গত নির্বাচনে ১০ ভোট পাওয়া বিদ্রোহী প্রার্থী পেলেন নৌকা


এম কে মনির : চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবুল কাশেম। তিনি ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে আবুল কাশেম পেয়েছিলেন মাত্র ১০ ভোট!

আবুল কাশেম দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও নেতা-কর্মীদের বড় অংশ। তারা বলছেন, গতবার ১০ ভোট পাওয়া আবুল কাশেম নৌকা পাওয়ায় দলের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুন্ন হচ্ছে তেমনি নৌকার ভরাডুবি হওয়ার আশংকাও তৈরি হয়েছে। তাছাড়া একজন বিদ্রোহী প্রার্থী নৌকার মাঝি হওয়ায় দলে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা হতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একজন নেতা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘২০১৭ সালের ইউপি নির্বাচনে আনোয়ার হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী নৌকা দিলেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন কাশেম। আনারস প্রতীক নিয়ে ঘরে ঘরে ভোট চেয়েছেন তিনি। আমরা নৌকার জন্য ভোট চেয়েছি আর তিনি চেয়েছেন আনারসের জন্য। তিনি শেষ পর্যন্ত মাঠে থেকে নৌকাকে ডুবাতে ব্যস্ত ছিলেন। তার কোন জনপ্রিয়তা না থাকায় মাত্র ১০ ভোট পেয়ে ভরাডুবি হয়েছিল। এবার সেই তিনিই পেয়েছেন নৌকা প্রতীক। আমরা দলের সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনার দাবি জানাই।

জানা যায়, এবার কেন্দ্রে পাঠানো মনোনয়ন তালিকায় দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন থেকে ৩ জনের নাম পাঠানো হয়। তারা হলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অহিদুল মাওলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আবুল কাশেম।

এরপর গত ১৩ মে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আবুল কাশেম। তাকে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই দলের তৃণমূলে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। দলে বিদ্রোহীদের ঠাঁই হবে না বলে বারবার ঘোষণা দেওয়ার পরও বিদ্রোহী প্রার্থী কাশেম কীভাবে মনোনয়ন পেয়েছেন, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই তৃণমূলে।

জানতে চাইলে দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আবুল কাশেম গতবার নৌকার বিরুদ্ধে গিয়ে মাঠে নেমেছেন। ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চেয়েছেন। গতবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। সেসময় নৌকাকে জেতানো ছিলো দলের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সেই সময়ে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন। এবার তিনি কী করে নৌকা পেলেন? যেখানে তাকে দল থেকে বহিস্কার করার কথা।’

তিনি আরও বলেন, ‘মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আবুল কাশেম মনোনয়ন পেয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগ তার বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার তথ্য কেন্দ্রের কাছে গোপন করেছে। দলের বর্ধিত সভায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হলেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। আমরা কেন্দ্রে এ নিয়ে অভিযোগ করেছি।’

মনোনয়নবঞ্চিত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অহিদুল মাওলা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আবুল কাশেম গতবারের নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ না করে নিজেই হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। পাশের ইউনিয়ন থেকে লোক ভাড়া করে এনে দলে বিশৃঙ্খলা করেছেন। নৌকাকে ডুবাতে ব্যস্ত ছিলেন।’

দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আনোয়ার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি ১৯৬৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এমন অবস্থা কোনদিন দেখিনি। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করা নেতার মনোনয়ন পাওয়া, এগুলো এখন চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আবুল কাশেম দলের বিরুদ্ধে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন সেটি সকলে অবগত আছেন। আমাদের উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান সাহেবকে বলা হয়েছিল। তিনি তখন বলেছিলেন তাকে দল থেকে বহিস্কার না করে আমি ভুল করেছি। এখন তারাই আবার তার নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। এগুলো সব বাণিজ্য। বাণিজ্য না হলে যাকে দল থেকে বাদই দেয়ার কথা তিনি আবার তাদেরই সহযোগিতায় মনোনয়ন পেয়েছেন কীভাবে?’

আক্ষেপের সুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আনোয়ার বলেন, ‘চাইলে আমি নিজেও মনোনয়ন চাইতে পারতাম। চাইনি, কেননা যে পন্থায় এখন মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে বা নেয়া হচ্ছে সেই পন্থায় নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। সবই এখন টাকার খেলা। নানা অপকৌশল আর খেলা চলছে। আমি তাদের সাথে পেরে ওঠতে পারবো না।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া আবুল কাশেমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাঈনুদ্দিন মিশন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আবুল কাশেম কখনোই বিদ্রোহী ছিলেন না। যারা আপনাদের তথ্য দিয়েছে তারা ভুল তথ্য দিয়েছে। সন্দ্বীপের আওয়ামী রাজনীতিতে কিছু জামায়াত-বিএনপি ঢুকে পড়েছে। তারাই এসব বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।’ এসময় আবুল কাশেমের বিদ্রোহী হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ একুশে পত্রিকার কাছে রয়েছে এবং কেন্দ্রে কেন সে তথ্য দেয়া হয়নি- জানতে চাইলে, তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে জানতে সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মাস্টার শাহজাহানকে কল করা হলে তিনি একটি মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী হওয়া ব্যক্তির নৌকা পাওয়া নিয়ে জানতে সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মাহফুজুল হক মিতাকে একাধিকবার কল করা হলে তিনি ধরেননি। পরবর্তীতে খুদে বার্তা পাঠিয়ে মন্তব্য চাইলেও পাওয়া যায়নি।