মিথ্যা তথ্যে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীকেই ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন বাসেত মজুমদার

শরীফুল রুকন : হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী কুদ্দুসকে পুলিশ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেন হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বাসেত মজুমদার। এ নিয়ে আদালতের ভৎসনা শুনেছেন ক্ষমতাসীন দলটির উপদেষ্টা পরিষদের এই সদস্য। যে কুদ্দুসকে নিয়ে নজিরবিহীন এই ঘটনা তার আমলনামা জানতে গিয়ে একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর অপরাধের তথ্য।

জানা যায়, আবদুল কুদ্দুস প্রকাশ কানা কুদ্দুস উঠতি বয়সেই জড়িয়ে যান অপরাধে। ১৮ না পেরোতে হয়ে উঠেন বোমা তৈরির কারিগর। একদিন বোমা তৈরি করার সময় ঘটে ভয়ংকর বিস্ফোরণ। সেদিন ডান চোখ হারিয়েছিলেন আব্দুল কুদ্দুস। তারপর থেকেই নাম হয়ে যায় ‘কানা কুদ্দুস’। চট্টগ্রামের অপরাধ অঙ্গনের খবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

আব্দুল কুদ্দুস প্রকাশ কানা কুদ্দুসের মৃত বাবা রুস্তম আলী ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানের পিয়ন। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে কুদ্দুস সবার ছোট। পরিবারের অন্যরা নানা পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করলেও কুদ্দুসের আয়ের পথটা ভিন্ন। ছোট থেকেই ডানপিটে কুদ্দুস জড়িয়ে পড়েন অপরাধে।

১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম নগরের আসকার দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে রাস্তার পাশে একটি ঘরে বোমা বানাচ্ছিলেন কুদ্দুস। সাথে ছিলেন লাতু দাশ, সাত্তারসহ আরও কয়েকজন। একপর্যায়ে ঘরে বিস্ফোরণ হলে আহত হন কুদ্দুস, লাতু ও সাত্তার। সেসময় গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন তারা। তবে ওই দুর্ঘটনায় সারাজীবনের জন্য দু’চোখ হারান লাতু। নষ্ট হয়ে যায় কুদ্দুসের ডান চোখ। তবে কুদ্দুসের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, কুদ্দুস বোমা বানাতেন না। লাতু ও সাত্তার বোমা তৈরি ও সরবরাহের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাদের সাথে ঘটনাস্থলে গেলে অসতর্কতাবশত দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

এদিকে সুস্থ হয়ে কুদ্দুস জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে। সে সময় কুদ্দুস বসবাস করতেন লালখান বাজার এলাকায়। ১৯৯১ সালে ওই এলাকায় বিএনপি নেতা তালেব আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে কুদ্দুসের বিরুদ্ধে। এরপর হত্যা মামলার আসামি কুদ্দুসকে লালখান বাজার ছাড়তে বাধ্য করেন স্থানীয়রা।

বিতাড়িত কুদ্দুস নতুন বসতি গড়েন বায়েজিদের শেরশাহ এলাকায়। সেসময় যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসী বিপুল সাহার আশ্রয় লাভ করেন কুদ্দুস। পরবর্তীতে হারুণ নামে বিপুল সাহার এক বন্ধুকে মারধর ও ছুরিকাঘাত করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হারুন। এ ঘটনায় বিপুলের পাশাপাশি কুদ্দুসও যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠে।

২০০২ সালে বায়েজিদের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মো. মিজানকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করার অভিযোগ উঠে কুদ্দুসের বিরুদ্ধে। এতে বাম হাত নষ্ট হয়ে যায় শেরশাহ ফকিরপাড়ার বাসিন্দা মিজানের; তিনি বলেন, ‘আমরা আখতারুজ্জামান বাবু ভাইয়ের অনুসারী ছিলাম। আর কুদ্দুস ছিল নাছির ভাইয়ের অনুসারী। কুদ্দুসের কথামত না চলায় আমার উপর হামলা হয়। এ ঘটনায় মামলা করলেও পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তা শেষ করে দিয়েছে।’

বায়েজিদ এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, ডাকাতি-ছিনতাই, ভূমি দখল, মাদক ব্যবসাসহ অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ আছে কুদ্দুসের বিরুদ্ধে। তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বায়েজিদের আরেক সন্ত্রাসী মেহেদী হাসান বাদল। আধিপত্য নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জেরে ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর খুন হন মেহেদী হাসান বাদল। এ ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় আসামি হন ৪৩ বছর বয়সী কুদ্দুস।

সর্বশেষ গত ১০ এপ্রিল আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কুদ্দুসের অনুসারীদের হামলায় আহত হন বায়েজিদের আওয়ামী লীগ নেতা নাজিম উদ্দিন ও তার দুই বন্ধু। সেদিনের ঘটনার পর মামলায় কুদ্দুসের নাম লেখা হয়- ‘কসাই কুদ্দুস’!

নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘সেদিন আমাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে চায় সে (কুদ্দুস)। দুই হাত দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছি। তাই জানে বেঁচে গেলাম। সেদিন বাম হাতে ১৩টি ও ডান হাতে ১৭টি কোপ লেগেছিল। সব সে একাই মেরেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ডান হাত তো নষ্ট হয়ে গেছে, একটা আঙুল নেই। ডান চোখও নষ্ট হয়েছে। সেদিন আমাকে সহযোগিতা করতে দুই বন্ধু এসেছিল। তাদেরকেও কুপিয়েছে। ফজল আমিনের মাথায়, টিটুর মুখে পড়েছে কোপ। কুদ্দুস কারাগারে যাওয়ায় এলাকায় আপাতত স্বস্তি নেমে এসেছে।’

এদিকে নাজিমের উপর হামলার ঘটনার আগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বায়েজিদ বোস্তামী থানায় চারজনের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আব্দুল কুদ্দুস। এতে তিনি উল্লেখ করেন- তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন দিদার, মো. মহিউদ্দীন, নাজিম উদ্দিন ও এমদাদ।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘গত ১২ এপ্রিল কুদ্দুসসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়। ৬ জুন হাইকোর্টে গিয়ে এ মামলায় জামিন চাইলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ নানা অভিযোগে ৮টি মামলা আছে। সে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী।’

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একসময় এক গ্রুপে থেকে বায়েজিদের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতো কুদ্দুস, সফি ও মেহেদী। পরে স্বার্থের জন্য তারা পৃথক হয়ে যায়। অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নিতে মেহেদীকে খুন করে প্রতিপক্ষরা। কিন্তু নাজিম, মহিউদ্দীন ও এমদাদের কারণে তারা মাঠ দখলে নিতে পারছে না। কয়েকজন রাজনীতিক এসব খারাপ লোকদের আশ্রয় দিচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি চট্টগ্রামের আবদুল কুদ্দুস প্রকাশ কানা কুদ্দুসকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ হওয়ার পর পুলিশকে বিভ্রান্ত করে ছাড়িয়ে নিয়ে মঙ্গলবার আদালতের ভৎসনা শুনতে হয় বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদারকে।

শুধু তাই নয়, হাইকোর্টে এই ঘটনার পর আদালতের নির্দেশে এজলাসে আটকে থাকতে হয়েছিল বাসেত মজুমদারকে; ক্ষমা চেয়ে সেই আসামিকে পুনরায় ফেরত এনে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পর ছাড়া পান জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুসকে ছাড়িয়ে নিতে এই কাণ্ড ঘটান ক্ষমতাসীন দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বাসেত মজুমদার। বায়েজিদ বোস্তামী থানার একটি হত্যাচেষ্টার মামলার আসামি কুদ্দুস আগাম জামিনের আবেদন নিয়ে মঙ্গলবার বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি এ এন এম বশির উল্লাহর বেঞ্চে এসেছিলেন।

কিন্তু আদালত সেই আবেদন নাকচ করে কুদ্দুসকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। এজলাসের বাইরে পুলিশ কুদ্দুসকে আটক করে কারাগারে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ার সময় বাসেত মজুমদার পুলিশকে আদালতের আদেশের ভুল ব্যাখ্যা দেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

ওই আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ এ কে এম মনিরুজ্জামান কবির সাংবাদিকদের বলেন, বাসেত মজুমদার পুলিশকে ‘বিভ্রান্ত করে’ আসামিকে ছাড়িয়ে নেন এবং আদালত চত্বর ত্যাগ করতে বলেন।