চিত্তে যে তার অপার সুখ!

মোহাম্মদ রফিক : ‘চিত্তে যাদের সুখের অভাব, বিত্তে তারাই খোঁজে সুখ’ ..অর্থবিত্ত নাই বা থাকুক, চিত্তে যে তার অপার সুখ! ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় ৪০ বছরের সঞ্চয় উজাড় করে দিয়ে কবিতার কথার মতোই পরম সুখ খুঁজছেন চট্টগ্রামের বিশাল চিত্তের মানুষ কাজী মোহাম্মদ আলী। সারাজীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে নিজের পরিবারের অজান্তে এবং মানুষের অগোচরে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সাদামনের মানুষ।

নগরের হামজারবাগ এলাকার এই বাসিন্দা পুরো জীবনের সঞ্চয় গড়ে তুলেছেন গরিব মানুষের জন্য। পরিবারের বিশাল ঘানি টানতে গিয়ে নানা প্রকিকূলতার মধ্যেও আগলে রেখেছেন সেই সঞ্চয়। গেল সপ্তাহে রোগী কল্যাণ সমিতিতে সঞ্চয়ের ৫০ লাখ টাকা শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য দান করে দিয়েছেন।

বিশাল এই সঞ্চয় নিয়ে চাইলে অনেক কিছুই করতে পারতেন তিনি। শেষ বয়সে আরামআয়েশে থাকতে পারতেন। সন্তানদেরও দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেসব কিছুই না করে শুরুর সেই স্বপ্নই পূরণ করেছেন। পরিবারের সদস্যরাও তার এমন কর্মকাণ্ডে গর্ববোধ করেন। শিশুদের প্রতি তার এমন ভালবাসায় শুধু হামজারবাগ নয়, মুগ্ধ সারাদেশের মানুষও।

সাদেক হোসেন নামে তার এক প্রতিবেশি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মূল্যায়ন হয় তার চিত্ত বা হৃদয় দিয়ে। শুভ বিবেক, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব আর কল্যাণ চেতনার মধ্য দিয়েই যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এসব গুণ মানুষকে মহিমান্বিত করে। সৎ পথে উপার্জনের বিশাল সঞ্চয় এভাবে দান করে দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন কাজী মোহাম্মদ আলীর মতো মানুষেরাই। তার মানবিকতায় আমরা অভিভূত।’

মানবিক এ মানুষটির সাথে কথা বলতে আজ সোমবার সকালে হামজারবাগের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। এসময় তার সম্পর্কে ছোটভাই পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী রাশেদ আলী জাহাঙ্গীর বলেন, ‘জীবনের জন্যে ধনসম্পদ বা বিত্তের প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিত্ত মনুষ্যত্বের মাপকাঠি নয়। মনুষ্যত্বের কাছে ধনের আভিজাত্য ম্রিয়মান।’

বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এ মানুষটির প্রতিবেশী সাদেক মাহমুদ বলেন, ‘জগতে এমন লোকও আছে, বিত্তের অন্ধ মোহে যাদের আপন খেয়ালের তরীতে ভাসায়। নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকতে শেখায়। কিন্তু কাজী মোহাম্মদ আলী এর ব্যতিক্রম। চিত্তের বলেই তিনি মানুষকে ভালবাসতে পেরেছেন। সারাজীবনের সঞ্চয় উজার করে দিলেন ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায়। এটা অনন্য দৃষ্টান্ত।’

আরেক প্রতিবেশী আজম খান বলেন, ‘আমাদের সমাজের ধনীরা আত্মসুখে মগ্ন থাকেন। কিন্তু এ সুখ প্রকৃত সুখ নয়। তাদের বিত্ত-ভৈবব থাকলে কী হবে, যদি চিত্তের ঐশ্বর্য না থাকে তাদের যত ধনসম্পদই থাকুক প্রকৃত বিচারে সে মানুষই নয়। সমাজে চিত্তহীন বিত্তশালীরা নানাভাবে সমাজকে কলুষিতই করেই চলেছেন। অপরদিকে বিত্তশালী না হয়েও যার সুন্দর ও উদার হৃদয় রয়েছে তিনি সবার কাছে আদৃত। তার হৃদয়ের স্পর্শে আলোকিত হয় অন্য মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র। শ্রদ্ধারভাজন কাজী মোহাম্মদ আলী সাহেব এমনই একজন সাদা মনের মানুষ।’

৪০ বছরের সঞ্চয় দান করে দিয়েছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনেছেন চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আলী আক্কাস নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘ধনসম্পদ ক্ষণস্থায়ী। বিবেক-মনুষ্যত্ব চিরস্থায়ী। বিত্তের চেয়ে চিত্ত বড়। অর্থসম্পদ যদি মানবকল্যাণে না আসে, তবে এর মূল্য নেই। সংকীর্ণমনা ব্যক্তি সম্পদশালী হলেও স্মরণীয় বা বরণীয় হতে পারে না। ধনের বলে সমাজে সাময়িকভাবে সমাদৃত হলেও মানুষের মনে তারা স্থায়ী আসন করে নিতে পারে না। মোহাম্মদ আলী সাহেব বর্তমান ভোগবাদী সমাজে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।’

স্থানীয় বাসিন্দা বখতেয়ার উদ্দিন বলেন, ‘কাজী মোহাম্মদ আলী সাহেব মানবদরদি ও মানবহিতৈষী। তাকে দেখলে আমাদের মাথা আপনিই নত হয়ে আসে।’

র‍্যাংকস এফসি প্রপার্টিজের সিইও তানভীর শাহরিয়ার রিমন ফেসবুক কাজী মোহাম্মদ আলী সম্পর্কে লিখেন, “আমি রিয়েলএস্টেট পেশায় যুক্ত আছি প্রায় ২০ বছর। বহু মানুষকে দেখেছি জীবনে তিল তিল করে সঞ্চয় করে সেই জমাজাটি এক করে একটা ফ্ল্যাট কিনতে। কিন্ত বিশ্বাস করেন, আমার জীবনে এমন ঘটনা শুনি নাই যে, কোনো ব্যক্তি ৪০ বছর ধরে টাকা জমিয়ে সেই টাকা দান করে দিয়েছেন যখন কিনা নিজেরই টানাটানি সংসার । এক-দুই টাকা নয়, শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য হামজারবাগ এলাকার কাজী মোহাম্মদ আলীর ৫০ লাখ টাকা দানের এই বিরল ঘটনা সত্যি থট প্রভোকিং…। টাকা পয়সায় ধনী মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দেশে আলী সাহেবের মতো হৃদয়বান মানুষের সংখ্যা বাড়া দরকার। আপনি কতটা ধনবান তা নয়, বরং আপনি কতটা হৃদয়বান সেটা গুরুত্বপূর্ণ। মোহাম্মদ আলী স্যার, আপনাকে জানাই লাল সালাম!”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন কাজী মো. আলী। এ প্রসঙ্গে ডা. বিজয় কৃষ্ণ সরকার নামে এক ব্যক্তি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের সমাজে প্রয়োজন কাজী মো. আলীর মতো একজন চিত্তশালী ব্যক্তি। তার চেয়ে ভোগ বিলাসের এ সমাজে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে?’

আজ সোমবার সকালে নিজ বাসভবনে আলাপকালে কাজী মোহাম্মদ আলী একুশে পত্রিকাকে জানান, তার বাবার নাম কাজী মোহাম্মদ আবদুল করিম। তিনি রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তার (বাবার) ছয় ছেলে। তিন মেয়ে। ছেলের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবার বড় সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। নিজে চাকরি করতেন একটি ওষুধ কোম্পানিতে। সেসময় দেখেছেন হাসপাতালে চিকিৎসার অভাবে কাতরাতে থাকা মানুষগুলোর আর্তনাদ। এসব দেখে সহ্য হচ্ছিল না তার। মানুষের জন্য কিছু করার নেশা তাকে পেয়ে বসে। একদিকে তার যুদ্ধ নিজের অনটনের সংসার নিয়ে। অন্যদিকে চলছে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করার প্রত্যয় নিয়ে নিজের সত্ত্বার সাথে যুদ্ধ।

কাজী মো. আলী জানান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে একটি ওয়াকফ হিসাব খুলে টাকাটা জমা করে রেখেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির নামে। বছরে সেখান থেকে পাওয়া ৪ লাখ টাকা মুনাফা শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ব্যয় করবে রোগী কল্যাণ সমিতি। ৪০ বছরের সঞ্চয় কেন ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায় ব্যয় করছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে কাজী মোহাম্মদ আলী জানান, দুই দশক আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার এক বোন। এ শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠেতেই এ ঘটনার পাঁচ পর একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার ভাগনি নাহিদা সোমা। এর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন কাজী মো. আলীর নানাও। একের পর এক আপনজনের এমন মৃত্যু দেখে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া শিশুর জন্য কিছু করার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তবে প্রকাশ্যে নয়, গোপনে এই মিশন শুরু করেন কাজী মো. আলী।

‘আমি ৫০ ভাগ খুশি হয়েছি টাকাটা তুলে দিতে পেরে। আমি একশভাগ শান্তি পাব, যখন শুনব আমার সহায়তায় ক্যান্সার আক্রান্ত কোনো শিশু চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছে।’

১৯৬৬ সালে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে একটি ওষুধ কোম্পানিতে যোগ দেন কাজী মো. আলী। গরিব রোগীদের ওষুধ কিনে দিতেন। অনেককে নগদ টাকাও দিতেন। ১৯৮০ সাল থেকে ‘টিনের কৌটায়’ টাকা জমাতে শুরু করেন তিনি। কাজী মোহাম্মদ আলী জানান, প্রথম দিকে তিনি ফাইজার কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলাম। বেতনের টাকা দিয়ে চলত তার সংসার। ওষুধ কোম্পানিকে চাকরি করার সুবাদে হাসপাতালে ছটফট করতে থাকা গরিব রোগীদের দেখে খুব কষ্ট পেতেন তিনি। এসব দেখে নীরবে কাঁদতেন। এরপর থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের জন্য সঞ্চয়ের চিন্তা করেন। ইনসেনটিভ ও যাতায়াত খরচের টাকা ‘টিনের কৌটায় গোপনে জমানো শুরু করেন। ২০০০ সালে বেশ কিছু টাকা জমা হলো। পরে মা ও বাবার নামে ‘কাজী অ্যান্ড হোসনে ফাউন্ডেশন’ নামে ব্যাংক হিসাব খুলে জমানো টাকা সেখানে রাখতে শুরু করেন কাজী মো. আলী। এবার সঞ্চয়টা বাড়ানো চিন্তায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ব্যবসায়ীদের টাকা ধার দেয়া শুরু করেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া সুদসহ আসল টাকাটা তার মা-বাবার নামে করা ফাউন্ডেশনের হিসাবে জমা করতেন ভবিষ্যতে দান করবেন বলে। তবে বিষয়টি জানতেন না তার পরিবারের সদস্যরা। একসময় পরিবারের সদস্যদের তিনি জানালেন, তার জমানো টাকা চমেক হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতিতে দান করবেন। কিন্তু টাকার অঙ্কটি ৫০ লাখ হওয়ায় পরিবারের কিছু সদস্য প্রথমদিকে আপত্তি তুললেও শেষতক মানবতার যুদ্ধে জয়ী হন কাজী মো. আলীই। অবশেষে ৪০ বছর ধরে জমানো সেই ৫০ লাখ চমেক হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির কাছে হস্তান্তর করেন তিনি। ওয়াকফ হিসাবের মূল টাকা ব্যাংক থেকে আলী বা তার স্বজন এমনকি রোগী কল্যাণ সমিতিও তুলতে পারবেন না। কেবল বছর শেষে মুনাফা পাবে সমিতি।

কাজী মো. আলী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি ৫০ ভাগ খুশি হয়েছি টাকাটা তুলে দিতে পেরে। আমি একশভাগ শান্তি পাব, যখন শুনব আমার সহায়তায় ক্যান্সার আক্রান্ত কোনো শিশু চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছে।’