে এত বেশি মধ্যপ্রাচ্য/উপসাগরীয় বিশেষজ্ঞ ছিল তা ঘুণাক্ষরেও মাথায় ছিল না। এতো বিশেষজ্ঞ থাকতে আরব আমিরাতে এত বছর ধরে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ রাখল। এখানে আলাপ আলোচনা করা উচিৎ ছিল, এতে বাংলাদেশ উপকৃত হত। রয়টার্স আর এপির চশমা চোখে থাকলে উপসাগরীয় অঞ্চলের আসল পরিস্থিতি বুঝা যাবে না।
কাতারকে বিচ্ছিন্ন করে উপসাগরীয় অঞ্চলে অস্থিরতার জন্য নিজের কৃতিত্ব জাহির করার পর তুরস্কের পক্ষ থেকে কাতারে সেনাবাহিনী পাঠানোর বিষয়ে তুরস্ক সংসদের বিল পাশ হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে কাতারের আমীরকে ফোন করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তার আগের করা টুইট এবং ফোনালাপ- দুটোই দ্বিমুখী অবস্থানের, ঠিক যেমনটা তার স্বভাবগত।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার কাতার। কাতারের ৪০ শতাংশ পণ্য আসে সৌদি আরব থেকে। উদ্ভুদ পরিস্থিতিতে কাতার ক্রেতা হিসেবে অন্য কোনো দেশ থেকে যে কোনো এসব পণ্য নিয়ে আসতে পারবে, প্রয়োজনে বাড়তি মূল্য দিয়ে কিন্তু সৌদি আরব এই ৪০ শতাংশ পণ্যের বিকল্প বাজার তৈরি করতে পারবে কি? কাতার ছাড়া সৌদি আরবের অন্যান্য প্রতিবেশিরা প্রায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কাতারের মত একটি টেকসই বাজার চলে গেলে নতুন বাজার সৃষ্টি করা অসম্ভাব্য হবে বলে মনে হচ্ছে।

মানে দিনের শেষে কাতারের যতই না ক্ষতি হবে সৌদি বা আরব ইমারাতের ক্ষতি হবে এরচেয়ে বেশি। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল যে, কাতারের শীর্ষ ১৫ টি আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের তালিকায় এমন কিছু নেই যেটা সৌদি আরব, আরব আমিরাতের বা বাহরাইন থেকে আসে বা এসব দেশের সীমানা দিয়ে অতিক্রম হয়। সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে কতটুকু কাতারকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তা দেখার বিষয়।

অন্যদিকে, যদিও ভৌগোলিক দিক থেকে কাতার একটি ছোট দেশ। কিন্তু এটি অত্যন্ত ধনী এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদক। বিশ্বের সর্বাধিক প্রতি মাথাপিছু আয়ের খেতাব তাদের দখলে এবং এই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটিও কাতারে, যা ইসলামিক স্টেট গ্রুপের জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য প্রস্তুত এই দেশ। প্রভাবশালী সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার জন্মস্থানও কাতারে। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে এখন সুসজ্জিত কাতার। বিশ্বে গুণগত শিক্ষার দিক দিয়ে জাপানের পর কাতারের অবস্থান। স্বাস্থ্যমান পর্যায়ে আরব বিশ্বের প্রথম দেশ কাতার এবং বিশ্বের ষষ্ঠ। বিশ্বের বৃহত্তম বিলাসবহুল পণ্য স্টোর হেরোড লন্ডনের মালিক কাতারের, বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্পে বার্ষিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এই দেশ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কাতার এয়ারওয়েজ বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান বিমান পরিবহন সংস্থা, যার বহরে ১৭০ টির বেশি বিমান রয়েছে।

কাতার টেলিকম কোম্পানি “উরেডু” ১৭ টি দেশে পরিচালনার মাধ্যমে ১০৭ মিলিয়ন গ্রাহকসেবা দিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের টাওয়ারগুলোর ২৮ শতাংশ কাতারের মালিকানাধীন। একটি ছোট দেশ; দৈত্যের মত সম্পদশালী দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে টপকিয়ে দীপ্ত দম্ভে কাতারের এগিয়ে যাওয়াকে স্বাভাবিক চোখে মানছে না কেউ কেউ।

কাতারের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া এবং আকাশ ও সমুদ্রপথে অবরূদ্ধ করার এই প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন বলেছেন কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল থানি। তিনি বলেন, আরব আমিরাতের ৪০ শতাংশ পাওয়ার জেনারেশন হয় কাতারের এলএনজি দিয়ে। কিন্তু কাতার চুক্তি মোতাবেক এলএনজি সরবরাহ দিয়ে যাবে আরব আমিরাতকে।

অন্যদিকে সুসজ্জিত অলংকরণের অভ্যন্তরে বিশ্বের ৫০ অধিক মুসলিম রাষ্ট্র-প্রধানদের উপস্থিতিতে সৌদি আরব গতমাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল অস্ত্র-চুক্তি করেছে। সৌদি আরবের আশেপাশে সবাই মুসলিম প্রতিবেশি। কাতার মনে করে এসব উন্নত অস্ত্র প্রতিবেশি রাষ্ট্রের উপর দমনপীড়নের কাজে ব্যবহৃত হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সৌদি আরব বিগ ব্রাদারের ভূমিকা পালন করতে হলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের সাথে নিয়ে যতই না এগিয়ে যেতে পারে, দমন পীড়নের মাধ্যমে এতোই পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি।

সঙ্কটময় দেশগুলিতে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের তুলনায় বেশি। পরস্পরবিরোধী দেশগুলো তাদের মধ্যকার অনিষ্পন্ন ইস্যুগুলো বসেই সমাধান করবে এমনটি প্রত্যাশা কাতারবাসীর।