শিকলেবাঁধা ১০ বছর!

আব্দুল্লাহ আল মামুন, পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি : সবাই থাকেন পরিপাটি, সাজানো গোছানো ঘরে। পরিবারের একজন থাকেন বাড়ির পেছনের জঙ্গলে, স্যাঁতস্যাঁতে পুঁতিগন্ধময় পরিবেশে। জীবজন্তুও এমন পরিবেশে থাকে না, থাকতে পারে না। কিন্তু এখানে এটাই বাস্তবতা। মানবসন্তান হয়েও তিনি থাকছেন ভয়াবহ অমানবিক পরিবেশে। গৃহপালিত পশুর মতো শিকলেবাঁধা জীবন পার করছেন গত ১০ বছর ধরে। এ হতভাগ্যের নাম আজাদ আলী (৪০)।

দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার চ-িপুর ইউনিয়নের বড় হরিপুর গ্রামের আফতাব উদ্দিন প্রামাণিকের ছেলে তিনি। আফতাব উদ্দিনের ৫ ছেলের মধ্যে আজাদ আলী কনিষ্ঠতম। পিতার বিশাল ভূসম্পত্তির দেখভাল ও কৃষিকাজ করে ভালোই কাটছিল তার জীবন।

দশ বছর আগে অন্য দশজনের মতো ডাকঢোল পিটিয়ে বিয়েও করেন তিনি। সুন্দর সংসার করছিলেন এলাকার কর্মঠ, বিনয়ী যুবক হিসেবে পরিচিত আজাদ। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই হঠাৎ মানসিক রোগী হয়ে উঠলেন আজাদ। এরপর যা হবার তাই হলো। স্বামীকে ফেলে বাপের বাড়ি চলে গেলেন সদ্য পরিণিতা স্ত্রী। ভরসা হয়ে থাকলেন তার ৪ সহোদর।

পিতা-মাতাহীন পরিবারে ভাইদের পরিচর্যা, চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবেন আজাদ আলী এমনটাই ভেবেছিলেন সবাই। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটাই হয়েছে। চিকিৎসার অভাবে আজাদের অবস্থার চরম অবনতি ঘটে দিনকে দিন। এখন তিনি বদ্ধপাগল, ছেঁড়াপাগল। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। গায়ে কাপড়ছোপড় থাকে না।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, পিতা আফতাব উদ্দিন প্রামাণিকের রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তিতে আজাদের অংশটি কুক্ষিগত করতে বাকি চার ভাই মিলে তাকে পাগল বানিয়ে রেখেছেন। লোকদেখানো কিছু চিকিৎসাপাতির উদ্যোগ নিলেও প্রকৃতপক্ষে তারা চান না আজাদ সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠুক।

তবে আজাদ আলীর ভাইয়েরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি এলাকার মানুষের অভিযোগ সত্য নয়।

বড়ভাই আলতাব উদ্দিন জানান, তাকে রংপুরের রফিকুল ডাক্তার এবং পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে আজাদ আলীকে চিকিৎসা করেছি। দুদুবার তাকে পাবনায় রেখে আসি। কিন্তু প্রতিবারই ৩ মাসের বেশি সে থাকতে পারেনি। মারামারি করে, আশপাশের ক্ষতিসাধন করে। পাবনা থেকে আনার পর বিভিন্ন কবিরাজকে দেখানো হয়েছে। তারা বলেছে জ্বীনের দৃষ্টি লেগেছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, তাকে সুস্থ করা যায়নি। শিকল খুলে দিলে মানুষের উপর চড়াও হয়, কামড় দিয়ে জখম করে, মানুষকে মারতে চায়। তাই শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। যোগ করেন আলতাব উদ্দিন।

তবে বাড়ির ভেতরে না রেখে বাড়ির পিছনের জঙ্গলে স্যাঁতস্যাঁতে অসাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে রাখার কারণ জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি তিনি।

সোমবার (২৯ মে) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্যাঁতস্যাঁতে অসাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে বাড়ির পিছনের জঙ্গলে বিবস্ত্র অবস্থায় দুচোখ বন্ধ করে মৃতের মতো শুয়ে আছেন আজাদ আলী। রোদ-বৃষ্টি, ঝড় সেখানে তার নিত্যসঙ্গী। বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাড়ির কোথাও তার থাকার একখ- জায়গা হয়নি। বিছানা, মশারীবিহীন ভেঁজা মাটিতে জঙ্গলের মধ্যে শিকলবন্দি অবস্থায় আজাদ আলী এখন মৃত প্রায় মানুষ।

এলাকাবাসী জানান, পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে আজকে তার এ অবস্থা। যথাযথ চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি তার প্রতি যতœবান হলে আজাদ আলী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। এ ব্যাপারে মানবিক হস্তক্ষেপ হস্তক্ষেপ কামনা করেন এলাকাবাসী।