রানা আবির : চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের জন্য বেশ কয়েকটি খালে অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। কাজের জন্য খাল ভরাট করা হলেও পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা পুরোপুরি নিশ্চিত করা হয়নি। যার কারণে কিছু কিছু এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে পানি জমে থাকছে। এতে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ।
এ অবস্থায় নগরীর জলাবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ কমাতে বিভিন্ন খালে থাকা সব বাঁধ ১৫ মে’র মধ্যে অপসারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক ও সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী।
খালে দেয়া বাঁধের কারণে বৃষ্টিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘খালের মুখে বাঁধ দেওয়ার প্রধান কারণই হচ্ছে খালে আটকে থাকা পানি অপসারণ করে খাল গভীরভাবে খনন করা। শুকনো মৌসুমে খালের মুখে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে যে সকল খালের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে সেই সকল খালের মুখের বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে।’
‘তবে এতটুকু নিশ্চয়তা দিচ্ছি, চলতি মাসের অর্থ্যাৎ মে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে বাকি সব খালের সংস্কার কাজ শেষ করে বাঁধ খুলে দেওয়া হবে। তখন কোন জলাবদ্ধতা চট্টগ্রাম নগরীতে থাকবে না।’ বলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী।
‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ নামে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সিডিএ।
২০১৭ সালের ৯ অগাস্ট একনেকে অনুমোদন পাওয়া এই প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খালের ৫ লাখ ২৮ হাজার ঘনমিটার মাটি খনন এবং ৪ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার কাদা অপসারণ করা হবে।
পানি নিষ্কাশনের জন্য সড়কের পাশে নালা তৈরি করা হবে এক হাজার ৭৭ কিলোমিটার। প্রায় ১০৮ একর জমি অধিগ্রহণ ও রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে এক লাখ ৭৬ হাজার মিটার। ৮৫ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হবে।
এছাড়াও ছয়টি পিসি গার্ডার ব্রিজ প্রতিস্থাপন, পাঁচটি টাইডাল রেগুলেটর স্থাপন, ৪২টি সিল্ট ট্র্যাপ স্থাপন, বন্যার পানি সংরক্ষণ জলাধার স্থাপন তিনটি, বিদ্যমান নালার সংস্কার ও মেরামত, দুই হাজার বৈদ্যুতিক পোল স্থানান্তর এবং ৮৮০টি স্ট্রিট লাইন স্থাপন হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে এত কিছুর পরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের কাজে ধীরগতির পাশাপাশি সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
সরেজমিন সোমবার বিকেলে নগরীর ৩৩ নং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড, চকবাজার, চাক্তাই খাল ও পাহাড়তলীতে গিয়ে দেখা যায়, খালের পানির প্রবেশপথে বাঁধ দিয়ে পানি চলাচলের বন্ধ করা হয়েছে। এতে করে বৃষ্টির পানি সহজে বের হতে না পারায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
খালের মুখ বন্ধ রাখার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দক্ষিণ কাট্টলি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ইসমাইল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘খাল সংস্কার করার সময় শুকনো মৌসুমে জেলে পাড়া এলাকায় খালের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে এই মুখ আর খোলা হয়নি। এখন বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সাগরে না যাওয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। বারবার সমন্বয় সভায় এই বাঁধ খুলে দেওয়ার কথা বললেও কোন সুফল মেলেনি।’
নগরের ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার বংশাল রোড, আর.সি চার্চ রোড, চুরিয়ালটুলী, ডা. মান্নান গলি, আলকরণ ২নং ও ৩নং গলিসহ পুরো এলাকার মানুষ গত ঈদের তৃতীয় দিন বৃষ্টিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন। সেদিন বাসা-বাড়িতে ময়লা পানি ঢুকে গুরুত্বপূর্ণ আসবারপত্র নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন যুবলীগ নেতা একুশে পত্রিকাকে অভিযোগ করে বলেন, ‘ফিরিঙ্গিবাজারে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজে নিয়োগকৃত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্সের কাজের ধীরগতি ও অবহেলার মূল্য দিতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। খালের সংস্কার কাজ শুরু করার সময় খালের মাটি উত্তোলন সঠিকভাবে হয়নি। এছাড়া পানি যাওয়ার পথ দীর্ঘ দিন বন্ধ করে রাখার কারণেই বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হচ্ছে।’
নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার বংশাল রোডের বাসিন্দা আব্দুল মোমেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথেই আমাদের এলাকায় পানি উঠতে শুরু করে। একপর্যায়ে বাসার নিচতলায় ময়লা পানি ঢুকতে থাকে। গত ঈদের তৃতীয় দিন দিনভর পানি নামেনি। জলাবদ্ধতার বিষয়টি খুবই বিরক্তিকর।’
ফিরিঙ্গিবাজারে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজে নিয়োগকৃত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সিডিএ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্সের চরম গাফিলতি ও কাজের ধীরগতির কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে এলাকাবাসী। খালে পানি বের হওয়ার পথ কাজ চলাকালীন সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। যা এখনো অপসারণ করা হয়নি। এর ফলে পানি নামার পথ বন্ধ হওয়ার কারণে এলাকায় এমন জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। খালের বাঁধ অপসারণ করতে আমি বারবার নিজে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।’
অভিযোগের বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস ট্রেডিং এন্ড কর্পোরেশনের প্রকৌশলী আল আমিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কাজে গাফিলতি ও ধীরগতি চলছে, এমন অভিযোগ সত্য নয়। আমাদের লোক ২৪ ঘন্টাই কাজ করছে।’ খালের মুখ বন্ধ করে কাজ করার কারণেই জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে- এমন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘কাজ দ্রুত গতিতে শেষ করার স্বার্থেই খালের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। কারণ খালের মুখ বন্ধ না করলে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ করা সম্ভব নয়।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের অধীনে নগরীর ৪০টি খালের মুখে ‘স্লুইস গেট’ স্থাপনের কাজ চলছে। খালগুলোর মধ্যে ২৩টির প্রবাহ হয় কর্ণফুলী নদীতে ও ৩টির হালদা নদীতে। এছাড়া ১৪টি খাল প্রবাহিত হয় বঙ্গোপসাগরে। রেগুলেটরের ভৌত কাজের জন্য এসব খালের মুখে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এই বাঁধের কারণেই সামান্য বৃষ্টিতেই নগরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
এদিকে, ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতায় আটকে আছে নগরের ১৮ খালের কাজ। এছাড়া বর্ষা ও জোয়ারের পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে নগরীর ৩৬টি খাল খনন, সংস্কারের কাজ চলছে। ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতায় ১৮টি খালের কাজ শেষ হচ্ছে না।
সিডিএ’র তথ্য মতে, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের বড় বাধা ভূমি অধিগ্রহণ। অনুমোদনের সময় ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ ছিল দেড়গুণ। পরে আইন সংশোধন করে তা তিন গুণ নির্ধারণ করা হয়। তাই প্রকল্পের নির্ধারিত ৬ হাজার ৫১৬ কাঠা ভূমির মধ্যে মাত্র ৩০০ কাঠা অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
এই জটিলতায় নগরীর ত্রিপুরাখাল, গয়নাছড়া খাল, ডোমখালী খাল, মহেশখাল, চাক্তাইখাল, চাক্তাই, মির্জাখাল, হিজড়া খাল, বদরখাল, নোয়াখাল, শীতলঝর্ণা খাল, ডাইমেনশন খাল, চশমা খালসহ ১৮টি খালের খনন, সম্প্রসারণ ও সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয়নি। এর ফলে সামান্য বৃষ্টির পানিও সহজেই শহর থেকে নামছে না। খালের পাড়ের মোট ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার সম্পন্ন হয়েছে। পাহাড়ি বালু আটকানোর জন্য ৪২টি সিলট্র্যাপের মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে ১৫টির।
জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজে কোন ধীরগতি নেই। স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে কাজ। তবে খালের পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কিছুটা দেরি হচ্ছে। বিশেষ করে ছোট সেতু, কালভার্টের জন্য কিছু স্বল্প জায়গা অধিগ্রহণ করা লাগছে, সেগুলো ক্ষতিপূরণ সিডিএ থেকেই দেওয়া হচ্ছে। আর বড় জায়গা অধিগ্রহণের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসন সেটি বিবেচনা করে আমাদের জানালে ও পরবর্তীতে সরকার আমাদের অর্থ দিলে আমরা জমির মালিকদের দিয়ে দেব।’