মন্ত্রীর ভাগনে!


শান্তনু চৌধুরী : বছরকয়েক আগে তিনবন্ধু মিলে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড ভ্রমণ করতে। ব্যাংকক থেকে ফুকেটের স্থানীয় বিমানবন্দরে নেমে আমাদের হোটেলের পথটি ছিল বেশ দূরে। যে সময়ে আমরা সেখানে পৌঁছালাম, বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে দেখলাম আশপাশে বেশ অন্ধকার। তেমন কোনো যানবাহনও নেই। শেষ পর্যন্ত একটা গাড়ি পাওয়া গেল, কিন্তু বাংলা ছবি দেখে বড় হওয়া সন্দিগ্ধ মন গাড়ি চালককে দেখে সতর্ক হয়ে উঠলো। চেহেরা একেবারে বাংলা ছবির বি-গ্রেড ভিলেনের মতো। এছাড়া তিনি বেশি দরাদরিও করলেন না। আরেক প্রাইভেট কার চালকের সাথে সেদেশের ভাষায় কথা বলে যেভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন আমরা আরও ভড়কে গেলাম। এরপরও উপায় না দেখে তাঁর গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ঘনজঙ্গল। কোনো জনমানুষের অস্তিত্ব নেই। মাইলের পর মাইল নিঃস্তব্ধ। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বললেও চালক একদম চুপচাপ। প্রায় এক ঘণ্টা লাগলো শহরে পৌঁছাতে। আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে চালক হোটেল খুঁজে দিলেন এবং তার আন্তরিকতায় আমরা এতোটাই মুগ্ধ হলাম, পরবর্তী দিনগুলোতে দূরে কোথাও যাওয়া হলে তাকেই ডাকতাম। সবশেষ ফুকেট বিমানবন্দর ছাড়ার সময়ও তার গাড়িতেই এসেছিলাম।

এমন গল্প নেপাল বা ভুটানের মতো দেশেও রয়েছে। একটা দেশের মানুষ কতোটা পর্যটনবান্ধব হলে এমন হতে পারে তা বুঝাতেই এসব কথা বলা। আর আমাদের দেশে প্রকৃতি দু’হাত ভরে দিলেও আমরা দু’হাত ভরে তা ধ্বংস করার তালে রয়েছি। বাংলাদশের প্রতিটি পর্যটন স্পটে মানুষ যে কীভাবে হয়রানির শিকার হয় তা বড় ঘটনা না ঘটলে কখনোই জানা যায় না। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে চাঁদাবাজি, স্থানীয়রা যে যার মতো পারছে দখল করে নষ্ট করে দিচ্ছে।

সম্প্রতি সিলেটের জাফলং-এ যা হয়েছে। প্রকাশ্যে যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে পর্যটকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে তা নিয়ে বলার ভাষা নেই। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেই দায়িত্ব খালাস। এই দেশে এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে কোনো কিছুর যেন বিচার নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বলে যে কথাটি চলছে তাই যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। তাই কেউ আর এখন বিচার চান না। যেহেতু রাষ্ট্রকে কিছু বলা বা করে দেখানোর ভাষা নেই, তাই বিচার চান সৃষ্টিকর্তার কাছে। কেন পর্যটনস্পটগুলো এমন হয়ে যাচ্ছে? এ প্রসঙ্গে ব্লগার ও লেখক আরিফ জেবতিক এর একটি লেখার কিছু অংশ তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের চরম দুর্ভাগ্য যে এই ছবির মতো দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশের দায়িত্ব যাদেরকে দেয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশকেই আমার ছাগল মনে হয়। বাকি ১০ শতাংশ ছাগল নয়, এরা শীর্ষে বসে থাকা রামপাঁঠা। এই রামপাঁঠা গোষ্ঠি জীবনেও তাঁদের ছাত্রজীবনে কোথাও ঘুরতে যায়নি, বেড়ানো নিয়ে কোনো প্যাশন নেই, দুনিয়ার পর্যটন শিল্প কীভাবে চলে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র কোনো আইডিয়া নেই। তৃণমূল প্রশাসনের নব্য ডাকাত শ্রেণির এই গর্দভগুলো একমাত্র যা বুঝেছে সেটি হচ্ছে দেশের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোতে ইজারাদার বসিয়ে দেয়া’।

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রেলের ঘটনা সামনে চলে এসেছে। পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত বুধবার রাতে আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে তিনজন যাত্রী বিনা টিকেটে এসি কেবিনে ভ্রমণ করছিলেন। বিনা টিকেটে ভ্রমণের জন্য ওই তিনজন যাত্রীকে জরিমানা করেন কর্তব্যরত টিটিই। পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। যদিও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলছেন, ওই তিনজন তার আত্মীয় কি না, তা তিনি জানেন না। অবশ্য নিউজবাংলাটুয়েন্টি ফোরের অনুসন্ধান বলছে, এরা একজন মন্ত্রীর ভাগনে হন এবং অপর দু’জন মামা শ্বশুর।

মন্ত্রী বা নেতাদের আত্মীয় কাহিনি অবশ্য নতুন কিছু নয়। এই তো ঈদের আগে, ৫ মে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা হেলেনের স্বজনেরা পটুয়াখালীর পায়রা সেতুর টোল না দিয়েই গাড়ির বহর নিয়ে সেতু পার হতে চেয়েছিলেন। পরিণতিতে মারধর, ১০ জন আহত। আরও কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভূমি অধিগ্রহণ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। বেরসিক জেলা প্রশাসন তদন্ত করলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এরও আগে হাজি মো. সেলিমের পুত্রের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই দাঁড় করাতে পারেনি। এভাবে তালিকা আরো দীর্ঘ হবে। এখন কথা হলো চুনোপুঁটি নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপি যে যেখানে পারছে ক্ষমতার স্বাদ নিতে চান। এ বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা বলছেন, সরকার চাইলে মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয় স্বজনরা কী কী সুবিধা পাবেন তা নিয়ে একটি বিলও পাস করিয়ে নিতে পারেন।

এ বিষয়ে একটি কৌতুক বলা যেতে পারে। এক লোক মন্ত্রীর বাসায় গিয়ে ছেঁচামেঁচি করে বলছেন, মন্ত্রীকে বলেন তাঁর ভাগনে এসেছে। সবাই তো অবাক! কারণ মন্ত্রীর ভাগনে তো সবার পরিচিত। কিছুতেই তারা ওই যুবককে মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করতে দেবেন না। পরে মন্ত্রী নেমে এলেন দোতলা থেকে। তিনিও ওই যুবককে দেখে অবাক হলেন। বললেন, ‘তুমি আমার ভাগনে হলে কেমন করে?’ যুবক উত্তর দিলেন, ‘গতকাল স্কুল মাঠে আপনি যে বলেছিলেন প্রিয় ভাই ও বোনেরা। সেখানে আমার আম্মাও ছিলেন! সে হিসেবে তো আমি আপনার ভাগনে!’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এবারের ঈদে ২৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল চলেছে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত হয়েছে মোটরসাইকেলে। দূরপাল্লার বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল ঈদের আগের দিন সোমবার থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চার দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আট শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল)। তাঁদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। এর একটি বড় অংশ বয়সে তরুণ, যাঁরা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। ঈদের সময় ট্রেনের টিকিট কাটায় হয়রানি, সড়কের যানজটের ভোগান্তির কারণে ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল বিকল্প বাহন হয়ে উঠেছে। মোটরসাইকেল গণপরিবহনের বিকল্প হওয়া দুঃখজনক। এটি গণপরিবহনের বিকল্প হতে পারে না। দূরপাল্লায় যাত্রায় মোটরসাইকেল ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এবার অনেক মোটরসাইকেল বাণিজ্যিকভাবে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন করেছে। ঢাকায়ও সাধারণভাবে দেখা যায়, মোটরবাইকের সংখ্যা বেশি। এর জন্য প্রধানত যানজটই দায়ী। অপেক্ষাকৃত দ্রুত সময়ে যাওয়া যায় বলেই এটিকে বেছে নেন অনেকে। কিন্তু এর বেপরোয়া গতিই ডেকে আনে মৃত্যু। তাই বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে হয়, ‘একেবারে না পৌঁছানোর চেয়ে দেরিতে পৌঁছানো ভালো’, ‘একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না’।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক