জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা যুবলীগের নিজস্ব কার্যালয় নেই। আওয়ামী লীগের জরাজীর্ণ, সংকীর্ণ কার্যালয়ে বসেই ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড’ পরিচালনা করে আসছেন চট্টগ্রামের যুবলীগ নেতারা।
সবশেষ ২০১৩ সালে মহিউদ্দিন বাচ্চুকে আহ্বায়ক এবং দেলোয়ার হোসেন খোকা, দিদারুল আলম, ফরিদ মাহমুদ ও মাহবুবুল হক সুমনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে তিন মাসের জন্য ১০১ সদস্যের মহানগর যুবলীগের কমিটি করা হয়েছিল। এরপর পেরিয়ে গেছে ৯ বছর।
অপরদিকে এস এম আল মামুনকে সভাপতি এবং এস এম রাশেদুল আলমকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১২ সালে উত্তর জেলা যুবলীগের কমিটিও কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। উত্তর জেলা ৭টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিতে কমিটি আছে বলে জানান সাধারণ সম্পাদক।
দক্ষিণ জেলায় আ ম ম টিপু সুলতান চৌধুরীকে সভাপতি ও পার্থ সারথী চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে সবশেষ কমিটি ২০১০ সালে কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল।
এত বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে এলেও তারা সংগঠনের জন্য একটি নিজস্ব কার্যালয় করতে পারেননি। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, এত বছর ধরে চট্টগ্রামের যুবলীগ নেতারা করেছেনটা কী?
যদিও অভিযোগ আছে, চট্টগ্রামে যুবলীগের উক্ত তিনটি ইউনিটের বেশিরভাগ নেতাই গত ১০ বছরে নিজেদের পকেট ভারী করতে ব্যস্ত ছিলেন। দলীয় কার্যক্রম কিংবা সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধির চেয়ে পদ-পদবি দিতে-নিতেই তাদের আগ্রহ বেশি ছিল। কারণ সেই পদকে পুঁজি করে নানা ধরনের সুবিধা ভোগ করা যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ ১৩ বছর দলে দল ক্ষমতা থাকায় নানাভাবে লাভবান হয়েছেন চট্টগ্রামে যুবলীগ নেতারা। যুবলীগের রাজনীতি করে অনেক নেতার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। যুবলীগের পদবি ব্যবহার করে কেউ কেউ হয়েছেন জনপ্রতিনিধি। কেউ কেউ বুঝে নিয়েছেন উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি। যুবলীগের কিছু নেতার বিরুদ্ধে রীতিমতো পদবির প্রভাব খাটিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও আছে।
প্রশ্ন উঠেছে, যুবলীগের পদ ব্যবহার করে যারা এতো সুবিধা নিয়েছেন, পকেট ভারী করেছেন, তারা কেন এতো বছরেও স্রেফ ভাড়া নিয়ে হলেও দলীয় কার্যালয়ের ব্যবস্থা করতে পারেননি?
সম্মেলন উপলক্ষে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় (১১২, আন্দরকিল্লা) থেকে। টিনের ছাউনি, বেড়া দিয়ে তৈরি জরাজীর্ণ ওই কার্যালয়টিতেই কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নাঈম ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুর রহমান সোহাগকে নিয়ে বীরদর্পে প্রস্তুতি সভাও করেছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ জেলা যুবলীগের পদপ্রত্যাশী একজন নেতা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘একটা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে কার্যালয় জরুরি। কিন্তু নেতারা তো তা মনে করছেন না। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের জরাজীর্ণ কার্যালয় আছে, টিনের বেড়া দিয়ে করা, সেটার উপরেই যত অত্যাচার। দক্ষিণ জেলা যুবলীগের নিজেদের একটা টেবিলই নেই, তারা দলের জন্য কী করবে? আর কী করেছে?’
সংগঠনের কার্যালয় না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথি চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের সম্মেলনের আগেই কার্যালয় নিয়ে আপনার প্রশ্ন জাগছে? আমাকে সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন করুন।’
এদিকে উত্তর জেলা যুবলীগের বর্তমান কমিটির নেতারা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সকল কার্যক্রম, এমনকি আসন্ন (২৯ মে) সম্মেলন উপলক্ষে প্রস্তুতি সভাও করা হয়েছে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ছোট্ট কার্যালয়ে (নিউমার্কেট এলাকার দোস্ত বিল্ডিং)। সেখানে অন্যান্য সংগঠনের সাথে অনেকটা সমঝোতায় নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনার করতে হচ্ছে উত্তরের যুবলীগের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উত্তর জেলা যুবলীগের পদপ্রত্যাশী একজন নেতা বলেন, ‘সংগঠন নামে আছে, কাজে নেই। বর্ধিতসভা করা ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম নেই উত্তর জেলা যুবলীগের। জাতীয় দিবসেও তারা কোন অনুষ্ঠান করে না। তাই কার্যালয়ের প্রয়োজন তাদের পড়ে না। নিজেদের আখের গোছাতেই তারা বেশি ব্যস্ত। দলের জন্য কিছু না করেই এখনো অনেকেই আবার পদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।’
জানতে চাইলে উত্তর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের নিজস্ব কার্যালয় আমরা করতে পারিনি। এটা নিয়ে অনেকের কষ্টও আছে। আমাদের মূল দল আওয়ামী লীগের সাথে সমন্বয় করে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আমাদের সিনিয়র নেতারাও যদি বিষয়টাতে আগ্রহী হয় তাহলে ফলপ্রসূ সমাধান আসবে বলে মনে করি। ভবিষ্যতে যদি সভাপতি হিসেবে সুযোগ পাই তাহলে এই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করবো।’
অপরদিকে দ্বন্দ্বের জেরে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি আলাদাভাবে পালন করেছে মহানগর যুবলীগের দুই গ্রুপ। তাদের নেই নিজস্ব কোনো কার্যালয়। মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়কেই (নগরীর জুবিলী রোডে অবস্থিত দারুল ফজল মার্কেট) এখন পর্যন্ত ব্যবহার করে আসছে তারা। যদিও কারা এই কার্যালয়ে সভা-সমাবেশ করবে এই দ্বন্দ্বে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসেও কোনো কর্মসূচি পালন করেনি আহ্বায়ক কমিটি! সেই কমিটির দুই যুগ্ম-আহ্বায়ক (মাহবুবুল হক সুমন ও দিদারুল আলম দিদার) আসন্ন সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী হয়েছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের পদপ্রত্যাশী একজন নেতা বলেন, ‘এতো বছর দায়িত্বে থেকেও মহানগর যুবলীগের শীর্ষ নেতারা একটা কার্যালয়ের ব্যবস্থা করতে পারেননি। এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে? আমরা যারা রাজনীতি করি, এটা আমাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। চাইলে একটা কার্যালয় করতে পারতো। প্রয়োজনে একটা অস্থায়ী কার্যালয় করতে পারতো। মানুষ চাইলেই অনেক কিছু করতে পারে। তাদের ইচ্ছা ছিল না বলে তারা করতে পারেনি৷’
এ প্রসঙ্গে মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুল হক সুমন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দলীয় কার্যালয় থাকলে সংগঠনের কার্যক্রম আরও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা যায়। একটা আলাদা কার্যালয় হলে আরও বেশি মানুষকে সম্পৃক্ত করা যেত। আমরা এটা নিয়ে ভাবছি। আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে আলোচনা-পরামর্শ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আমি আগামী কমিটিতে সভাপতি হলে নিজস্ব কার্যালয় করতে চেষ্টা করবো।’