সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

কোর্ট বিল্ডিংয়ে দোকান বানিয়ে ২০ বছর ধরে ভাড়া তুলেন আদালতের কর্মচারী!

প্রকাশিতঃ ১৪ এপ্রিল ২০২২ | ২:১২ অপরাহ্ন


আবছার রাফি : চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় জেলা প্রশাসনের জায়গা দখল করে অবৈধভাবে অন্তত দুটি দোকান বানিয়ে ২০ বছর ধরে ‘ভাড়া’ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম আদালতের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে।

অভিযুক্ত মো. ইলিয়াস চট্টগ্রামের জেলা জজ আদালতের গাড়িচালক বলে উক্ত আদালতের ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে। তবে ইলিয়াসের দাবি, তিনি এখন জেলা জজ আদালতের অধীনস্ত একটি আদালতের সেরেস্তাদারের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন।

অভিযোগ আছে, জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে থাকা দুটি দোকান থেকে অগ্রিম ও মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া বাবদ মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আদালত কর্মচারী ইলিয়াস। দোকান দুটি ভাড়া নিয়েছেন আবুল কালাম সওদাগর ও শাহ আলম সওদাগর নামের দুই ব্যক্তি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আবুল কালামের কাছ থেকে সালামি হিসেবে দেড় লাখ টাকা অগ্রিম ও মাসিক ভাড়া ৩ হাজার টাকা ধরে ২০ বছরের চুক্তি করা হয়েছে। অপরদিকে শাহ আলমের কাছ থেকে সালামি হিসেবে ৪ লাখ টাকা ও মাসিক ভাড়া ৯ হাজার টাকা ধরে ৪ বছর মেয়াদে চুক্তি করা হয়েছে।

সোমবার (১১ মার্চ) সরেজমিন কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রমজানের দিনেও কালো পর্দা টাঙিয়ে ভেতরে খাবার-দাবারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন দুই দোকানদার। দোকানদার আবুল কালামের কাছে দোকান ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘এখানে জেলা জর্জ কোর্টের লোকজন জড়িত। এগুলার মধ্যে ভেজাল আছে? এগুলো বলে লাভ নাই।’ কাকে ভাড়া দেন, কত টাকা ভাড়া দেন- এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল কালাম বলেন, ‘আপনি চিনবেন না।’

অন্যদিকে শাহ আলমের দোকানে গেলে করিম নামের এক ব্যক্তি নিজেকে ওই দোকানের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে দোকানমালিক শাহ আলম নেই বলে জানান। কোনো বিষয় থাকলে তার সাথে আলাপ করার কথা বলেন। এ সময় দোকান কার থেকে, কত টাকায় ভাড়া নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর্মচারী সমিতির কাছ থেকে নিয়েছে। আর বেশি কিছু বলতে পারবো না।’ এক পর্যায়ে দোকানদার শাহ আলমের ফোন নাম্বার চাওয়া হলে নাম্বারটি দিতে অস্বীকৃতি জানায় কর্মচারী পরিচয় দেওয়া করিম।

আদালত এলাকায় কর্মরত একজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আগে জেলা জজ আদালতের গাড়ি চালাতেন ইলিয়াস। ৫-৬ মাস আগে তিনি জারিকারক পদে প্রমোশন পেয়েছেন। ২০ বছর ধরে ইলিয়াস ওই জায়গাটা দখল করে রেখেছেন। প্রথমে ১ হাজার, পরে ২ হাজার; এভাবে করতে করতে তার দুইটা দোকানের ভাড়া এখন প্রতি মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা। যার একটাতে ৯ হাজার, আরেকটাতে ৩ হাজার টাকা। গত ৮ বছর আগে নতুন করে আবার চুক্তি করেছে দোকানদারদের সাথে। জেলা জজ কোর্ট যখন পুরাতন অফিসে ছিল তখন এসব দখল করেছেন। জেলা প্রশাসন ও আদালতের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, স্টাফ মিলে একটা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে; তারাই কোর্ট বিল্ডিংয়ে অবৈধ দোকান থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আদালতের কর্মচারী মো. ইলিয়াস একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দোকান করেছি, এটা সত্য। কিন্তু আপনাকে এই কথা কে বলেছে?’ সোর্সের নাম জানানো যাবে না বললে ইলিয়াস বলেন, ‘জানতে পারি না? জানলে অসুবিধা কী? অগ্রিম টাকা যা নিয়েছি সেটা ঘর মেরামত করতে খরচ হয়েছে, সেটা নেয়া হয়েছে। ভাড়া হিসেবে একটা পরিমাণ দেয় আরকি।’

আবুল কালামকে দোকান ভাড়া দেয়ার বিষয়ে ইলিয়াস বলেন, ‘এক সময় কালাম ঘুর ঘুর করতো। ওখানে দোকানের প্রয়োজন ছিল, তারপর কালামকে আমরা বললাম যে, ঠিক আছে তুই এখানে বসি দোকানদারি কর। এরপর সে বিভিন্নভাবে লোভ লালসা দেখিয়ে বলল যে, আমি একটা দোকান বানাবো আর আপনাদেরকে কিছু অনুদান দেব। বলেছি, দিলে সমিতির মাধ্যমে দিতে হবে। পরে সমিতি টমিতি ভেঙে গেছে এরপর থেকে আমরা নিই।’

করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে কেউ ভাড়া দেয়নি দাবি করে ইলিয়াস বলেন, ‘ওই জায়গাটা এখন যদি সরকারের প্রয়োজন হয়, সরকার নিয়ে যাবে। এখানে তো কারও কোন দায়বদ্ধতা নেই। আমি কারও কাছে তো বিক্রি করে দিইনি। তখন একটা সময়-সুযোগ ছিলো। আমরা ওইদিকে ছিলাম। তখন কালামকে করতে দিয়েছি। এরপর কালামের লাভ দেখায় ইকবাল নিয়েছে। এরপর ইকবাল কী করছে, কারে কী দিছে; এটা আমরা জানি না। কালামের পাশের দোকানটা ইকবাল নিয়েছিল। তারপর সে এখানে একটা ঘর বানিয়ে ফেলছে। কালামের সাথে আঁতাত করে ঘর বানিয়ে সে ঝামেলাটা লাগিয়েছে।’

‘২০ বছর আগে জেলা জজ আবদুর রহমান পাটোয়ারী স্যার থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে গরিব মানুষ হিসেবে তাদের বসিয়েছিলাম।’ স্বীকারোক্তি আদালতের কর্মচারী মো. ইলিয়াসের।

শুধু এই দুটি দোকান নয়, সেখানে জজ কোর্টের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের একটি কর্মচারী সমিতির অফিস আছে। পাহাড়ের পাদদেশে দুইতলা পাকা অফিসটি পরিবশ অধিদপ্তর, সিডিএ- কারও অনুমতি না নিয়ে রাতারাতি তৈরি করা হয়েছিল।

কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় শুধু এসব স্থাপনা নয়, আরও অনেক দোকানপাট, খাবার হোটেল, মুদি দোকান, বস্তি ইত্যাদি রয়েছে; যা থেকে মাসিক ও দৈনিক ভাড়া উত্তোলন করা হয় বলে অভিযোগ আছে। এর মধ্যে কিছু অবৈধ স্থাপনা অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে হিসেবে পরিণত হয়েছে। এমন অরাজকতার সুযোগ নিয়ে ২০১২ সালে কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় জঙ্গি হামলাও হয়েছিল।

এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরীর পাহাড়ে (কোর্ট বিল্ডিং) অবৈধ স্থাপনা যাতে না হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইন ও বিচার বিভাগকে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।’

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মমিনুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মু. মাহমুদ উল্লাহ মারুফ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে পর্যন্ত নির্দেশনা এসেছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’