শরীফুল রুকন : ব্রহ্মচারী মুরাল ভাই। ধর্মীয় মহাগুরু তিনি। ভারতের কলকাতা দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সংঘ আদ্যাপীঠের চেয়ারম্যান কাম ট্রাস্টি হিসেবে তিনি এখন দায়িত্ব পালন করছেন। যাঁর কর্মে, জ্ঞানে শুধুই মানবতার জয়গান। মানবসেবাই তাঁর কাছে বড় ধর্ম। সমাজের নিপীড়িত, বঞ্চিতদের নিয়েই তাঁর যত কাজ। তাঁর অনাথ আশ্রমের শত শত প্রতিবন্ধী ও মা-বাবাবিহীন বঞ্চিত নারী, শিশুকে তিনি মনে করেন নিজের সন্তান।
দীর্ঘ ৫১ বছর ধরে দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন মুরাল ভাই। ভালোবাসার পরশ পাথর দিয়ে মানুষের সব দুঃখ, কষ্ট, হতাশা দূর করা যায়—সেটা তিনি প্রমাণ করে চলেছেন। অসহায় মানুষের কাছে তিনি আনন্দের ফোয়ারা। এই পৃথিবীর কাছে যারা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, পরিবার যাদের ত্যাগ করেছিল, ভাগ্য ও জীবন যাদের অভিশাপ দিয়েছিলো আর সমাজ যাদের গ্রহণ করেনি কোনোকালেই, সে সব অনাশ্রিত, অসমর্থ, অসুস্থ, অবহেলিত, স্নেহবঞ্চিত মানুষদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেছেন সহানুভূতি, স্নেহ, সেবার অবিচল প্রতিশ্রুতির এক মূর্তরূপ।
এমনকি সমাজ ও পরিবার থেকে বিতাড়িত, চিকিৎসা সেবাবঞ্চিত রোগীদের তিনি শুধু আশ্রয়ই দেননি, নিজ হাতে তাদের সেবা করে আসছেন দিনের পর দিন। এভাবে ভালোবাসা বিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেছেন ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’। মুরাল ভাই সবসময় বলে থাকেন, ‘ধর্ম মানুষকে কোনো বিভেদ শেখায় না। ধর্ম বলে, কাউকে হিংসা করা যাবে না। অপরের প্রতি এমন আচরণ করা যাবে না, যে আচরণ আপনাকে করলে আপনার নিজেরই খারাপ লাগবে।’
মুরাল ভাইয়ের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৩ জানুয়ারি অখণ্ড ভারতবর্ষের অখণ্ড বঙ্গের অন্তর্গত (বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের দক্ষিণ চট্টগ্রামের) চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার কালীপুর গ্রামে। পরিবার প্রদত্ত নাম মুরাল চৌধুরী। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝো। তাঁর বয়স যখন মাত্র ছয়, তখন তিনি পিতাকে হারান। দশ বছর বয়স যখন, তখন চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন মাকে। মুরাল চৌধুরীর বড়ভাই দুলাল কান্তি চৌধুরী পরে বাঁশখালী থানার স্কুল ইন্সপেক্টর হন। তিনিই পিতামাতার সমান আদর ভালোবাসা দিয়ে ছোট ভাই-বোনদের লালন-পালন করেন, মা-বাবার অভাব কোনোদিন বুঝতে দেননি।
এভাবে দাদা দুলাল কান্তি চৌধুরীর সহযোগিতায় মুরাল চৌধুরী পড়াশোনা চালিয়ে যান। বাঁশখালীর কালীপুর এজহারুল হক স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন তিনি। এরপর সাতকানিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে আইএসসি, কানুনগোপাড়ার স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যায় অনার্সসহ বি.এসসি পাশ করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে এম.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন মুরাল চৌধুরী।
এরপরই মুরাল চৌধুরীর মনে হলো, এই সংসারটা সত্যিই মায়াময়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউই এই পৃথিবীতে চিরদিন থাকবে না। তাঁর মা-বাবা চলে গেছেন অকালে। তাঁকেও একদিন চলে যেতে হবে। তাই পরিবারের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা ঠিক নয়। গৃহসুখে সুখী হওয়া অন্য দশটা-পাঁচটা জীবন তাঁর জন্য নয়। এই জগতে বৃহত্তর, মহৎ অনেক কিছু তাঁর করার আছে। যেই ভাবা সেই কাজ। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ১৯৭১ সালে অজানার পথে পা বাড়ালেন আশৈশব বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মুরাল চৌধুরী।
এরপর কলকাতায় ১৯১৫ সালে অন্নদা ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সংঘ আদ্যাপীঠে যান তিনি। বঞ্চিতদের জন্য চট্টগ্রামের রাউজানের উত্তর গুজরার সন্তান অন্নদা ঠাকুরের তৈরি করা সেই অনাথ আশ্রমে মুরাল চৌধুরী প্রথম গিয়ে দেখলেন অনেক অনাথ ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সংঘের আশ্রমে থাকছেন-খাচ্ছেন, তখন তাদের দেখে মুরাল ভাই ঠিক করলেন, এখানে মানবসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেবেন। এরপর সেখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। তখন বেলুড়মঠের দশম সভাপতি স্বামী বীরেশ্বরানন্দ মহারাজের কাছে মুরাল চৌধুরী দীক্ষা নেন। দীক্ষাগুরু স্বামী বীরেশ্বরানন্দ মহারাজ স্বয়ং সারদ মায়ের দীক্ষিত সন্তান ছিলেন; যা রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার।
দীক্ষা শেষে মুরাল চৌধুরী হয়ে উঠেন সবার প্রিয় ‘মুরাল ভাই’। তিনি বলেন, ‘অন্নদা ঠাকুর বলতেন, সকলের নামের পাশে যেন ‘ভাই’ কথাটি থাকে।’ মুরাল চৌধুরী অন্নদা ঠাকুরের আদর্শ অনুসরণ করে এভাবে তার পূর্বনাম পরিবর্তন করে মুরাল ভাই-এ রূপান্তরিত হন। এরপর আদ্যাপীঠে আশ্রিতদের সেবায়, তাদের যত্নে, তাদের শিক্ষাদীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন মুরাল ভাই। আজ প্রায় ৫১ বছর ধরে সমাজের অগণিত মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে পরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন সারাবিশ্বে। তিনি এমন একজন অসাধারণ মানুষ যিনি মুক্তকণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারেন যে, তাঁর শুধু একটাই ধর্ম এবং সেটা হলো ‘মানবধর্ম’। তাঁর শুধু একটাই জাতি, সেটা হলো ‘মানবজাতি’।
মুরাল ভাই বলেন, ‘১৯৭১ সালে ঘটনাচক্রে আমি আমার জন্মস্থান বাংলাদেশের বাঁশখালী থেকে চলে এসেছিলাম কলকাতায়। সেখানে দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সংঘ আদ্যাপীঠে গিয়ে অন্নদা ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ও মানবতাবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর সান্নিধ্য লাভ করি।
শ্রী শ্রী অন্নদা ঠাকুর সম্পর্কে মুরাল ভাই বলেন, বাবা-মার নির্দেশে তিনি কলকাতা আয়ুর্বেদ কলেজ থেকে বিশেষ পারদর্শিতার সঙ্গে পাশ করার পর বিভিন্ন রোগের ৭ খানা ওষুধ তৈরি করে ফেললেন। বছরের মধ্যে লাখপতি হয়ে যাবেন। ১০০ নম্বর আমাস স্ট্রিটে আলোকে আলোকাকীর্ণ ডাক্তার হয়ে বসবেন। এমন সময় রামকৃষ্ণ দেব স্বপ্নে বললেন, আপনি ইডেন গার্ডেনে যান; ইডেন গার্ডেনের নিচে কোকোনাট ও পাকো ট্রির মধ্য থেকে আদ্যামাকে খুঁজে নিন। সঙ্গে নিয়ে যেতে বললেন সত্যকিঙ্কর রায়, সচিন বসু ও সচিন মজুমদারকে। রাম নববীর পূর্ণপ্রভাতে সেখান থেকে আদ্যামাকে খুঁজে পাবার পর অন্নদা ঠাকুরের জীবন পাল্টে গেলো। ডাক্তার হয়ে চেম্বারে আর বসা হলো না। এরপর থেকে সবসময় ভগবানের ভাবে বিভোর তিনি।
মুরাল ভাই বলেন, গীতা বলেছেন, যাকে লাভ করলে অন্য লাভকে ‘লাভ’ বলে বোধ হয় না এবং যেখানে স্থিতি লাভ করলে প্রচণ্ড দুঃখ আসলেও বিচলিত করতে পারে না, সেই লাভ হলো ‘ঈশ্বরলাভ’। মানবজীবনের উদ্দেশ্য। আমার অন্নদা ঠাকুর বলতেন, আধ্যাত্মিক জ্ঞান এমন এক জিনিস, যা আমাদের দুঃখ চিরতরে লাঘব করতে পারে। অপরাপর জ্ঞানগুলো ক্ষণিকের চাহিদা মেটাতে পারে। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের স্বাদ পাওয়ার পর বৈষয়িক কাজে অন্নদা ঠাকুর আর যেতে পারলেন না। দক্ষিণেশ্বরের আদ্যাপীঠে প্রথমে স্বামী, পুত্রহীনা বিধবা মায়েদের জন্য আশ্রম করলেন। অন্নদা ঠাকুর বলতেন, যে ধর্ম বিধবা মায়ের চোখের জল মোছাতে পারে না অথবা অনাথ ছেলে মেয়েদের মুখে রুটি দিতে পারে না, সে ধর্ম আমি বিশ্বাস করি না। অন্নদা ঠাকুর আরও বলতেন, ছেলে-মেয়ে একই সত্তা। মাতৃজাতির উন্নতি করতে না পারলে কোনো জাতির উন্নতি হবে না। অন্নদা ঠাকুর বলেছিলেন, একটা কর্মযজ্ঞ খুলে দিয়ে গেলাম। লেগে থাক। ধন্য হয়ে যাবি। আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য যে কাজ করবে তার জন্য আমি আছি। আমার কাজ যে করে আমি তার। এভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই আশ্রমে আমি থেকে যাই। সেখানে অন্নদা ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত আশ্রম, দক্ষিণেশ্বর মন্দির, মায়েদের আশ্রমের দায়িত্ব পাই আমি।’ -বলেন বিশ্বমানবতার অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ ব্রহ্মচারী মুরাল ভাই।
দায়িত্ব পাওয়ার পর ছোট ছোট কোমলমতি অনাথ শিশু বাচ্চাদের আদর যত্ন, লেখাপড়া নিশ্চিতে মনোনিবেশ করেন মুরাল ভাই; তার ঠিকানা আদ্যাপীঠে গিয়ে কেউ না খেয়ে ফিরে না। তিনি বলেন, ‘আশ্রমকে ঘিরে অন্নদা ঠাকুরের নানা স্বপ্ন ছিল। অন্নদা ঠাকুর মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্নকে আমি ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ দিয়েছি। এরপর আমি সেখানে বিএড কলেজ, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, হাই স্কুল, কালীমন্দির, বিশাল অনাথ আশ্রম, প্রাইমারি স্কুল, চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করেছি। ৮টি মোবাইল টিমের মাধ্যমে ১৭টি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মোবাইল চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় গ্রামে গ্রামে গিয়ে। এখন আশ্রমে শত শত শারীরিকভাবে অসুস্থ, বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধী আশ্রিত রয়েছেন। এখানে প্রতিদিন আড়াই হাজার ছেলে-মেয়ে শিক্ষা লাভ করে। প্রতিদিন হাজারেরও বেশি গরিব লোকজন খাবার খান। খাবার খান নানা প্রান্ত হতে পুণ্যার্থী ও অতিথি হয়ে আসা নানান পেশার লোকজন। প্রতিদিন এখানে খরচ হয় আড়াই লাখ রুপি। ঐশ্বরিক ক্ষমতা না থাকলে এইসব কাজ প্রায় একা হাতে সামলানো সহজ ব্যাপার না।’
অন্নদা ঠাকুর বলতেন, ‘কেউ যেন আমার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে বিমুখ না হয়।’ তাঁর সেই বাণীকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন মুরাল ভাই; বলেন, ‘এর পাশাপাশি আমি এখন কানাডা, ফ্রান্স, আমেরিকা, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ ১৭টি দেশে অনাথদের নিয়ে কাজ করছি। সেখানকার মানুষ আমাকে বলেন, তাঁদের পরজন্ম যেন ভারতে হয়।’
মুরাল ভাইয়ের আরেকটি বড় গুণ অসাধারণ বাগ্মীতা। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দিতে অনর্গল বক্তৃতা করতে পারেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া অনুষ্ঠানে প্রায়শ তাঁকে অতিথির আসন অলংকৃত করতে হয় শুভার্থীদের অনুরোধ রাখতে গিয়ে। কারণ কাউকেই তিনি ‘না’ করেন না, ফিরিয়ে দেন না। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তাঁকে প্রধান বক্তা বা কি-নোট স্পিকার করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেসব অনুষ্ঠানে অসাধারণ কথামালায় ‘মানবধর্ম’-এর ঝাণ্ডা উড্ডীন রাখেন মুরাল ভাই।
৭৭ বছর জীবনেও আপামর জনসাধারণের কল্যাণের জন্য নিরলস কাজ করার পাশাপাশি মুরাল ভাই প্রতিদিন তিন ঘণ্টা সাধনা করেন। ভক্তরা বলেন, ‘আমরা অনুভব করি আপনার সাধনা।’ আদ্যামা বলতেন, আমাকে ঘরে ঘরে প্রচার করো, তোমাদের কোনো অভাব থাকবে না। জগৎজননী আদ্যা মা’র প্রচার, অনাথ, অসহায়দের নিয়ে মানবিক কর্মযজ্ঞ, সমাজ ও মানবকল্যাণই মুরাল ভাইয়ের ৫১ বছরের ধ্যানজ্ঞান। আর তাতেই তিনি খুঁজে নিয়েছেন জীবনের মহাত্ম্য, জন্মের স্বার্থকতা, জাগতিক সুখ।
মুরাল ভাই বলেন, ‘অন্নদা ঠাকুর বলতেন, ভাইয়ে ভাইয়ে মিশে যা, প্রাণে প্রাণে মিশে যা। অন্নদা ঠাকুর তাঁর মন্দিরে মুসলিমদের চাঁদতারা, ক্রিস্টানদের ক্রুশ, হিন্দুদের শূল, বৌদ্ধদের বিহারের হাতপাখা রেখেছিলেন। তাঁর কাছে ধর্ম, জাত মুখ্য ছিল না। মানবতাই ছিল মুখ্য। স্বামীজী বলতেন, আমি মুসলিমদের মসজিদে যাব। আমি খ্রিস্টের গীর্জায় যাবো, নতজানু হয়ে ক্রুশবিদ্ধ পবিত্র যীশুর সামনে প্রণাম জানাবো। আমি হিন্দুদের সঙ্গে গভীর অরণ্যের মধ্যে ধ্যানে মগ্ন থাকব। আমার হৃদয় সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সকলে যেন আমার কাছে এসে জুড়াতে পারে।’
মুরাল ভাই বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো ভক্তি পৃথিবীর আর কোনো দেশে খুঁজে পাই না। আমার কলকাতার দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সংঘ আদ্যাপীঠ সকল ধর্মের মানুষের জন্য খোলা। বাংলাদেশের মানুষকে কাছে পেলে আমার ভীষণ ভালো লাগে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে আমি আমাকে খুঁজে পাই।’
বাংলাদেশ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মুরাল ভাই বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি কলেজ, একটি হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম করার চিন্তা আছে। যদি এ শরীরটা বেঁচে থাকে তাহলে জীবদ্দশায় এসব বাস্তবায়ন করব। এছাড়া কলকাতায় একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করার ইচ্ছা আছে।’
বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এদেশের মানুষের ভক্তি, ভালোবাসা বিশ্বে বিরল। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে গিয়েছি, বাংলাদেশের মানুষের মতো ভালোবাসা পাইনি।’
চট্টগ্রামের রাউজানের উত্তর গুজরায় অন্নদা ঠাকুরের জন্মস্থানে গড়ে তুলেছেন আদ্যাপীঠ মন্দির। অনাথ, অসহায় নারী-পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সবার জন্য এখানেও গড়ে তুলেছেন বিশাল মানবিক কর্মযজ্ঞ। এ কাজে রাউজানের সাংসদ, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর অপত্য সহযোগিতা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন ব্রহ্মচারী মুরাল ভাই।
কখনোই জাতি-ধর্ম-বর্ণের সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি মুরাল ভাই। ধর্মপার্থক্য নেই তাঁর কাছে। প্রত্যেক ধর্মের মানুষের সেবা করা তাঁর কাজ। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কয়েকশ’ মুসলিমকে চিকিৎসা করিয়ে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছেন মুরাল ভাই। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের অনেক মানুষ কলকাতায় গিয়ে মুরাল ভাইয়ের কাছে উঠেন। বাংলাদেশের মানুষকে কাছে পেলে প্রচণ্ড রকমের ভালো লাগে তার। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষের প্রতি আলাদা একটা টান রয়েছে মুরাল ভাইয়ের।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের বহুল প্রচারিত একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার বলেন, ‘২০০১ সালে এক বিকেলে চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মাধ্যমে ব্রহ্মচারী মুরাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন আমি আমার বাবা-মাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে গিয়েছিলাম। সাথে ছিল মহিউদ্দিন চৌধুরীর চিরকুট। সেটি হাতে পেয়ে তিনি লাফিয়ে উঠলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীকে তিনি অসম্ভব সম্মান, শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বললেন, চট্টগ্রামের বীর পুরুষ, আমার কাছে অতিথি পাঠিয়েছেন। সেইভাবেই তিনি আমাদেরকে গ্রহণ করলেন। এরপর থেকে আজ ২২ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে, কলকাতা গেলেই, ভারতে গেলেই মুরাল ভাইয়ের আতিথেয়তা আমার নিতে হয়। ওনি বাংলাদেশে এলে আমাদের বাসায় আসেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মুরাল ভাই যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ, অসাম্প্রদায়িক দীক্ষায় দীক্ষিত একজন মানুষ, সেটির বড় প্রমাণ হচ্ছে, আমি নিজেই। রজমান মাসে বাবা-মাকে নিয়ে আমি ওনার কাছে গিয়েছিলাম, রমজান উপলক্ষে তিনি রোজ আমাদের সেহেরি, ইফতারের ব্যবস্থা করেছেন, সেই মন্দিরে। সার্বক্ষণিক দুই-তিনজন মানুষ আমাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর ব্যবহৃত সবচেয়ে দামি গাড়িটি তিনি আমাদের চলাফেরার জন্য দিয়েছিলেন। আমার মায়ের জীবদ্দশায় তিনি আমার মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতেন। আমার মাকে ‘মা’ ডাকতেন। আমার মাকে এতটাই ভক্তি করতেন তিনি। সেই সুবাদে আমি যেন মুরাল ভাইয়ের সত্যিকারের ছোটভাই, আপন সহোদর। সেভাবেই সুখে-দুঃখে আজ ২২টা বছর তিনি আমাকে আগলে রেখেছেন। গত একবছর ধরে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে হায়দারাবাদ ও ভেলোরের সিএমসিতে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখানেও মুরাল ভাই অনুক্ষণ আমার খোঁজ নিতে ভুলছেন না। নানাভাবে সাহস জোগাচ্ছেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আজাদ তালুকদার বলেন, মুরাল ভাই একসময় আদ্যাপীঠ থেকে আমাকে আজমীর শরীফ পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছেন। এখানেই বোঝা যায়, তিনি কত বড় অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তিনি যে মানবধর্মকে লালন করেন, সেটি তিনি বারে বারে প্রমাণ দিয়েছেন। যার জলন্ত প্রমাণ আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা।’
এদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুরাল ভাইকে নিয়ে ‘সেবার অন্যন্য দৃষ্টান্ত মুরাল ভাই’ নামে বইও ছাপিয়েছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন। মুরাল ভাই সবসময় বলে আসছেন, ‘অন্নদা ঠাকুর বলতেন, যাঁরা জীবনে নিজের জন্য কাজ করে, তাঁরা বেঁচে থাকে মৃত মানুষ হয়ে। তাঁরাই বেঁচে থাকেন, যাঁরা পরের জন্য কাজ করেন। অন্নদা ঠাকুরের এই মন্ত্রে আমি কাজ করে চলেছি। জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে আমি ধন্য হব।’