সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

রাসায়নিকের তথ্য গোপনে এত মৃত্যু

বিএম ডিপোতে আগুন-বিস্ফোরণে প্রাণ গেল ৪৬ জনের

প্রকাশিতঃ ৬ জুন ২০২২ | ৯:৫৩ পূর্বাহ্ন


একুশে প্রতিবেদক : শনিবার (৪ মে) রাত সাড়ে ৯টা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোর আইসিটি বিভাগের তরুণ কর্মী মবিনুল হক ফোন করে বাবা ফরিদুল আলমকে জানিয়েছিলেন সেখানে আগুন লাগার কথা। পরে বিস্ফোরণে একটি পা উড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বাবাকে বলেছিলেন কালেমা পড়ে মাফ করে দিতে। এরপর ছেলের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে না পেরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে মবিনুলের লাশ শনাক্ত করেন তিনি। বিএম কনটেইনার ডিপোতে এ বিস্ফোরণে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মবিনুলের লাশই প্রথম শনাক্ত হয়।

অন্যদিকে ‘ভাইরে, পুড়ে যাচ্ছি, মরে যাচ্ছি। আমার চেহারা শেষ।’ বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে এ কথা বলতে বলতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন মো. মহিউদ্দিন (২০)। বছর চারেক আগে সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনাকবলিত বিএম কনটেইনার ডিপোতে চাকরি নেন তিনি।
বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার অন্তত দুই ঘন্টা পর বিকট শব্দে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে শনিবার রাত ১১টায়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের বাড়িঘরের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। রাতে প্রথম বিস্ফোরণের পর সারা রাত থেমে থেমে বিস্ফোরণ হয়। শনিবার রাতে বিস্ফোরণের পর থেকে রোববার দিবাগত রাত ১২টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও ডিপোতে আগুন জ্বলছে। শনিবার রাতের এই আগুন-বিস্ফোরণ কেড়ে নিয়েছে অন্তত ৪৬ জনের প্রাণ। একই ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৩৪ জন। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন অর্ধশতাধিক মানুষ।

রোববার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বিএম ডিপোর ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুড়ে যাওয়া মরদেহ। কোথাও পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন হাত। এদিক-সেদিক ছিটানো লোহার পাত, রাসায়নিক রাখা প্লাস্টিক জারের ভাঙা টুকরা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পোড়া হেলমেট, পোশাক। ডিপোর ভেতরে কনটেইনারের ধ্বংসস্তূপ থেকে তখনো বের হচ্ছিল আগুনের ফুলকি। রাসায়নিকের ঝাঁজালো গন্ধ। এর মধ্যেই থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পুরো এলাকা যেন ধ্বংসস্তূপ।

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে অবস্থিত বিএম ডিপোর আশপাশে জনবসতি আছে। বড় ভবন কম। নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। বিস্ফোরণের কারণে অনেকের ঘরের জানালার কাচ, দরজা ভেঙে গেছে। বেশির ভাগ বাসার টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর ও বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট হয়ে গেছে। ডিপোর আশপাশে টিনের ছাউনির ঘর বেশি। বেলা ১টা নাগাদ সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা কালো ও বিষাক্ত ধোয়ার কারণে ঘরে টিকতে পারছেন না। অনেককেই মুখে কাপড় বেঁধে বসে থাকতে দেখা যায়।

ফায়ার সার্ভিস ও ডিপোর কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিএম কনটেইনার ডিপোতে ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক রয়েছে। হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। তবে আগুন লাগার পরপরই এই রাসায়নিক থাকার কথা ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি ডিপো কর্তৃপক্ষ। যার কারণে সাদামাটা প্রস্তুতি নিয়েই আগুন নেভাতে গিয়ে প্রাণ হারান ফায়ার সার্ভিসের ১০ সদস্য, এখনো নিখোঁজ ফায়ার সার্ভিসের দুই কর্মী।
ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে কনটেইনারে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থাকায়। ৩৩টি কনটেইনারে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল প্রায় ৮০০ টন। আগুনের সংস্পর্শে এলে এসব রাসায়নিক তীব্র দাহ্য হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে পানি যোগ হলে ভয়াবহ বিস্ফোরকে পরিণত হয়।

ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন করতে এরই মধ্যে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সাত কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। লাশগুলো এতটা পুড়েছে যে স্বজনরাও তাদের চিনতে পারছেন না। মাত্র ১৮ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাকিদের পরিচয় শনাক্ত করতে ফরেনসিক রিপোর্ট নেবে কর্তৃপক্ষ। এ জন্য ঢাকা থেকে আনা হচ্ছে বিশেষজ্ঞ দল। আহতদের মধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন দুই শতাধিক ব্যক্তি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন ৯৯ জন। সংকটাপন্ন হওয়ায় অন্তত ১৪ জনকে ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।

ডিপোতে আগুন লাগার সময় কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কাজ করছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। তবে পরিবহন শ্রমিক ও ডিপোর কর্মী মিলে কয়েক শ হবে বলে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যরা। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর টিম। আগুন নেভাতে চট্টগ্রামের চারটি উপজেলা, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের ১৮৩ সদস্য কাজ করছেন। এ ছাড়া উদ্ধারকাজে নানাভাবে সহায়তা করেছেন পুলিশ, র‌্যাব ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। আগুন নেভাতে গিয়ে পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এক পুলিশের সদস্যের।

আইএসপিআর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় উদ্ধার অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৫০ জন সদস্য কাজ করেন। উদ্ধার অভিযান ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সহায়তার জন্য তৎপর রয়েছে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞ দল। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ও নিরাপত্তা দলও কাজ করছে। বিস্ফোরণের কারণে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিকসামগ্রী যাতে সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য এই দল কাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশও সহায়তা করছে। সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম শনিবার রাত থেকেই কাজ করছে। আহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল ও সিএমএইচে স্থানান্তরে সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা করেছে। ফায়ার সার্ভিসের ১৪ সদস্যসহ আহত ১৫ জন চট্টগ্রাম সিএমএইচে চিকিৎসাধীন।

অভিযোগ উঠেছে, বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ সেখানে দাহ্য পদার্থ থাকার তথ্য না দেয়ায় আগুন ও বিস্ফোরণে এত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। রোববার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘কনটেইনার ডিপোটির মালিকপক্ষের কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। এখানে কী ধরনের কেমিক্যাল আছে, তা বলা যাচ্ছে না। পানি দিয়ে সব কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে।’

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার জানান, ‘আগুন লাগার পর কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষকে আমরা পাইনি। তাদের কেউ আমাদের জানায়নি যে সেখানে কেমিকেল আছে। তথ্য জানা না থাকায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মারা যান। কারণ কেমিকেল থেকে লাগা আগুন নেভানোর কৌশল আলাদা। ভিন্ন ধরনের পার্সোনাল প্রটেকটিভ সরঞ্জাম লাগে। কেমিকেলের তথ্য না জানায় ফায়ার ফাইটার যারা ফ্রন্ট লাইনে ছিলেন তারা মারা যান।’

তিনি বলেন, ‘কনটেইনার ডিপো করতে হলে ফায়ার লাইসেন্স দরকার হয়। এটা ছাড়া ডিপো করা যায় না। আর কোনো দাহ্য পদার্থ বা কেমিকেল থাকলেও তা জানিয়ে রাখতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে। আমরা সেখানে অনেক কেমিকেলের উপস্থিতি পাচ্ছি। বিভিন্ন ধরনের কেমিকেলের অনেক ড্রাম রয়েছে সেখানে। তাদের ফায়ার লাইসেন্স আছে কী না আমরা তদন্ত করে দেখছি। তবে আমাদের তারা কেমিকেলের তথ্য জানায়নি এটা নিশ্চিত। এখন আমরা ড্রোন ব্যবহার করে কেমিকেল চিহ্নিত করছি। ফোম ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছেন, কারণ ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল, সেটা ডিপোর কেউ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের জানায়নি। রাসায়নিক থাকার কথা জানতে পারলে আমরা হয়ত অন্যভাবে এগোতাম; আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম, ফোম ব্যবহার করতে পারতাম।’

চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, রপ্তানির জন্য ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিলো। এখান থেকে অনেক দিন ধরেই এটা রপ্তানি হচ্ছে। এটা তারা ডিক্লারেশন দিয়েই রপ্তানি করে। তবে এর বাইরে আর কোনো কেমিকেল এখানো রাখা ছিলো কী না তা আমাদের জানানো হয়নি। তিনি বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কোনো দাহ্য পদার্থ বা বিস্ফোরক নয়। তবে যেকোনো জিনিসেই আগুন লাগতে পারে। কেউ আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। আমি শুনেছি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড-এর পাফে স্টাপল ফাইবারের একটি কনটেইনার ছিলো। সেকারণেও আগুন ছড়াতে পারে। অটোমেটিক কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি। সেটা হলে জাহাজেও তো বিস্ফোরণ ঘটত।’

এদিকে চট্টগ্রামের স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যাল লিমিটেড। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার ফতেয়াবাদ ঠাণ্ডাছড়ি এলাকায় অবস্থিত কারখানাটিতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উৎপাদন করা হয়, যা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। কারখানা থেকে রপ্তানির জন্য এ দাহ্য পদার্থ তাদের আরেকটি প্রতিষ্ঠান বিএম ডিপোতে এনে রাখা হয়। এ ছাড়া কারখানাটি সোডিয়াম সালফেট, সরবিটল, কস্টিক সোডা প্রিলসও উৎপাদন করে থাকে। এসব রাসায়নিক দ্রব্যও বিএম ডিপোতে মজুত থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

বিস্ফোরক অধিদপ্তরের উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আবদুল হান্নান বলেন, ‘যে ৫৪টি দাহ্য পদার্থের তালিকা আছে তার মধ্যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নেই। এটি কোনো বিস্ফোরক বা দাহ্য পদার্থ নয়। এ কারণে এটা আমদানি বা রপ্তানিতে আমাদের অনুমোদন লাগে না। অন্য কোনো বিস্ফোরক বা কেমিকেল সেখানে থাকতে পারে। আগুন ও বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় তাই মনে হচ্ছে। সেটা তদন্ত করে দেখা দরকার।’

এদিকে কনটেইনার ডিপো স্থাপনের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয় এবং পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মূল লাইসেন্স দিয়ে থাকে। তবে দাহ্য জাতীয় বা রাসায়নিক উপাদানের ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের ছাড়পত্র নিতে হয়।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরক এনে রাখা হলেও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কোনো লাইসেন্স ছিল না। লাইসেন্স ছাড়া কীভাবে বিস্ম্ফোরক মজুত করে রাখলেন- তার কোনো সদুত্তর নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন জানান, বিএম কন্টেইনার ডিপোর রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার কোনো অনুমতি নেই। সেখানে দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ বা মজুদের কোনো নিয়ম না মানার কারণেই হয়ত ভয়ানক এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তার ধারণা।

ঘটনাস্থলে থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের জার পাওয়ার বিষয়ে পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন পরিদর্শক বলেন, ‘এটি একপ্রকার রাসায়নিক যা আগুন বাড়াতে সাহায্য করে। এতে কিন্তু বিস্ফোরণ হওয়ার কথা নয়। তদন্ত শেষে জানা যাবে কি কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে।’ তিনি বলেন, কনটেইনার ওঠানামার জন্যই এ ডিপো। সেখানে রাসায়নিক উপাদান সংরক্ষণ করবে কেন? এখনো পর্যন্ত দুর্ঘটনার উৎপত্তিস্থলের কাছে আমরা কেউ যেতে পারিনি। সেকারণে নিশ্চিত নই কোথা থেকে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এখানে কেমিকেল থেকে আগুন লেগেছে যেমন সত্য, তেমনি দাহ্য পদার্থও ছিল। না হলে বিস্ফোরণ কেন হবে? তবে কি ধরনের দাহ্য পদার্থ তা এখনও জানি না। তাদের রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার কোনো অনুমতি নেই। আমরা এখানে এসে প্রথম জানলাম ডিপোতে রাসায়নিক রাখা ছিল।’

স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম জানান, বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনার সংবাদ পেয়ে সেখানে যান তিনি। গিয়ে দেখেন মালিক পক্ষের কেউ নাই। সবাই পালিয়েছে। তিনি বলেন, ‘সেখানে আমি অনেক কনটেইনারে তরল কেমিকেল দেখেছি। বিস্ফোরণে কয়েক মাইল এলাকা কেঁপে উঠেছে। অনেক দূরে গিয়েও আঘাত করেছে বিস্ফোরিত কনটেইনারের বিভিন্ন অংশ। ওখানে কেমিকেল, গার্মেন্টস পণ্য সব একসাথে ছিলো। দাহ্য পদার্থের আলাদা কোনো ব্যবস্থাপনা ছিলো না। অগ্নি নিরাপত্তা বলে কিছু ছিলো না।’ ঘটনাস্থলে গিয়ে সংসদ সদস্য দিদারুল আলম আরও বলেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে রাসায়নিক ডিপো করা হয়েছে, তা তদন্ত করা উচিত।’

মালিকরা পালিয়ে গেলেও ডিপোর মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চিটাগং ডেনিম-এর জিএম মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী রোববার বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, ‘ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিলো এটা নিশ্চিত। অন্য কোনো কেমিকেল ছিলো কী না তা বলতে পারছি না। ডিপোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কনটেইনার ছিলো। এর মধ্যে ৯০ ভাগই গার্মেন্টস পণ্য। কাজ করছিলো ৫৫০ জনের মত কর্মী।’ মলিকপক্ষের লোকজনকে কেন ঘটনাস্থলে পাওয়া যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা ভয় পেয়েছেন, তাই প্রকাশ্যে আসছেন না।’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যবহৃত কনটেইনারের ব্যবস্থাপনা ও খালি কনটেইনারের সংরক্ষণ করা হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুটি প্রতিষ্ঠানের ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে চালু হয়েছিল এটা। যৌথ বিনিয়োগের এই ডিপোতে বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপের অংশীদারি রয়েছে। যে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের রাসায়নিক পদার্থ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, সেটিও স্মার্ট গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের। পোশাক, এলপিজি ও খাদ্যপণ্য খাতে বিনিয়োগ রয়েছে স্মার্ট গ্রুপের। কনটেইনার ডিপো মালিক সমিতির মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, এখানে গড়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী দেড় হাজার এককের বেশি কনটেইনার থাকে।

এই কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিএম কনটেইনার ডিপোর চেয়ারম্যান বার্ট প্রঙ্ক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান। পরিচালক হলেন স্মার্ট জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। মুজিবুর সম্পর্কে মোস্তাফিজুরের ভাই। মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে আছেন। বিগত সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। তবে পাননি।

এদিকে দেশের শিল্প খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন, পরিবহন ও গুদামজাতকরণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বিধি বিধান না থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের মতো করেই নিরাপত্তা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।
যদিও বিস্ফোরক অধিদপ্তর বলছে তারা যেসব প্রতিষ্ঠানকে আমদানির জন্য লাইসেন্স দেয় তাদের একটি গাইডলাইন দেওয়া হয় এবং কখনো কখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষণাগারগুলো তারা পরিদর্শনও করে থাকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে কিংবা কোথায় কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে সে সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি বিধান না থাকায় প্রায়শই ছোটো বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।

বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলছেন, সবার জন্য প্রযোজ্য হবে এমন কোন বিধি বিধান বা গাইডলাইন রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষেত্রে নেই, বরং বিভিন্ন জায়গার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। প্রত্যেকটি কেমিক্যালের সাথেই একটি গাইডলাইন সাঁটানো থাকা দরকার যে এটিকে কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে, কোথায় কিভাবে রাখতে হবে। কিন্তু এগুলো নিশ্চিত করার কোন প্রক্রিয়া বা নির্দিষ্ট কোন নিয়ম কানুন নেই। অর্থাৎ এগুলো আসলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে ঠিক করে। অপর্যাপ্ত লোকবল নিয়ে সেগুলো মাঝে মধ্যে যাচাই করে বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা এ ধরনের আরও কিছু প্রতিষ্ঠান।

বিস্ফোরক অধিদপ্তরের উপপ্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আব্দুল হান্নান বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো কেমিক্যাল আমদানি করে নিজেদের গুদামে রাখে এবং তারাও মাঝে মধ্যে এ ধরনের গুদাম পরিদর্শন করেন। সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন না থাকলেও লাইসেন্স দেয়ার সময় ও পণ্য আমদানির সময় আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গাইডলাইন দিয়ে থাকি কোথায় কিভাবে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন বলেন, ‘যেকোনো ধরনের রাসায়নিক সংরক্ষণ বা পরিবহনের জন্য আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত গাইডলাইন রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করতে হয়। কোনো রাসায়নিক ক্রয় বা পরিবহনের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। রাসায়নিক পদার্থ ওয়েল ভেনটিলেটেড থাকতে হবে, নির্দিষ্ট জায়গায় নির্ধারিত তাপমাত্রায় রাখতে হবে। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড অন্য দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। সুতরাং ওই ডিপোতে অন্য দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি থাকতে পারে।’