জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : অনুমোদন ছাড়াই চট্টগ্রাম নগরে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার ভবন। এর মধ্যে অসংখ্য ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ ধরনের প্রায় ৫ হাজার ভবনের তালিকা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছে রয়েছে। যে ভবনগুলো ভেঙে না ফেলায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তবুও ভবনগুলো ভাঙতে পারছে না সিডিএ।
এর কারণ একুশে পত্রিকাকে জানিয়েছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে সিডিএ থেকে অবসরে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান। সিডিএ’র কার্যক্রম ও বিভিন্ন বিভাগ নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন তিনি। শাহীনুল ইসলাম খানের দাবি, সিডিএ’র মত নড়বড়ে সংস্থা আর নেই।
সিডিএ-তে প্রায় ৩০ বছরের কর্মজীবনে নিজের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি দেখছেন স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান। একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি কর্মজীবনে অবশ্যই আমার ব্যর্থতা বেশি। সাড়ে ১১ বছর আমি ইমারত নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছি। একের পর এক নকশা অনুমোদন করেছি। কিন্তু মানুষ সেই নকশা মেনে কাজ করেনি। এর সম্পূর্ণ দায় সিডিএ’র দুর্বল নীতিনির্ধারণ ও দায়িত্বে অবহেলা। আমি নিজেকেও এজন্য দোষারোপ করি।’
তিনি বলেন, ‘আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছি, তখন দেখি হাজার হাজার অনুমোদনহীন ভবনের (যেগুলো ভেঙে ফেলা দরকার) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি অনুমোদনহীন ভবনের তালিকা ছিল। কিন্তু এসব ভবনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। কখনো রাজনৈতিক চাপ, সিডিএ’র লোকবল ও যন্ত্রপাতি সংকট, কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় আমার দায়িত্ব আমি ঠিকভাবে পালন করতে পারিনি।’
‘তবে রাজনৈতিক চাপটা খুবই বেশি ছিল। বড় বড় নেতা, সরকার দলীয় লোক হরহামেশাই ফোন করে অনুরোধ করেছেন, এমনকি হুমকি দিয়েছেন। এমনও হয়েছে এসাইনমেন্ট নিয়ে তিনটি ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে (ভবন ভাঙতে) গিয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই আমাকে মাঝপথে ফিরে যেতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা আমাদের লোকজনের পিছনে মানুষ লেলিয়ে দিয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া মানুষের অসহযোগিতা, বিরোধ তো ছিলই।’
সিডিএ’র সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান জানান, নগরজুড়ে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে। ভূমিকম্প কিংবা দুর্যোগের ফলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা চট্টগ্রামে হতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে সিডিএ’র বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। দেখেও না দেখার, শোনেও না শোনার ভান করছে সংস্থাটি।
সিডিএ’র পরিকল্পনা বিভাগের দুর্বলতার কথা জানাতে গিয়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘সিডিএ’র মত উন্নয়ন সংস্থার একটি শক্তিশালী পরিকল্পনা বিভাগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ১৯৯৫ সালের মাস্টার প্ল্যানেও সিডিএ’র পরিকল্পনা বিভাগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া ছিল। কারণ যেকোনো প্রকল্পের প্রথম সিদ্ধান্ত একটি পরিকল্পনা বিভাগই দেবে। কিন্তু সিডিএ সেভাবে বিভাগটিকে তৈরি করতে পারেনি। সংস্থাটির সবচেয়ে দুর্বল বিভাগ হলো পরিকল্পনা বিভাগ।’
‘পরিকল্পনা বিভাগ এতোটাই দুর্বল যে, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের পদ ছেড়ে আমি যখন চলে আসি তখন অন্য কাউকে সেই পদে সিডিএ বসাতে পারেনি। যার কারণে সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব একজন পরিকল্পনাবিদকে না দিয়ে প্রধান প্রকৌশলীকেই অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করতে হয়েছে। বিষয়টি দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশের পাশাপাশি দুর্ভাগ্যজনক যে পরিকল্পনা বিভাগ চালানোর মত পরিকল্পনাবিদ সিডিএ’র নেই। বলতে গেলে সিডিএ’র মত নড়বড়ে সংস্থা আর নেই।’
এ স্থপতি আরও বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে একটা আউটলাইন দাঁড় করাতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত যত প্রকল্প গ্রহণ করেছে সিডিএতে সম্ভাব্যতা সঠিকভাবে যাচাইয়ের তেমন একটা রেকর্ড নেই। বাইরের দেশগুলোতে প্রকল্প বাস্তবায়নে যে সময় দেওয়া হয় তার চেয়ে অনেক বেশি সময় দেওয়া হয় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে। কিন্তু সিডিএতে সম্ভব্যতা যাচাই খুবই অবহেলার একটি বিষয়। শহরে এতবড় প্রকল্পগুলো যে ফেল করছে তার একটা বড় কারণ এটা।’
সিডিএ’র এই সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের মতে, গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে সৃজনশীল কোন কাজ সিডিএ করতে পারছে না। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের দোহাই দিয়েই কিন্তু এসব অপরিকল্পিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি। যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার খুবই পুরনো একটি সমাধান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্লাইওভারকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রামে জোরে ফ্লাইওভার নির্মাণ করে সিডিএ যানজটের সমাধান করতে চাইছে।
স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছে। সিডিএ’র আশ্বাসে মানুষ বিশ্বাস করেছে ফ্লাইওভার হলে যানজট কমে যাবে, কিন্তু ফ্লাইওভার হওয়ার পরও যানজট কমেনি বরং বেড়েছে। ফ্লাইওভার করার পরও যানজট কেন হচ্ছে, কোথায় ভুল ছিল, এ নিয়ে সিডিএ কোনো স্ট্যাডি করেছে? করেনি। সিডিএতে আমার কর্মজীবনে কর্তৃপক্ষকে আমি বারবার বলেছি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের খুবই জোর ও সময় দিতে হবে, যত্নবান হতে হবে।’
‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা যদি বলি, ফ্লাইওভার করার কারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলতে গেলে একধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ফ্লাইওভারগুলোর ব্যর্থতা থেকে আমরা সেই বিষয়টা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। জনবান্ধব এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার আগে সম্ভাব্যতা, ঝুঁকি এবং ব্যয় এই বিষয়গুলোতে কী ধরনের সমাধান করা দরকার তা আগে খুঁজতে হবে। আশা করছি, এ বিষয়গুলো অনুসরণ করেই কাজটা করা হচ্ছে। যদি করা না হয়ে থাকে তাহলে এটিও ফেল করবে।’
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এ পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘যে খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হবে সেই খালগুলোই এখন বন্ধ করে সেখানে সংস্কার করা হচ্ছে। তাহলে পানি যাবে কোথায়? খুবই স্বাভাবিক যে পানি সড়কে, ঘর-বাড়িতে চলে আসবে। আর এর ফলেই মানুষের ক্ষতি হচ্ছে, প্রাণহানির মত ঘটনাও ঘটেছে। সিডিএ’র যেটা করা উচিত সেটা হলো, দ্রততম সময়ে প্রবাহমান সকল খালকে এক্টিভ করে ফেলা। না হলে মানুষের ভোগান্তি বাড়তেই থাকবে।’
‘আমি মনে করি পূর্বের সময়ের মত খালগুলোকে যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। চট্টগ্রামে এতোগুলা খাল আছে। সবগুলো কিন্তু সংযুক্ত। খালগুলোতে পানি প্রবাহের পাশাপাশি নৌ চলাচলের সুযোগ যদি করে দেওয়া যায় তাহলে নগরবাসী যেমন উপকৃত হবে সরকারেরও রাজস্ব আয় হবে। যে পরিমাণ টাকা খরচ করে খালগুলোকে উদ্ধার করা হচ্ছে সিডিএ চাইলে খালগুলোকে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করতে পারতো।’
প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালের ২৬ এপ্রিল সহকারী স্থপতি হিসেবে সিডিএ’র মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন প্রকল্পে যোগদান করেন স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৫ সালের শেষের দিকে তাকে সিডিএ’র সহকারী প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে সিডিএ’র পরিকল্পনা বিভাগ তৈরির পর উপপ্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব পান তিনি। এরপর হন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই পদেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।