জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন কমিটি পেতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগ।
দক্ষিণ জেলায় সর্বশেষ কমিটি ২০১০ সালে কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল। উক্ত মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি করতে আগামী ২৮ মে সম্মেলন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় যুবলীগ।
গত ২৯ এপ্রিল উক্ত নির্দেশ আসার পর দক্ষিণ জেলার নতুন কমিটিতে স্থান পেতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন অনেক নেতাকর্মী; তাদের অনেকের প্রত্যাশা, যুবলীগের নতুন কমিটি ‘ভাই লীগ’ মুক্ত হবে।
দক্ষিণ জেলায় যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের একাধিক প্রার্থী একুশে পত্রিকাকে জানিয়েছেন, মাদক কারবার, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিসহ নানা কারণে বিতর্কিত, দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্তরাও এবার যুবলীগের পদে আসতে তোড়জোড় শুরু করেছেন। নতুন কমিটিতে তাদের চিহ্নিত করাও কেন্দ্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন প্রার্থীরা।
এছাড়া আধিপত্য বিস্তার ও বিভিন্ন ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের ‘অনুসারীদের’ যুবলীগের নেতৃত্বে আনতে ‘সিন্ডিকেটবাজি’ করেন বলে অভিযোগ আছে। এ ধরনের অপতৎপরতার কারণে ত্যাগী কর্মীরা রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বলে দাবি যুবলীগের পদপ্রত্যাশীদের। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যুবলীগের নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের মাদক পরীক্ষা (ডোপ টেস্ট) করার প্রয়োজনীয়তা, কাউন্সিলরদের ভোটগ্রহণ ও সমঝোতায় কমিটি গঠনের বিষয়েও কথা বলেছেন তারা।
যদিও যুবলীগের কমিটিতে চট্টগ্রামের জন্য চমক আছে বলে সম্প্রতি একুশে পত্রিকাকে জানিয়েছিলেন আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাে. মাইনুল হােসেন খান নিখিল। তবে সেই চমক কী তা সময় আসলেই দেখা যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মাইনুল হােসেন খান নিখিল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জীবনবৃত্তান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর ক্লিন ইমেজ এবং মানুষের জন্য কাজ করবে এমন ব্যক্তির সমন্বয়ে যুবলীগের নেতৃত্ব গঠনের পরিকল্পনা আছে কেন্দ্রের। এক্ষেত্রে কাদেরকে নেতৃত্বে আনা হবে সেই বিষয়টা খুব শীঘ্রই সকলে জানতে পারবেন, তখন সকলেই বুঝতে পারবেন আমরা কোন পথে হাটছি।’
জানা গেছে, পদপ্রত্যাশীদের অনেকেই কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন। এজন্য বেশকিছু পদপ্রত্যাশী দিনের পর দিন অবস্থান করছেন ঢাকায়। আবার অনেকেই পদ পেতে স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিদের নিয়মিত তোয়াজ করছেন।
এদিকে, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুবলীগের শীর্ষ পদে আগ্রহী ৫২ জনের (সভাপতি পদে ১৩ ও সাধারণ সম্পাদক পদে ৩৯) জীবনবৃত্তান্ত জমা পড়েছে কেন্দ্রে। যার মধ্যে সভাপতি পদে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথি চৌধুরী, জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ফারুক হোসেন, জেলা ছাত্রলীগ নেতা আকতার হোসেন, পশ্চিম পটিয়া থানা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মো. মাইনুদ্দিন ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সহ সম্পাদক নাসির উদ্দীন মিন্টু প্রমুখ।
অন্যদিকে, সাধারণ সম্পাদক পদে আসতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ বর্তমান কমিটির কয়েকজন নেতা। তাদের মধ্যে আলোচনায় আছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য আবু মোহাম্মদ সায়েম ও মাহবুবুর রহমান মাহবুব, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মহিউদ্দিন মহিম ও জেলা যুবলীগ নেতা মো. সোলাইমান প্রমুখ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথি চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী যুবলীগের সকল কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। আমি চেষ্টা করেছি মানবিক যুবলীগ, যাতে মানবিক থাকে। আমি কী করেছি না করেছি তা আমার নেতাকর্মী ও কেন্দ্র অবশ্যই অবগত আছেন। দলের দুঃসময়ে কাজ করেছি। আশা করছি, এর মূল্যায়ন আমি পাবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার জানা মতে দক্ষিণ জেলা যুবলীগে কোনো মাদকসেবী নেই। তারপরও কেন্দ্র যদি মনে করে বৃহত্তর স্বার্থে ডোপ টেস্ট করানো প্রয়োজন তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আর কাউন্সিলরদের ভোট কিংবা সমঝোতা, কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত নিবে তা আমার জন্য শীরধার্য। এখানে আমার আলাদা করে চাওয়ার কিছু নেই। তবে সকলের একটাই চাওয়া, স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব সংগঠনের নেতৃত্বে আসুক।’
সভাপতি পদপ্রত্যাশী হলেও সম্মেলন পরিস্থিতিতে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক ফারুক হোসেন। সম্মেলন নিয়ে নিজের কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষার কথাও জানাননি তিনি। একুশে পত্রিকাকে ফারুক হোসেন বলেন, ‘আসন্ন সম্মেলন নিয়ে কিছু বলা উচিত হবে না। যেহেতু কেন্দ্রীয় নেতাদের ইতোমধ্যে দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু আমার কাছ থেকে কিছু না জানাটাই ভালো হবে।’
এদিকে সাবেক ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে বারবার উঠে এসেছে, দলীয় পরিচয় নিয়ে সংকটের বিষয়টি। দীর্ঘ এক যুগ পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সম্মেলনের মাধ্যমে সেই সংকটের অবসান ঘটবে বলে আশা তাদের। পদপ্রত্যাশীরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে যুবলীগের এই সম্মেলন অনেক বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য আবু মোহাম্মদ সায়েম বলেন, ‘দীর্ঘ এক যুগ পর দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কমিটি হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তি যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে এজন্য ডোপ টেস্ট করলে ভালো হয়। এমনটা হলে শতভাগ স্বচ্ছতা থাকবে। এছাড়া অনেক সময় সমঝোতার মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাই করা হলে অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসে না। এক্ষেত্রে ভোটের মাধ্যমে তা করা হলে কমিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ থাকে না।’
নিজের পদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আশাবাদী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না এবারের কমিটিতে কোনো মাদক কারবারি, টেন্ডারবাজ, দখলবাজ কিংবা হাইব্রিড নেতারা স্থান পাবেন। কেন্দ্র এসব বিষয়ে যথাযথ নজরদারি রেখেছে, এখনও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাই আমি আশাবাদী যে এবার যোগ্যতার ভিত্তিতেই নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হবে। আমার চাওয়া যুবলীগ যাতে যুবলীগ থাকে, ভাই লীগ যাতে না হয়ে যায়।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য মাহবুবুর রহমান মাহবুব বলেন, ‘৩ বছরের কমিটি ১২ বছর সময় পার করেছে। ছাত্রলীগে নেতৃত্ব দিয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। কিন্তু এরপর আমাদের কোনো গতি হয়নি। এবারের সম্মেলনে আমাদের আশা, কেন্দ্র আমাদের ওই আক্ষেপ দূর করবে। আমি সাধারণ সম্পাদক পদে নিজের ব্যাপারে আশাবাদী।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেন্দ্র যথাযথ নজরদারি রেখেছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ বা কোনও ধরনের অসংগতি থাকলে কেন্দ্র কখনোই তাদের নেতৃত্বে আনবে না, এটা আমার বিশ্বাস। এক্ষেত্রে পদপ্রত্যাশীদের ডোপ টেস্ট করা গেলে কেন্দ্রের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে। আর কাউন্সিলর ভোটে হোক কিংবা সমঝোতা- কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই আমাদের জন্য চূড়ান্ত।’
এদিকে, নতুন কমিটির দুই সভাপতি প্রার্থী পার্থ সারথি চৌধুরী ও ফারুক হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে কিছু অভিযোগ।
দক্ষিণ জেলা যুবলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথির বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে বলে তৃণমূল পর্যায়ে গুঞ্জন আছে। অভিযোগের বিষয়ে পার্থ সারথি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়টি ভিত্তিহীন। নৌকার বিরোধীরা এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
অন্যদিকে ফারুক হোসেনের বিরুদ্ধে বয়স গোপন করে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সিভি জমা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতা। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় যুবলীগের বেঁধে দেওয়া ৫৫ বছরের বয়সের সীমার নির্দেশনা অমান্য করেছেন ফারুক। ৫৭ বছরের বেশি বয়স হওয়ার পরও তিনি নিজের বয়স লুকিয়ে সিভি জমা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ফারুক হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার বয়স যদি বেশি হতো কেন্দ্র কী আমার সিভি নিতো? আমার সার্টিফিকেট আমি কেন্দ্রে দিয়েছি। সেটা কেন্দ্রীয় কমিটি নির্ধারণ করবে।’ যদিও নিজের বয়স জানাতে রাজি হননি এ নেতা।