রানা আবির : ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম নগরের নেছারিয়া কামিল (এমএ) মাদ্রাসা কেন্দ্রে কামিল শ্রেণীর ২য় পর্বের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন খাদিজাতুল কোবরা; অথচ ওই পরীক্ষাকেন্দ্রের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রফিকুদ্দীন।
শুধু তাই নয়, নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন এলাকায় অবস্থিত নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ‘জুবাইদা আরব মহিলা মাদ্রাসা’ নামে পৃথক আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন মুহাম্মদ রফিকুদ্দীন। আর ওই মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষিকা হিসেবে নিজের মেয়ে খাদিজাতুল কোবরাকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।
মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি একুশে পত্রিকাকে অভিযোগ করে জানিয়েছেন, গত ১২ মে থেকে শুরু হয়ে ২৯ মে পর্যন্ত চলা কামিল শ্রেণীর দ্বিতীয় পর্বের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর খাদিজাতুল কোবরা দেখে দেখে লিখেছেন। বাবা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, মেয়ে শিক্ষক- এ কারণে কেউ বাধাও দিতে পারেননি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রফিকুদ্দীন একুশে পত্রিকার কাছে দাবি করেন, তার মেয়ে খাদিজাতুল কোবরা এবার কামিল পরীক্ষা দেয়নি। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে একটি কুচক্রি মহল তাকে ফাঁসানোর পাঁয়তারা করছে।
যদিও যাছাই করে রফিকুদ্দীনের উক্ত দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি; তার মেয়ে খাদিজাতুল কোবরা কামিলের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। তার রোল নাম্বার ১৮৩০০৯৫৩৫।
অধ্যক্ষ রফিকুদ্দীনের বিরুদ্ধে শুধু এই অভিযােগই নয়, মাদ্রাসার কর্মচারীদের মারধর, অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া, কথায়-কথায় শিক্ষকদের চাকরি থেকে বরখাস্ত, পরিচালনা পরিষদের অনুমতি ছাড়া মাদ্রাসার স্থানে অন্য নামে প্রতিষ্ঠান স্থাপন ছাড়াও আরও নানা অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ গত শনিবার (২৮ মে) দুপুরে মাওলানা ফয়েজুল্লাহ নামে মাদ্রাসা হোস্টেলের এক অফিস সহকারিকে মারধর করার অভিযোগ উঠে অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রফিকুদ্দীন ও তার সহযোগি আকরুজ্জামান নামে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। আহত ওই ব্যক্তি বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড়তলী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘খবর পেয়ে আহত অবস্থায় একজনকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আহত ওই ব্যক্তি থানায় অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জানা যায়, ১৯৭৮ সালে নেছারিয়া কামিল (এমএ) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মাদ্রাসায় ইবতেদায়ী থেকে কামিল পর্যন্ত উভয় শ্রেণির (ছাত্র-ছাত্রী) শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ফাজিল ও কামিল শ্রেণীতে তাফসীর বিভাগ, আল হাদিস বিভাগ ও আল ফিকহ বিভাগ নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। সম্প্রতি মাদ্রাসার একই বাউন্ডারিতে চালু কার হয় ‘জুবাইদা আরব মহিলা মাদ্রাসা’ নামে পৃথক একটি প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে গভর্নিং বডির সদস্যদের সঙ্গে অধ্যক্ষের বিরোধ দেখা দেয়।
গভর্নিং বডির সদস্যদের দাবি, একই মাদ্রাসার ভেতরে ভিন্ন নামের প্রতিষ্ঠান করতে হলে পরিচালনা পর্ষদের অনুমতির প্রয়োজন। কিন্তু এ ধরণের কোন বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করেননি অধ্যক্ষ। এছাড়া মহিলা মাদ্রাসার নির্মাণ কাজে নেছারিয়া মাদ্রাসা ফান্ডের প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। এসব খরচের বিষয়েও কোন ধরণের নিয়ম-কানুন মানেননি অধ্যক্ষ রফিকুদ্দীন।
নেছারিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হয়েও মহিলা মাদ্রাসায় পাঁচজন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন রফিকুদ্দীন। যেখানে তিনজন নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যক্ষের আত্মীয়। এরা হলেন- অধ্যক্ষের মেয়ে খাদিজাতুল কোবরা, ছেলের বৌ সায়মা জাহান ও খাদিজাতুল কোবরার ননদ (অধ্যক্ষের মেয়ের ননদ) শান্তা আক্তার চৌধুরী। অপরদিকে একরামুল হক নামে অধ্যক্ষের ভাগিনাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে লাইব্রেরি সহকারি হিসেবে। এসব বিষয়ে অভিযোগ তুললেই সংশ্লিষ্টদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। করা হয় চাকরিচ্যুত।
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরে মাদ্রাসার সাবেক বিদ্যোৎসাহী সদস্য মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অধ্যক্ষের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দিতে নেছারিয়া মাদ্রাসার বাউন্ডারির ভেতর জুবাইদা আরব মহিলা মাদ্রাসা নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। অথচ নেছারিয়ায় ছাত্র-ছাত্রী উভয়ই পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া এ ধরণের পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অধ্যক্ষ এসবের কোন কিছুর ধার ধারেননি। কেবল তাই নয়, মাদ্রাসার প্রবীণ শিক্ষক মাওলানা শরীফ মোহাম্মদ সোলায়মান ও শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ মোস্তফাকে বের করে দিয়েছেন তিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন অধ্যক্ষ দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হতে পারেন না। কিন্তু তিনি (অধ্যক্ষ) নিয়মের তোয়াক্কা না করে মাদ্রাসার ভেতর মাদ্রাসা পরিচালনা করে আসছেন। একজন মাওলানা হয়েও সব সময় শিক্ষকদের গালাগালি ও শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করেন তিনি। এজন্য মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষক আকতারুজ্জমান ও সহকারি মৌলভী আশরাফুল আলমকে নিয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন তিনি। অধ্যক্ষের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মাদ্রাসার সহকারি গ্রন্থাগারিক মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি সাইফুল। এছাড়া কথায়-কথায় থানা পুলিশের ভয় দেখান তিনি। আমি মাদ্রাসা পরিচালনার কমিটির সদস্য হয়েও ওনার হাত থেকে রেহাই পাইনি। আমার বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা অভিযোগে জিডি করেছেন অধ্যক্ষ রফিকুদ্দীন।’
একই কমিটির বিদ্যোৎসাহী সদস্য নিয়াজ আহমেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বিধিভঙ্গ করে নেছারিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রেই কামিল পরীক্ষা দিচ্ছেন অধ্যক্ষের মেয়ে ও মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক খাদিজাতুল কোবরা। যেখানে ওই পরীক্ষার্থী দেখে দেখে প্রশ্নোত্তর দিলেও বাধা দেওয়ার কেউ নেই। কারণ কেন্দ্রের হল সচিব পরীক্ষার্থীর বাবা। নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষাকালীন সময় তিনি অধক্ষের দায়িত্ব থেকে সরে থাকার কথা। অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ আত্মসাৎ করে আসছেন মুহাম্মদ রফিকুদ্দীন। এ কারণে মাদ্রাসার অডিট করানো হয় মেয়ের জামাই সাজ্জাদ উদ্দিন চৌধুরীকে দিয়ে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে নেছারিয়া কামিল (এমএ) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রফিকুদ্দীন বলেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মাদ্রাসার উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। প্রত্যেকটি কার্যক্রম বিধি মোতাবেক করা হয়েছে। আমার আত্মীয়রা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েই এখানে শিক্ষকতা করছেন। আমি কারও গায়ে হাত তুলিনি। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাকে ফাঁসানোর পাঁয়তারা করছে একটি কুচক্রি মহল। আপনি অফিসে আসুন। আপনার জন্য কী করতে পারি দেখি।’