এনবিআরকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ দেখিয়ে ‘মৌখিক ছুটিতে’ চট্টগ্রামের কাস্টম কর্মকর্তারা

রানা আবির : দেশের আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়ন ও বাণিজ্যবান্ধব রাজস্ব পরিবেশ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ঈদের দিন ছাড়া ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাস্টম হাউসগুলো সীমিত আকারে খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

গত ২৭ এপ্রিল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়েছিল এনবিআর। কিন্তু এনবিআরকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ দেখিয়ে গত ২৭ এপ্রিল থেকে ‘মৌখিক ছুটিতে’ আছেন চট্টগ্রামের কাস্টম হাউজের কর্মকর্তাদের অনেকেই। এতে প্রায় পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই দেশের সিংহভাগ আমদানি–রপ্তানি হয়। আর চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখার ছাড়পত্র না পেলে পণ্য বন্দর থেকে বের হতে পারে না।

সেই এআইআর শাখার আজ রোববার সকালে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো অফিসের দরজা তালাবদ্ধ। শুল্কায়ন সেকশনের দরজায়ও তালা দেওয়া ছিল। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের অন্য অফিসগুলো খোলা থাকলেও সেখানে পিয়ন ছাড়া আর কেউ নেই।

এতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস না হওয়ায় আমদানিকারকদের গুনতে হচ্ছে কনটেইনার প্রতি বাড়তি জরিমানা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কমার্শিয়াল আমদানিকারকের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি নিতে ব্যর্থ হলে দিনপ্রতি ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য গুনতে হয় ৯৬ ডলার ও ৪০ ফুটের কনটেইনারের ক্ষেত্রে জরিমানা গুনতে হয় ১২০ ডলার। সাথে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও শিপিং এজেন্টের কনটেইনার বিল ১২০ ডলার দিতে হয়। তবে বন্ড সুবিধায় আনা পণ্যগুলো শুধুমাত্র ২০ ফুট ও ৪০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে কমার্শিয়ালের সমপরিমাণ চার্জ দিলেও ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতামুক্ত থাকে।

এনবিআরের নির্দেশনা অমান্য করে ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে কাস্টম কর্মকর্তাদের এভাবে অফিস না করায় আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ফলে তারা ক্ষুব্ধ হলেও কাস্টম কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ার ভয়ে গণমাধ্যমের কাছে পরিচয় প্রকাশ করে কিছু বলতে চান না।

সংশ্লিষ্টরা একুশে পত্রিকাকে জানিয়েছেন, কাস্টম কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কিছু বললে অসদাচরণের অভিযোগ এনে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল হয়ে যেতে পারে; এসব কাজ করতে শুনানি করাও লাগবে না। যার কারণে ক্ষতি হলেও তাদের কিছু করার নেই।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একটি সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়ম মোতাবেক পণ্যের ছাড়করণের সময় এআইআর ব্লক থাকে। পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার সময় তাদের ফোন করলে সরেজমিনে এসে পণ্য দেখে ছাড়করণের আদেশ দেয় তারা। কিন্তু গত বুধবার থেকে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের দেখা মিলছে না। ফোন করলে বলছে ছুটিতে আছি।’

একজন আমদানিকারক একুশে পত্রিকা বলেন, ‘এআইআর ব্লক থাকলে পণ্য দেখিয়ে ছাড় করাতে হয়। কিন্তু সিঅ্যান্ডএফ আর কর্মচারীরা যোগাযোগ করলে এআইআর শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ছুটিতে আছি। তারা ছুটিতে থাকলে বন্দর কর্তৃপক্ষ কি তা মানবে? তারা ঠিকই এক দিনের ক্ষতিপূরণ চার্জ কেটে রাখবে। এআইআর শাখার কর্মকর্তারা কি এনবিআরের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারে?’

অফিসে তালা দিয়ে সবার অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টম হাউজের এআইআর শাখার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহরিয়ার হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ডিউটিতে না থাকলে কীভাবে বন্দরের কার্যক্রম সচল থাকবে সেই ব্যাপারে ডিসি স্যারের সাথে কথা বলুন। আমি ছুটিতে আছি।’

ঈদের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার বিষয় নেই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা প্রিভেল চাকমার; তবুও কয়েকদিন ধরে তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত বলে অভিযোগ উঠেছে; অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রিভেল চাকমা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি রাতে ডিউটি করি। অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি সত্য নয়।’

অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আনিছুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিসি স্যার আমাকে মৌখিকভাবে ছুটি দিয়েছেন। আপনি অন্য কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করুন।’

কয়েকদিন ধরে অফিসে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগ উঠেছে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে; এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি অনুপস্থিত কী কারণে সেটা আপনাকে বলার নিয়ম নেই আমাদের। আপনি ঊর্ধ্বতনদের সাথে কথা বলুন।’

কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. তারিকুজ্জামান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি ডিসি স্যার থেকে ৪ দিনের জন্য মৌখিকভাবে ছুটি নিয়েছি। তবে কারও বিশেষ কোন কাজ থাকলে বাসায় আসতে বলি। বাসা থেকেই অফিসের কাজ সেরে ফেলি।’

বন্দরের পণ্য ডেলিভারির কাজে নিয়োজিত এআইআর শাখার কর্মকর্তারা কীভাবে বাসায় বসে দাপ্তরিক কাজ করবেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি নিজেও বাসায় আছি। এআইআর শাখার কর্মকর্তাদের তো মাঠে থাকার কথা। আচ্ছা, আমি খোঁজ নিচ্ছি তারা কোথায় আছে। তবে বাসায় বসে দাপ্তরিক কাজ করার কোন সুযোগ নেই।’

অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের এআইআর শাখার ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) শরীফুজ্জমান মিঞা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে শুধুমাত্র ঈদের দিন বাদে সীমিত আকারে কাস্টম হাউজ খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে। আজ মে দিবস তাই এআইআর শাখার কর্মকর্তারা বাসা থেকে হয়তো দাপ্তরিক কাজ করছেন।’

অধস্তনদের ‘মৌখিক ছুটি’ দেওয়া যায় কি না- প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে ছুটি দেইনি। আপনার যদি কিছু জানার থাকে আপনি মিডিয়া অফিসার সালাউদ্দিন রিজভীর সাথে যোগাযোগ করুন।’

এ বিষয়ে জানার জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের মুখপাত্র ও ডেপুটি কমিশনার সালাউদ্দিন রিজভীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

কথিত মৌখিক ছুটি নিয়ে অফিসের বাইরে থাকার সুযোগ আছে কি না জানতে চাওয়া হলে এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ এ মুমেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়ম মোতাবেক লিখিতভাবে ছুটি পাশ হলে তবেই ছুটি ধার্য হয়। মৌখিকভাবে ছুটি নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এআইআর শাখার কোন কর্মকর্তা যদি কথিত মৌখিক ছুটির নাম করে নিজ দায়িত্ব অবহেলা করে সেক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঈদের বন্ধে সীমিত পরিসরে কাস্টম হাউজ চালু রাখার জন্য কত শতাংশ কর্মীকে অফিস করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে- জানতে চাইলে এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ এ মুমেন বলেন, ‘এটি মূলত নির্ভর করবে আমদানি কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে। যেহেতু এনবিআর থেকে লিখিত আদেশ জারি করা হয়েছে, তাই বন্দরের ডেলিভারির উপর নির্ভর করে কাস্টম হাউজের কমিশনার তা ঠিক করবেন।’