রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুখোমুখি দুই সশস্ত্র গ্রুপ, বড় সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছে


জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার : আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আলোচিত মাস্টার নবী হোসেন গ্রুপের মধ্যে ক্যাম্পে যে কোনসময় বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। হামলা চালানোর সুবিধার্থে ক্যাম্পের প্রহরীদের (স্বেচ্ছাসেবক) টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ বুধবার (১৫ জুন) রাতে দুর্বৃত্তরা মো. সলিমুল্লাহ ওরফে মো. সেলিম (৩০) নামের ক্যাম্পের এক পাহারাদারকে গুলি করে হত্যা করেছে। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে তিনজন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক নিহত হলেন।

রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুই নম্বর ক্যাম্পে সক্রিয় ছিলেন সলিমুল্লাহ। সেখানে গুলিবিদ্ধ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মৃত্যু হয় তার।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃংঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক মো. নাইমুল হক বলেন, ‘নিহত সেলিম কথিত আরসা গোষ্ঠীর সমর্থক। মুন্না গ্রুপ নামের অপর একটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। মুন্না গ্রুপ ওরফে মাস্টার মুন্না আলোচিত সন্ত্রাসী মাস্টার নবী হোসেনের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।’

এদিকে সাধারণ রোহিঙ্গারা দাবি, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ক্যাম্পের নাশকতা ঠেকাতে যেসব রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন এবার তাদের টার্গেট করে হত্যা করছে সন্ত্রাসীরা। গত এক সপ্তাহে যে তিনজন রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের শিকার সবাই ক্যাম্পের (পাহারাদার) স্বেচ্ছাসেবক বলে দাবি করেছেন রোহিঙ্গারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত ও ক্যাম্পের ভেতরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ২ সপ্তাহে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তোতার দিয়া নামক স্থানে নবী হোসেনের আস্তানায় অতর্কিত হামলা চালিয়েছে আরসার সন্ত্রাসীরা। ওইদিন তাদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে নবী হোসেনের আপন ভাই ভুলুসহ ৬ জন নিহত হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। নবী হোসেনের আস্তানায় ব্যাপক গুলিবর্ষণের শব্দ শোনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবির। তবে হতাহতের বিষয়ে নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

রোহিঙ্গা সূত্রে জানা গেছে, ওই হামলার প্রতিশোধ নিতে ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতা ও হামলার প্রস্তুতি নিয়েছে মাস্টার নবী হোসেনের গ্রুপ।হামলার টার্গেট করা হয়েছে কথিত আরসার সদস্য ও তাদের পরিবারকে। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবকরা। এ কারণে সন্দেহভাজন ও আরসার সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাসেবকদের হত্যা করছে নবী হোসেন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। রোহিঙ্গাদের একাধিক সূত্র বলছে, যেকোনো সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতা ও ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের ঘটনা হতে পারে। এমনকি ইতিমধ্যে ২২ নম্বর ক্যাম্পসহ কয়েকটি স্থানে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ঢুকানো হয়েছে বলেও আলোচনা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর কোণঠাসা হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা। মুহিবুল্লাহকে হত্যার দায়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে থাকা রোহিঙ্গা প্রবাসীরাও আরসাকে চাঁদা দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।এতে আর্থিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে আরসা।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব্বুল্লাহ এবং আরসার প্রতিষ্ঠাতা মো. হাসিমকে হত্যার পর নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে আরসা। এ কারণে অনেকেই আরসা আমির আতাউল্লাহ জুননীর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে আরসা ত্যাগ করেন।

এ সুযোগে কৌশল ও বল প্রয়োগ করে কথিত আরসার মাদকের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিজের আওতায় নিয়ে নেয় আলোচিত মাস্টার নবী হোসেন। এ কারণে কথিত আরসা আমির আতাউল্লাহর নির্দেশে নবী হোসেনকে হত্যার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি তার আস্তানায় হামলা করে আরসার সদস্যরা।

এদিকে আরসা ও মাস্টার নবী হোসেন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হলে ক্যাম্পে ব্যাপক প্রাণহাণির সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দুই গ্রুপের কাছে ভারি অস্ত্র। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। তাই বড় ধরনের সংঘাতের আগে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজর রাখা একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নবী হোসেনকে হত্যার জন্য আরসা তার আস্তানায় হামলা ও ব্যাপক গুলিবর্ষণ করেছিল, এটা ঠিক। তবে হতাহতের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ হামলাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতা বা হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা ঘটনার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাই এ বিষয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছে।’

১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক মো. নাইমুল হক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মুহিবল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর ৯ মাসে ৩ থেকে ৪ হাজার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড জড়িত রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু এসব অপরাধীদের প্রায় ৭০ ভাগ কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে এসেছে। এ কারণে ক্যাম্পে ফের খুনের মত ঘটনা ঘটছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে।’

এসপি নাইমুল হক বলেন, ‘ক্যাম্পের অপরাধ দমন ও নাশকতা ঠেকাতে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে তৎপর রয়েছে এপিবিএন সদস্যরা। আমরা আরও কয়েকটি চেকপোস্ট বৃদ্ধি করেছি, টহল দলের সংখ্যাও বাড়িয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের সচেতন করতে ক্যাম্পিং, বিট পুলিশিংসহ নানা প্রচারণা চালানো হচ্ছে।’

প্রসঙ্গেত, গত বছর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবউল্লাহ এবং মাদ্রাসায় ছয় খুন হওয়ার পর অক্টোবর থেকে স্বেচ্ছায় পাহারা সিস্টেম চালু করা হয়। বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নয় হাজার ৩০০ সেচ্ছাসেবী সক্রিয় রয়েছেন।