রাঙামাটি: রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় যুবলীগের এক নেতার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। এ ঘটনায় আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল থেকে পাহাড়ীদের শত শত বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আগুনে এক পাহাড়ী বৃদ্ধা মারা গেছেন বলে দাবি করেছেন এক ব্যক্তি; তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
লংগদু উপজেলার বাঙালিরা বলছেন, যুবলীগের নেতাকে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। অভিযোগ অস্বীকার করে পাহাড়ি কয়েকজন দাবি করেন, বাঙালিরা তাদের শত শত বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে লংগদু সদরের আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন।
লংগদু উপজেলার আটারকছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা বলেন, পাহাড়িদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করার সময় গুনমালা চাকমা (৮০) নামে এক নারী ঘরের ভেতর আটকা পড়েন। এতে আগুনে মারা গেছেন তিনি।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কে চার কিলো এলাকা থেকে সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার বাড়ি লংগদু উপজেলা সদরে। তিনি ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালাতেন। শুক্রবার সকাল আটটায় তার লাশ লংগদু বাত্যপাড়া গ্রামে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে লংগদুবাসির ব্যানারে কয়েক হাজার বাঙালীর একটি বিশাল শোক মিছিল উপজেলা সদরের দিকে যাচ্ছিলো জানাজার উদ্দেশ্যে। হঠাৎ একই উপজেলার ঝর্ণাটিলা এলাকায় মারফত আলী নামের এক বাঙালীর বাড়ীতে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে এমন খবরে মিছিল থেকেই প্রধান সড়কের পাশের লংগদু উপজেলা জনসংহতি সমিতির কার্যালয় সহ আশেপাশের পাহাড়ীদের বাড়ীঘরে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করা শুরু হয়। আগের দিন রাতেই স্থানীয় পাহাড়ীরা সম্ভাব্য গোলযোগের শংকায় সরে পড়ায় কোন হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও পাহাড়ী অধ্যুষিত তিনটিলা পাড়ার ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা থাকলেও তারাও নিরূপায় হয়ে পড়েন। পরে উপজেলা পরিষদ মাঠে নয়নের জানাজা ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে বক্তব্য দেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য মো. জানে আলম, উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাজ্জ্বল হোসেন, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. নাসির উদ্দিন, সম-অধিকারের নেতা মো. আফসার আলী ও আলমগীর হোসেন।
উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল দুজন পাহাড়ি নুরুল ইসলামের মোটরসাইকেল ভাড়া করেন। এরপর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তর লাশ উদ্ধার করা হয়। পাহাড়ি লোকজনই নুরুল ইসলামকে হত্যা করেছে।
সমাবেশ চলাকালে সেনাবাহিনীর লংগদু জোন কমান্ডার লে: কর্ণেল আ: আলীম চৌধুরী ও লংগদু থানার ওসি মোমিনুল ইসলাম সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং নয়নের খুনিদের গ্রেফতারের আশ^াস দেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা শাখার জনসংহতি সমিতির সভাপতি মনি শংকর চাকমা বলেন, পাহাড়িদের দায়ী করে শুক্রবার সকালে বাঙালিরা তিন টিলা ও মানিকজোর ছড়া গ্রামে পাহাড়িদের দুই শতাধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছেন। জনসংহতি সমিতির কার্যালয়ও পুড়িয়ে দিয়েছেন। আমার ঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পাড়ার একটি ঘরও অবশিষ্ট নেই। এই হত্যার ঘটনার সাথে তো আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। আমরা তো কিছুই জানিনা। তবুও কেনো আমাদের বাড়ী ঘর আগুনে পোড়ানো হলো জানিনা।
তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ১৯৮৯ সালে একবার নি:স্ব হয়েছিলাম আগুনে, আবার নি:স্ব হলাম। আমিসহ অসংখ্য মানুষ স্থানীয় বনবিহারে আশ্রয় নিয়েছি।
এদিকে লংগদু উপজেলা সমঅধিকার আন্দোলনের সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, আমরা লংগদুবাসির ব্যানারে সর্বদলীয়ভাবে নয়নের লাশ গোসল শেষে জানাজার জন্য উপজেলা সদরের মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর আসে ঝর্ণাটিলায় একটি বাঙালী বাড়ীতে অগ্নিসংযোগের খবর আসায় মিছিলের উত্তেজিত লোকজন জনসংহতি সমিতির কার্যালয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে, পরে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান বলেন, আগুনে কেউ মারা গেছে কিনা আমরা এখনো নিশ্চিত নই। লংগদু উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছি। আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে। আইনশৃংখলাবাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কবস্থায় আছে।
এদিকে যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম নয়নকে হত্যার প্রতিবাদে রাঙামাটি জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে যুবলীগ এবং পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ। শুক্রবার দুপুরে শহরের বনরূপা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করে বনরূপায় এসে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
জেলা যুবলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সম্পাদক নুর মোহাম্মদ কাজলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ছাওয়াল উদ্দিন, পৌর যুবলীগের সভাপতি আবুল খায়ের, জেলা মৎসজীবি লীগের সভাপতি উদয়ন বড়–য়া, কৃষকলীগের সাধারন সম্পাদক উদয় শংকর চাকমা।
সমাবেশ থেকে অবিলম্বে পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করার জানানো হয়। দ্রুত নয়নের হত্যাকারিদের গ্রেফতারের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি জানানো হয়। এদিকে একই ঘটনার প্রতিবাদে শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ। শহরের কাঠালতলি থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বনরূপায় সমাবেশ করে তারা। জেলা সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সভাপতি হাবিবুর রহমান, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক নূরজাহান বেগম, তুহিন প্রমূখ। সমাবেশ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে নয়নের খুনিদের গ্রেফতার করা না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অচল করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।