শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মরণ দশার কারণ কী


ফারুক আবদুল্লাহ : একসময় সামাজিক সূচকে এ অঞ্চলের সেরা ছিল শ্রীলঙ্কা। শিক্ষায় ছিল সবার তুলনায় এগিয়ে। পর্যটকদেরও পছন্দের জায়গা ছিল। তৈরি পোশাক শিল্প দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ঢুকেছিল শ্রীলঙ্কাতেই। কিন্তু সেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখন মরণ দশায়।

এশিয়ার এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক ও মানবিক সংকট চলছে। বিদেশি ঋণের বোঝায় ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। তলানিতে ঠেকেছে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দিন যতই যাচ্ছে এ সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। দেশটিতে এখন শুধু হাহাকার।

চরম আর্থিক সংকটে জর্জরিত দেশটিতে মূল্যবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এই মুহূর্তে দুধ সোনার চেয়েও মহামূল্যবান হয়ে উঠেছে। দুবেলা রুটি জোগাড়ের জন্য এক দোকান থেকে অন্য দোকানে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে অসহায় মানুষ। রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ায় এক হাজারের বেশি বেকারি বন্ধ হয়ে গেছে।

একটা ছোট পাউরুটির দাম এখন ১৫০ শ্রীলঙ্কান রুপি, মুরগির মাংসের দাম এতটাই বেড়ে গেছে, সাধারণ মানুষ তাদের বাজেট থেকে মুরগি বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। আর সরকারের হাতে নেই পেট্রোল, ডিজেল ও বিদ্যুৎ আমদানি করার মত অর্থ।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে দেশের মানুষকে দৈনিক ১৩ ঘন্টার বেশি লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। থমকে গেছে পরিবহন ব্যবস্থা। অফিস-আদালতের কাজ করতে হচ্ছে ঘরে বসে। অর্থের অভাবে কাগজ আমদানি করতে না পারায় এবছরের জন্য স্কুল-কলেজের সমস্ত পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে। নিউজ প্রিন্টের অভাবে বেশ কিছু সংবাদ সংস্থাকে সপ্তাহে একদিন করে প্রকাশনা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো এতটা দুরাবস্থায় পড়েনি দেশটি। এসবের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী কলম্বোজুড়ে। লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি করছেন।

আজকের শ্রীলঙ্কার এমন পরিস্থিতির জন্য বেশকিছু কারণ উল্লেখযোগ্য। গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কান সরকার বেশ কিছু মেগা প্রকল্প শুরু করেছে। এগুলো সবই দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প এবং এই প্রকল্পের অধিকাংশই আর্থিকভাবে লাভজনক হয়নি বা ভবিষ্যতে হবার কোনও সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

বৃহৎ একাধিক অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য চীন থেকে ঋণ নিয়েই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেমন, গভীর সমুদ্রবন্দর হাম্বানটোটা নির্মাণের জন্য চীন থেকে ১৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিয়েছিল ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু এই সমুদ্রবন্দর থেকে সামান্য যা আয় হয়, তা ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে পরিচালনার জন্য চীন থেকে ২ শতাংশ সুদ হারে আরও ৭৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণ নেওয়া হয়। তাতেও কাজ হয়নি। পরে চীনের কাছেই বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে।

চীনের ঋণে করা আরেক প্রকল্প হচ্ছে মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রায় জঙ্গলের মধ্যে করা এই বিমানবন্দরেরও আয় থেকে ব্যয় বেশি। যাত্রী ও উড়োজাহাজ ওঠানামা একবারেই কম। এই বিমানবন্দরকে এখন বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে ফাঁকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বর্তমান সংকটে শ্রীলঙ্কা নতুন করে আড়াই শ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে চীনের কাছে।

এছাড়া ২০১৯ সালের দুটি ঘটনাও শ্রীলঙ্কার আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ওই বছর কলম্বোয় তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরণ ২৫৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর নেমে আসে পর্যটনে ধস। জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ১০ শতাংশ। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপর চাপ বাড়ে।

অন্য ঘটনাটি হলো- প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের জনপ্রিয় পদক্ষেপ হিসেবে এক ধাক্কায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ ধার্য করা হয়। একই সঙ্গে ২ শতাংশ হারের নেশন উন্নয়ন কর (নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স), যত আয় তত কর (পে অ্যাজ ইউ আর্ন- পিএইউই) ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এর প্রভাব পড়ে রাজস্ব আয়ে। এক বছরেই দেশটির ভ্যাট আদায় কমে যায় ৫০ শতাংশ।

এরপরেই শুরু হয় করোনা মহামারী। সংক্রমণ পরিস্থিতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে দীর্ঘ দুই বছরে প্রবাসী-আয়, পর্যটন, রপ্তানি সবকিছুই কমে যায়। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশে। ৫ শতাংশের বেশি হলেই তা বিপদসংকেত বলে ধরা হয়। এর মধ্যেই ২০২১ সালের মে মাসে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের চাপ কমাতে রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে কমে যায় ফসল উৎপাদন। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ব্যয় নির্বাহ শুরু করলে বাড়ে মূল্যস্ফীতির চাপ।

দেশটির চলমান সংকট আশু সমাধানের রাস্তা এই মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তবে এটা ঠিক, আগামী দিনে দেশের প্রবৃদ্ধির পুনরুদ্ধারের জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে একযোগে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের সঠিক প্রয়োগ এবং পরিচালনার মধ্যে দিয়ে আগামী দিনে আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারে দেশটি। তার জন্য রপ্তানি বাড়ানো খুব জরুরি, আর রপ্তানি বাড়ানোর জন্য পণ্যের বৈচিত্র্য আনা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক, দৈনিক পূর্বদেশ।