রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

ধ্বংসের জন্য পাঠানো ইয়াবা গায়েবের চেষ্টা পুলিশের!

প্রকাশিতঃ ১ জুন ২০১৭ | ১:৪৮ পূর্বাহ্ন

শরীফুল রুকন : আদালতে ধ্বংসের জন্য পাঠানো ৯৯০টি ইয়াবা গায়েব করার অপচেষ্টা করেছেন পুলিশের তিন সদস্য। গত ১৭ মে এ ঘটনা ঘটলেও তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। ইয়াবা গায়েবের চেষ্টার এ ঘটনায় আদালতপাড়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযুক্ত তিন পুলিশ সদস্য হলেন- আদালতের জিআর সেকশনের পতেঙ্গা থানার এএসআই মনিরুল ইসলাম, জিআর সেকশনের বাকলিয়া থানার কনস্টেবল নুুরুল ইসলাম ও মহানগর হাজতখানার কনস্টেবল গিয়াস উদ্দীন। ঘটনার পরই কনস্টেবল নুরুলকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে মাহফুজকে বসানো হয়েছে। তবে বাকি দুইজন গতকাল বুধবার পর্যন্ত স্বপদে বহাল ছিলেন।

পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় ৯৯০টি ইয়াবা ধ্বংসের জন্য আদালতের জিআর সেকশনের মাধ্যমে মহানগর হাকিম আদালতে আবেদন করে নগরের বাকলিয়া থানার পুলিশ। ০৭(০৫)১৭ মামলামূলে ১৭ মে ৯৯০টি ইয়াবা পাঠানো হয় ধ্বংসের জন্য। ইয়াবা ধ্বংসের জন্য বাকলিয়া থানার ওই আবেদন নিয়ে মহানগর হাকিম আল-ইমরান খানের কাছে যান পতেঙ্গার জিআরও এএসআই মনিরুল। আদালত আলামতগুলো ধ্বংসের জন্য অনুমতি দেন। পরে কোন কারণে ওই ইয়াবা ১৭ মে ধ্বংস হয়নি। অবশ্য ধ্বংস না হওয়ার বিষয়টি হাকিম আল-ইমরান খান নিজের রেজিস্টারে চিহ্ন দিয়ে রাখেন। পরদিন ১৮ মে দুপুরে ওই ৯৯০টি ইয়াবা এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের দক্ষিণ গেটের তুলাতলী এলাকায় বিক্রি করার উদ্যোগ নেন এএসআই মনিরুল ও কনস্টেবল নুুরুল।

এজন্য ঠিক করা হয় আদালতে পুলিশের খাবারের দায়িত্বে থাকা ‘মেস ম্যানেজার’ স্বপন ও আদালত এলাকার পান দোকানদার কাদেরকে। বেসরকারী এই দুই ব্যক্তি ইয়াবা নিয়ে যাওয়ার সাহস পাননি। তাই এই দুইজনের সাথে যাওয়ার জন্য ঠিক করা হয় হাজতখানার কনস্টেবল গিয়াস উদ্দীনকে। ১৮ মে দুপুর ১টার দিকে তুলাতলীর টং দোকানদার আলমের কাছে ইয়াবাগুলো নিয়ে যান এই তিনজন। খবর পেয়ে একই এলাকায় যায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা। ইয়াবা নিয়ে আটক হওয়ার আশংকায় একই এলাকায় আলমের ঘরে অবস্থান নেন ওই তিনজন।

এরইমধ্যে একাধিক মাদক মামলার আসামি আলম বিষয়টি জানিয়ে সাহায্য চান পূর্বপরিচিত আদালত পুলিশের কনস্টেবল শাহ আলমের কাছে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে শাহ আলম ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে চান, এই ইয়াবা কোথাকার। জবাবে কনস্টেবল গিয়াস তাকে জানান, মহানগর হাকিম আদালতের মুদ্রাক্ষরিক সাইফুল কাদের এসব ইয়াবা তাদেরকে বিক্রি করতে দিয়েছেন। সেদিন তারা সবাই কৌশলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নজর এড়িয়ে ওই এলাকা থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।

২১ মে এ বিষয়টি উল্লেখ করে মুদ্রাক্ষরিক সাইফুল কাদেরের কাছে জানতে চান কনস্টেবল শাহ আলম। সব শুনে হতবাক সাইফুল মহানগর হাকিম আল-ইমরান খানের কাছে নিয়ে যান শাহ আলমকে। সেখানে বিচারক ডেনে আনলেন মেস ম্যানেজার স্বপনকে। তখন স্বপন ঘটনার বিষয়ে উপরোক্ত বিস্তারিত বর্ণনা দিলে বিচারক আল-ইমরান খান বুঝতে পারেন এতে সাইফুল কাদের জড়িত নেই। এরপর ক্ষুব্ধ বিচারক একইদিন ডেকে আনেন কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও গিয়াস উদ্দীনসহ সংশ্লিষ্টদের। এরপর বিচারক নির্দেশ দেন ৯৯০টি ইয়াবা ফেরত দেয়ার জন্য। পরদিন ২২ মে সকালে অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী সহ অভিযুক্তরা ৯৯০টি ইয়াবা হাজির করে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে। এরপর বিচারক এসব ইয়াবা ধ্বংস করেন।

অভিযোগ উঠেছে, ৯৯০টি ইয়াবা তিন পুলিশ সদস্যের যোগসাঁজসে চড়া দামে বাইরে বিক্রি করে দেয়া হয়। পরে একটি থানার মুনশীর কাছ থেকে ৪২ টাকা দরে ৯৯০টি ইয়াবা কিনে নিয়ে আদালতে হাজির করেন তারা। এর আগে এ ঘটনা ধরা পড়ার পর তা ধামাচাপা দিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। ঘটনার ১৪ দিন পেরিয়ে গেলেও দুই পুলিশের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে মহানগর হাকিম আল-ইমরান খানের আদালতের মুদ্রাক্ষরিক সাইফুল কাদের বলেন, ‘তারা (অভিযুক্তরা) স্যারের (বিচারক আল-ইমরান খান) কাছে মাল (ইয়াবা) এনে দিয়েছে। সেদিন এডিসি (প্রসিকিউশন) সহ সবাই এসেছিল। স্যার জানেন আমি এসবে নেই। স্যার সব জেনে সংশ্লিষ্ট পুলিশকে বদলি করে দিতে বলেছেন।’

মহানগর হাজতখানার কনস্টেবল গিয়াস উদ্দীন বলেন, ‘গত ২১ মে স্যার (বিচারক আল-ইমরান খান) আমাকে ডাকলে আমি যাই। আদালতে এসে ইয়াবা কি জিনিস চিনেছি। কিন্তু আমি এসবে নেই, এসব বলতে পারবো না। আমার সহপাঠী কনস্টেবল শাহ আলম আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমার আর তার বাড়ি চাঁদপুরে একই এলাকায়। বাড়ির বিষয় নিয়ে দ্বন্ধের জেরে সে আমাকে এখানে জড়িয়ে দিয়েছে। আমার মান-সম্মান, ইজ্জত সব শেষ করেছে সে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আদালতের জিআর সেকশনের পতেঙ্গা থানার এএসআই মনিরুল ইসলাম ও আদালত পুলিশের কনস্টেবল শাহ আলম কোন কিছু বলতে রাজী হননি।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ আদালতের মুদ্রাক্ষরিক সাইফুল কাদের জানিয়েছেন, ইয়াবা হস্তান্তরের সময় আপনি ছিলেন; এ প্রশ্নেও একই জবাব দিলেন নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী, ‘আমি কিছু জানি না।’