একাধিকবার এমপি হয়েও দল-সরকারের ‘বোঝা’, কপাল পুড়বে তাদের


একুশে প্রতিবেদক : কেউ আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনবার, কেউবা দুবার, আবার কেউ একবার– এমপি হয়েও সরকার ও দলের জন্য সম্পদ কিংবা অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারেননি; বরং ‘বোঝা’ হয়েছেন। আবার কেউ কেউ হয়েছেন ভাবমূর্তি বিনষ্টের কারণ। চট্টগ্রামের এমন অন্তত ৫ জন এমপির কপাল পুড়তে যাচ্ছে আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

সরকারি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে। দেশের দুটি গোয়েন্দা সংস্থার অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণেও এই পাঁচ এমপির ব্যাপারে সুখকর কোনো তথ্য নেই। গত বুধবার সন্ধ্যায় এক আলোচনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও একুশে পত্রিকার পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের সাথে একমত পোষণ করেছেন। যোগ করেছেন আরও নতুন তথ্য।

আর ওই পাঁচ এমপি হলেন– চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের তিনবারের এমপি এম এ লতিফ, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ আংশিক) আসনের এমপি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের তিনবারের এমপি ও সরকার দলীয় হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগড়া) আসনের দুবারের এমপি ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী, চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের দুবারের এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী।

এই পাঁচ এমপির মধ্যে চারজনই অন্য দল ও মতাদর্শ থেকে আসা। কেবল মোছলেম উদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগ করা মানুষ। মোছলেম উদ্দিনের আছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। একসময়ের তুুুখোড় ছাত্রনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করা লোক তিনি। এরপরও মাত্র সাড়ে ৩ বছরের এমপি প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মোছলেম উদ্দিনের কেন কপাল পুড়ছে তার আলোচনা থাকবে এই প্রতিবেদনে।

প্রথমে আসা যাক, চট্টগ্রাম-১১ আসনের এমপি এম এ লতিফ প্রসঙ্গে। স্মর্তব্য যে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে প্রথমে তিনি মনোনয়ন চেয়েছিলেন বিএনপি থেকে। সেখান থেকে বিফল মনোরথে ফিরে এসে শেষমেশ উপমহাদেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে জোয়ারে এমপি হয়ে যান। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা খোরশেদ আলম সুজনকে দেওয়া মনোনয়নের চিঠিখানা রাতারাতি নিজের হস্তগত করার কী যাদুকরী কৌশল এম এ লতিফের ছিল তা কারও অজানা নয়।

এরপর ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় দ্বিতীয় ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো এমপি হন লতিফ। জীবনে কখনো আওয়ামী লীগ করা দূরের কথা; বরঞ্চ জামায়াত ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আজন্ম সখ্যতার পরও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি হিসেবে ব্যবসায়ী কোটায় ২০০৮ সালে প্রথমবার মনোনয়ন পান। নেতা নির্বাচন থেকে শুরু করে, চেম্বারে নেতার সংযোজন-বিয়োজনসহ বরাবরই ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম চেম্বারের নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার কারণ ছাড়াও বিশেষ জায়গায় ‘কনভিন্স’ করতে পারার সক্ষমতা থেকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও মনোনয়ন পান এম এ লতিফ।

আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী মহল ও গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণ বলছে, টানা প্রায় ১৩ বছর সরকার দলীয় এমপি হয়ে দেশে-বিদেশে নিজেকে গুছিয়ে নিলেও পক্ষান্তরে দলের জন্য ‘অ্যাসেট’ হওয়ার পরিবর্তে বরং ‘বোঝা’ হয়েছেন এম এ লতিফ। বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতি, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিবাদে জড়ানোসহ নানা ঘটন-অঘটনে বিতর্কিত হয়েছেন এমপি লতিফ। বারে বারে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন দলের ভাবমূর্তি।

রাজনীতি সচেতনরা বলছেন, গত ১৩ বছরে সরকারের আপনাআপনি উন্নয়ন বরাদ্দ ছাড়া চট্টগ্রাম-১১ আসনের জনগণের জন্য লতিফের উন্নয়ন-কর্মসূচি ছিল ট্রাকে নিজের ছবি সম্বলিত ব্যানার টাঙিয়ে বন্দর-পতেঙ্গা এলাকার মানুষের জন্য ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি, ওই এলাকার নারীদের নিয়ে আত্মনির্ভরশীলতার কথা বলে সংগঠন করে মাঝে মাঝে বড়সড় কয়েকটি অনুষ্ঠান-শোডাউন– ব্যস এটুকুন।

লক্ষণীয় যে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৃতীয় দফায় এমপি হওয়ার পর অনেকটা গা-ছাড়া ভাব এমপি লতিফের। গত সাড়ে ৩ বছরে অনেকটা নিশ্চুপ, নিষ্প্রাণ তিনি। নিজের অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে টুকটাক কর্মসূচিগুলো থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন তৃতীয় মেয়াদের দায়িত্বে। করোনা মহামারির সময় তার তেমন কোনো ভূমিকা না থাকার বিষয়টিও চোখে পড়েছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে।

গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলছেন, তিনবার এমপি হয়ে যাওয়ার পর তিনি হয়তো ভাবছেন একজনমে সবই তো পেয়ে গেছেন, আর সরব-সক্রিয় থেকে লাভ কী। তাছাড়া তিনি তো কখনোই সক্রিয় ছিলেন না। এলাকার উন্নয়ন ও এলাকার মানুষকে নিয়ে ভাবার চেয়ে নিজেকে গুছিয়েছেন, নিজেকে নিয়ে ভেবেছেন সবচেয়ে বেশি। এই বিষয়গুলোয় আমরা প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।-যোগ করেন দায়িত্বশীল ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী ও বিশ্বস্থ সূত্রমতে, এম এ লতিফের ‘টোটাল’ আমলনামা গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হবে আগামি নির্বাচনে। কারণ আগামি নির্বাচন হবে অনেকটা চ্যালেঞ্জের। কাজেই চট্টগ্রামের বন্দর-পতেঙ্গা আসনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম এমন প্রার্থীই বাছাই করবে দলের হাইকমান্ড।

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগড়া) আসনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদের এমপি জামায়াত ঘরানার মানুষ প্রফেসর আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। চট্টগ্রামের মিনি পাকিস্তান, আফগানিস্তান খ্যাত সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় ‘৭৩ এর পর আওয়ামী লীগের কেউ জিততে পারেননি। বলা চলে প্রায় সময় এখানে জামায়াতের আধিপত্য ছিল। মাঝে একবার ১৯৯৬ সালে বিএনপির টিকেটে নিজের ভাবমূর্তিকে পুঁজি করে চন্দনাইশের পাশাপাশি এখানে জয়লাভ করেছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী বর্তমানে এলডিপি প্রধান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম। সেবারই প্রথম জামায়াত প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীর সাথে আওয়ামী লীগের তরুণতম প্রার্থী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য পদ ছেড়ে আসা মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর ভোটের ব্যবধান ছিল প্রায় ৬ হাজার। অথচ ১৯৯১, ২০০১ ও ২০০৮ সালে বিজয়ী জামায়াত প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল যথাক্রমে ২১ হাজার, ৫৭ হাজার ও ৭১ হাজার।

সাতকানিয়া-লোহাগাড়া যেহেতু বিএনপি-জামায়াতের আসন, তাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে- সেই ফর্মূলায় জামায়াতের সাবেক কর্মপরিষদ সদস্য বাঁশখালী থেকে জামায়াতের মনোনয়নে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া মাওলানা মুমিনুল হকের জামাতা, জামায়াতের সাবেক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত, ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। আর তাতে মধ্যস্থতা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি বিশ্বস্থ প্রয়াত সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) মিয়া মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন। ধারণা করা হয়েছিল, বিএনপির অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে সেবার। আর সেই নির্বাচনে আর্থিকভাবে শক্ত-সামর্থবান জামায়াত ঘরানার নদভী জামায়াত-বিএনপির ভোটে ভাগ বসিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থনসহ আসনটি হয়তো ছিনিয়ে আনতে পারবেন। এমন ধারণা থেকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে রাতারাতি উড়ে এসে জুড়ে বসা নদভীর হাতে বঙ্গবন্ধুর প্রতীক নৌকা তুলে দেওয়া হয়। বিএনপি-জামায়াতবিহীন নির্ভার সেই নির্বাচনে একপ্রকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়ে যান আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অন্ধকারে ঢিল ছোড়া ‘অন্ধ মানুষটি’র হাতেই চলে গেলো জীবনবাজি রেখে রোপিত বীজের প্রথম সহজপ্রাপ্ত ফল-ফসল। ব্যস, এরপর থেকে সহজে পাওয়া ফলটিরও অপব্যবহার, যথেচ্ছাচার হতে থাকে। জীবনে চেয়ারম্যান হওয়ার স্বপ্ন না দেখা নদভী এমপি হয়েই ঘুরতে থাকেন গানম্যান, পুলিশ প্রটোকল ও বাঁশি বাজানো পুলিশের গাড়ি নিয়ে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি, প্রকারান্তরে জামায়াত-তোষণ, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও’র সাথে বিবাদ-বিসংবাদে জড়ানোসহ অতিরঞ্জন ও ‘অরাজনৈতিক কথনে’ অল্পদিনেই বিতর্কিত হয়ে উঠেন এমপি নদভী। যে কারণে একাদশ সংসদ নির্বাচনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় ফের তার মনোনয়ন লাভের বিষয়টি। নিজেকে শুধরানোর অঙ্গীকার ও বিএনপি নির্বাচনে আসছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে সেই ধারণা থেকে আবারও কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ফর্মূলায় তার হাতে নৌকা প্রতীক তুলে দিয়ে মাঠে পাঠানো হয়। এবারও অনেকটা খালি মাঠে গোল দিয়ে চলে এলেন, বিনা ঘামে, বিনা শ্রমে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি হয়ে গেলেন নদভী।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষোভ, আওয়ামী লীগের কি এত ঠেকা পড়েছে কিংবা সাতকানিয়া-লোহাগড়ায় আওয়ামী লীগ কি এতই দেউলিয়া হয়ে পড়েছে যে, মাঠে খেলার জন্য ‘হায়ার’ করে জামায়াত ঘরানার দুর্বল প্লেয়ারকে নিয়ে আসতে হবে? অনেকের ক্ষোভ-কষ্ট– কেন বর্গী এসে ত্যাগীদের নবান্নের ফসল বারে বারে ঘরে তুলবে?

জানা গেছে, এবার সেই আত্মোপলব্ধি খোদ আওয়ামী লীগ প্রধান ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহলেরও। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্টেও সাতকানিয়া-লোহাগড়ায় তার নড়বড়ে ভিত, বিভাজন, অনৈক্য, জনবিচ্ছিন্নতা উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র।

সম্প্রতি জামায়াতের করায়ত্ব থেকে উদ্ধার করা আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ নদভী ও ট্রাস্টি সদস্যের পদ নদভীর স্ত্রীকে দেওয়াটাকেও ভালো মনে করছে না সচেতন মহল। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্বে মানুষের পরিবর্তন হয়েছে বটে, আদর্শিক চেতনার পরিবর্তন হয়নি। কারণ যতই বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা বলে মুখে ফেনা তুলুক; নদভী দম্পতির অন্তরে এখনো পেয়ারা পাকিস্তান, জামায়াতপ্রীতি।

অভিজ্ঞ মহল বলছেন, পরিতাপের বিষয় হচ্ছে তারাই এখন বড় সনদদাতা। তারাই জামায়াতকে আওয়ামী লীগ বানাচ্ছে, আওয়ামী লীগকে জামায়াত বানাচ্ছে। দেশের বৃহত্তম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে নদভী দম্পতি নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করছেন। তাদের ইশারা ছাড়া সেখানে কিছুই হতে পারছে না। ভিসি-প্রোভিসিরা যেন নিধিরাম সর্দার। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন প্রভাবশালী নেতা ট্রাস্টি চেয়ারম্যান এমপি নদভীকে ইঙ্গিত করে একুশে পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘হি ইজ ইন অ্যা বিগ প্রবলেম’।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বুধবার একুশে পত্রিকাকে বলেন, গত একবছরে তুর্কি, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন উৎস থেকে কত টাকা এসেছে, বহদ্দারহাটে আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য কত টাকা আসছে সব আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। দৃশ্যত, প্রতিষ্ঠানটি আগাচ্ছে বলে মনে হলেও নদভী দম্পত্তির একক কর্তৃত্ব, একনায়কতন্ত্রী মনোভাবে প্রতিষ্ঠানটি অদৃশ্যত পিছিয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়গুলোও আগামির মনোনয়নে নেজামুদ্দিন নদভীর ‘আমলনামা’ হিসেবে বিবেচিত হবে বলেও মনে করছেন গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি সচেতন ও দায়িত্বশীলরা।

এদিকে ‘৮০ এর দশকে গোড়ার দিকে চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সহ সাধারণ সম্পাদক সামশুল হক চৌধুরী এক পর্যায়ে গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। জুবিলী রোডে অবস্থিত তার গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল রিচি অ্যাপারেলস। ব্যবসা তার মূল উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য ছিল অন্যকিছু।

‘৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে শেখ কামালের গড়া আবাহনী লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত হন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব দিদারুল আলম চৌধুরীর হাত ধরে। মোটা অংকের ডোনেশন দিয়ে এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডের চেয়ারম্যান হন সামশুল হক চৌধুরী। সেটাকেই সিঁড়ি ধরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে পরিচয়, সখ্যতা এবং সাংগঠনিক উত্থান। মূলত সেই পরিচয়েই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটিয়া আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ছিনিয়ে আনেন সামশুল হক চৌধুরী। আওয়ামী লীগের গণজোয়ারে সহজে এমপিও হয়ে যান তিনি।

এর আগে ‘পটিয়া আমার, আমি পটিয়ার’ এমন স্লোগানে পটিয়ায় কিছু সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে অবস্থান গড়ার চেষ্টা করলেও তেমন সুবিধা করতে পারেননি; বরং অনেকেই ‘পুরাতন পাগলের ভাত জোটে না, নতুন পাগল এসেছে ভাত খেতে’ এমন তির্যক মন্তব্যেও জর্জরিত করেন তাকে। অবহেলিত সেই সামশুল হক চৌধুরী ছলেবলে কৌশলে যখন বঙ্গবন্ধুর প্রতীক নৌকা নিয়ে পটিয়ায় হাজির হন, তখন ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেকে তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এরপর এমপি হয়েই পেছনে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। শুরু হয় পটিয়ায় সামশুল যুগের সূচনা। উত্থান হয় তার আপন ভ্রাতা ভয়াবহ নবাব গ্রুপের।

অভিযোগ উঠে, এমপি হওয়ার পর পটিয়া আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার বদলে বিভাজন তৈরি করতে থাকেন সামশুল। তার সুরে সুর মেলাতে না পেরে আওয়ামী লীগের ত্যাগীদের অনেককে চলে যেতে হয় আড়ালে। আর পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন আওয়ামী লীগ বিরোধীরা। জাতীয় পার্টি ও বিএনপি করা, চোরাকারবারি, সার কেলেংকারির সাথে জড়িত লোকজন স্থান পান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটিতে।

দশম ও একাদশ সংসদেও দলের মনোনয়নে বিনা পরিশ্রমে এমপি হন সামশুল হক চৌধুরী। তৃতীয় মেয়াদে এমপি হয়েই প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় সরকারি দলের হুইপ হন। তার গাড়িতে উঠে জাতীয় পতাকা। গাড়ি, বাড়িতে দেওয়া হয় পুলিশ-পাহারা।

স্থানীয়দের মতে, ব্যস, তাতেই আত্মঅহমিকা, আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর। আর সেই আত্মঅহমিকার ঝাঁপটা গিয়ে পড়ে হালিশহর আবাহনী ক্লাব থেকে জুয়া উচ্ছেদ ও সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশের সেই অভিযানে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন সামশুল হক চৌধুরী। গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে সাফাই গাইলেন ক্যাসিনো ও জুয়ার পক্ষে। উল্টো প্রশ্ন রাখেন, প্রশাসন কি খেলোয়াড়দের ৫ টাকা বেতন দেয়? সরকার কি খেলোয়াড়দের খোঁজ রাখে? খেলা চালানোর জন্য আবাহনী ক্লাবে জুয়া খেলে ২-৩ হাজার টাকা ইনকাম করে বলেও গৌরবের সঙ্গে স্বীকার করেন হুইপ সামশুল, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জুয়া ও ক্যাসিনোবিরোধী ওই সময়ের অভিযানকে রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ করে। হুইপ সামশুলের এমন মন্তব্যে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। মুহূর্তেই খলনায়কে পরিণত হন তিনি। দেশের গণমাধ্যম সরব হয়ে উঠে তার জারিজুরি প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে। ক্রমান্বয়ে উঠে আসতে থাকে তার অতীত অন্ধকারের নানামুখী গল্প। হুইপের এমন গল্পে অসন্তুষ্ট হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুদকের জালে আটকে পড়েন হুইপ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াও বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে কান্নাকাটি করে আপাতত রক্ষা পেলেও আগামী সংসদ নির্বাচনে সামশুল হক চৌধুরী মনোনয়ন না পেতে পারেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রধানমন্ত্রী যার উপর একবার অসন্তুষ্ট হন, তাকে ছাড়েন না। কোনো না কোনোভাবেই তাকে শাস্তির আওতায় আসতে হয়। আর হুইপ সামশুল হক চৌধুরীকেও একেবারে শাস্তিবিহীন ছেড়ে দেবেন বলে মনে হয় না। দুদকের জালে পড়ে নাস্তানাবুদ হওয়া থেকে রক্ষা পেলেও আগামি সংসদ নির্বাচনে কিন্তু তাকে খেসারত দিতে হবে সেটি একপ্রকার নিশ্চিত। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল ছাড়াও এই তথ্য দিয়েছে দেশের প্রভাবশালী এক গোয়েন্দা সংস্থা।

এদিকে, পটিয়া থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে দুবারই বিএনপি প্রার্থী গাজী শাহজাহান জুয়েলের কাছে বিপুল ভোটে হারেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। এরপর আসন পাল্টিয়ে নিজ জন্মস্থান বোয়ালখালী থেকে ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ সাল– প্রতিবারই মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। প্রতিবার মনোনয়ন পান ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর কার্যকরী সভাপতি বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান মাঈনুদ্দিন খান বাদল।

এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে ওই আসন থেকে প্রথমে মনোনয়ন দেওয়া হয় ওয়েল গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামকে। জোটগত স্বার্থ বিবেচনায় পরে মনোনয়ন বদল হলেও প্রধানমন্ত্রী ছালামকে টানা ১০ বছর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান করেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামের প্রভূত উন্নয়ন করেন ছালাম।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচনে নয়ছয় ও লেনদেনের অভিযোগ উঠায় প্রধানমন্ত্রী এতই বিরক্ত হন যে, মোছলেম উদ্দিন আহমেদ থেকে বারবার তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। প্রবীণ নেতা হিসেবে দলের পদে রাখলেও সরকারি পদে কখনোই আনতে চাননি তাকে। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক, এমনকি সিডিএ’র চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেও বিফল মনোরথে ফিরে আসেন মোছলেম।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ আংশিক) আসনের তিনবারের এমপি মাঈনুদ্দিন খান বাদল। উপ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে একুশে পত্রিকা কার্যালয়েও এসে অঝোরে কাঁদতে থাকেন মোছলেম উদ্দিন। ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলতে থাকেন, তিনি এখন জীবনসায়াহ্নে। জীবনে একবার এমপি হওয়ার অধরা স্বপ্নপূরণের আকুতি জানান প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

বলেন- আমি পটিয়া থেকে দুবার মনোনয়ন পেয়েছিলাম; কিন্তু আমার জন্মস্থান না হওয়ায় এমপি হতে পারিনি। এবার আমার জন্মস্থান বোয়ালখালী থেকে এমপি হওয়ার সুযোগ এসেছে। আমি জীবনে একবার এমপি হয়ে মরতে চাই। নইলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না।

সচেতনজনদের মতে, এই যাত্রায় ৭৫ বছর বয়সী মোছলেম উদ্দিনের কান্নাকাটি, আকুতি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী। মনোনয়ন প্রত্যাশী মাঈনুদ্দিন খান বাদলের স্ত্রী সেলিনা খান বাদল, আবদুচ ছালাম ও এম রেজাউল করিমকে পেছনে ফেলে উপ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয় মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে।

কিন্তু মনোনয়ন পাওয়ার পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, নির্বাচনী খরচের কথা বলে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ থেকে অন্তত ৩০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেন মোছলেম। আর এই তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কানে পর্যন্ত পৌঁছে গেলে বেজায় নাখোশ হন তিনি। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে নাকি এও বলেছেন, উনি (মোছলেম) না জিতলেই বরং ভালো। প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবের কথা গোয়েন্দা সংস্থাটির শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছলে তাদের মাঝেও মোছলেমের নির্বাচন ইস্যুতে একপ্রকার গা-ছাড়া ভাব দেখা দেয়।

পরবর্তীতে ওই গোয়েন্দা সংস্থার চট্টগ্রাম প্রধান অফিসিয়াল সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের হাতে মোছলেম উদ্দিনকে তুলে দেন। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, মূলত আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ আরও কয়েকজনের উদ্যোগ ও ম্যাকানিজমে মোছলেম উদ্দিন জয়লাভ করেন। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও জানান, পরে শুনলাম নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহে টাকা পয়সা নাই জানিয়ে আ জ ম নাছিরের কাছ থেকেও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। অথচ এর আগে তার ৩০ কোটি টাকা তোলার তথ্য আছে আমাদের কাছে। যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।

ওই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আরও জানান, ভয়াবহ অর্থ লোভের পাশাপাশি নারীঘটিত ব্যাপার নিয়ে বদনাম থাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেও বেশিদূর আগাতে পারেননি মোছলেম উদ্দিন। এই দুটি বদনাম না থাকলে চট্টগ্রামে বর্ষীয়ান নেতা এম এ হান্নান, এম এ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, এম এ মান্নান, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীদের সঙ্গে তার নাম রাজনীতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকতো। কিন্তু তিনি নিজের যোগ্যতার কখনোই সদ্ব্যবহার করতে জানেননি। যার খেসারত আগামি নির্বাচনে তাকে দিতেই হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসন থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে খালি মাঠে এমপি হয়ে যান উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। এমপি হয়েই একের পর এক অঘটন যেন তার পিছু ছাড়ছে না।

স্থানীয়দের মতে, এর কারণ হচ্ছে সহজে এমপি হয়ে যাওয়া এবং এমপি পদের ভার বইতে না পারা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয় বার এমপি হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন মোস্তাফিজুর রহমান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে মা-মাসি ধরে গালাগাল করতেও দ্বিধা করেননি তিনি; যে গালাগালের ভিডিও ভাইরাল হলে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে নিয়েও গালমন্দ করেন তিনি।

সূত্র মতে, মোস্তাফিজের গালাগালের ধরন দেখে প্রধানমন্ত্রীও নাকি রীতিমতো অবাক হন। ফলে উপর মহল থেকে চাপ আসে তার উপর। তাকে সতর্ক করা হয় সার্বিক বিষয়ে।

এরপর কিছুদিন নীরব থাকলেও ফের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন মোস্তাফিজ। তীব্র কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর নিকাটাত্মীয় আবদুল্লাহ কবির লিটনের সাথে। শুধু তাই নয়,  স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চাইলে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক-প্রকাশক মুজিবুর রহমান সিআইপির সাথেও বিবাদে জড়ান এমপি মোস্তাফিজ।

স্থানীয়দের মতে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র, দুদুবারের এমপি জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর অনুষ্ঠানেও বর্বরোচিত হামলা করতে দ্বিধা করেনি এমপি মোস্তাফিজের অনুগত ক্যাডার বাহিনী। ওই হামলায় শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয় মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীকে। রক্তাক্ত হন তিনি। পরদিন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সেই পৈশাচিক হামলার বর্ণনা দেন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী।

২০২০ সালের ২৯ জুলাই চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন না। তিনি জাতীয় পার্টি থেকে অনুপ্রবেশ করে বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছেন। তিনি কখনও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও আওয়ামী লীগের অসম্প্রদায়িক নীতি ধারণ করতে পারেননি। এমনকি তিনি বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। আমরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের পক্ষ থেকে এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে সংসদ সদস্যের পথ থেকে অপসারণের দাবি জানাচ্ছি।

স্থানীয়রা বলছেন, অবস্থা এমন হয়েছে যে, এমপি হয়ে তিনি কাউকে চোখে দেখছেন না। ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন। নিজের মতের বাইরে গেলে দলীয় লোকদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে একটুও ভাবেন না এমপি মোস্তাফিজ। তার একনায়কতন্ত্রী মনোভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগ।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এমন তথ্য। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামির প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ, চ্যালেঞ্জিং নির্বাচনে মোস্তাফিজের মতো প্রার্থী হলে ভরাডুবি নিশ্চিত। তাই এখন থেকেই বিকল্প খুঁজছেন আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড। আর সেই বিকল্প খোঁজার মধ্য দিয়েই অবসান হতে পারে বাঁশখালীতে মোস্তাফিজ যুগের– এমনটাই ধারণা দিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, ভুলের উর্ধ্বে দল, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কেউ নয়। তেমনি করে এমপি লতিফ, এমপি নদভী, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, এমপি মোছলেম উদ্দিন, এমপি মোস্তাফিজরা ছিলেন দলের ভুল ‘চয়েস’। সেই ভুল অন্তত আওয়ামী লীগ আগামিতে আর করবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিক পেশাদার জরিপ সংস্থা দিয়ে প্রতিটি সংসদীয় আসনে জনমত জরিপ করাচ্ছেন। তাঁর এই জরিপ কর্ম আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত চলবে। জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই আওয়ামী লীগ মনোনয়ন প্রদান করবে। আওয়ামী লীগের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তৃণমূলের অগণিত কর্মী অপরিহার্য। অন্য কোন ব্যক্তি বিশেষ অপরিহার্য নয়।’