রানা আবির : চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেডের কলসি দিঘির পাড় থেকে আনন্দবাজার পর্যন্ত চলাচল করছে শতাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা। প্রায় সব কটিই অবৈধ, লক্কর-ঝক্কর। ‘গ্রাম সিএনজি অটোরিকশা’ হিসেবে পরিচিত গাড়িগুলোর ‘ডিজিটাল নাম্বার প্লেট’ নেই। আইন অনুযায়ী, এসব অবৈধ অটোরিকশাগুলোর চট্টগ্রাম নগরে চলার সুযোগ নেই। কিন্তু চলছে নিয়মিত।
কীভাবে চলে এমন অটোরিকশা? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, লাইনম্যান হিসেবে পরিচিত মনির নামের এক ব্যক্তি অবৈধ সিএনজি অটোরিকশাগুলোর চালকের কাছ থেকে দৈনিক চাঁদা তোলেন। প্রতিটি অটোরিকশা থেকে দৈনিক চাঁদা নেয়া হয় ২৫০ টাকা। অন্তত একশটি অটোরিকশা থেকে ২৫০ টাকা করে তোলা হলে দৈনিক টাকা উঠে ২৫ হাজার টাকা। মাসে উঠে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এই টাকা কোথায় যায়? জানতে চাইলে লাইনম্যান মনির বলেন, ‘টাকা সব জায়গায়ই দিতে হয়। টাকা দেওয়ার পরও গাড়ি ধরে নিয়ে যায় ফাঁড়ি ও ট্রাফিক পুলিশ।’ এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি মনির। তবে চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা বন্দর থানার সল্টগোলা ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ির আওতাধীন এলাকা দিয়ে গাড়ি চালান।
মনিরের ভাষ্য, ‘সব জায়গায় টাকা দিতে হয়’- এ বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক অটোরিকশা চালক জানান, শুধু পুলিশ নয়, ক্ষমতাসীন দলের নামধারী কিছু ব্যক্তিকেও চাঁদা দিতে হয়। নয়তো গাড়ি চালানো যায় না।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে টেকপাড়া এলাকার একজন বাসিন্দা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কলসি দিঘির পাড় থেকে আনন্দবাজার পর্যন্ত এই রাস্তা সরু। এমন একটি রাস্তায় অবৈধ সিএনজি অটোরিকশাগুলো চালাচ্ছে অদক্ষ চালকরা। এতে ঘটে নানা দুর্ঘটনা।’ তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘পুলিশ ম্যানেজ না হলে এ ধরনের অবৈধ গাড়িগুলো তাদের নাকের ডগায় কীভাবে চলছে?’
এদিকে সল্টগোলা ক্রসিং থেকে টেকপাড়া হয়ে আনন্দবাজার পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত চলে প্রায় দেড়শ’ টমটম। ওই সড়কে এই গাড়িগুলোও চালানোর অনুমতি নেই। কিন্তু চাঁদার জোরে টমটমগুলো চলছে। প্রতিটি টমটম থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হয় ১৩০ টাকা। প্রতিদিন একশ টমটম থেকেও যদি ১৩০ টাকা করে তোলা হয়, তাহলে উঠে ১৩ হাজার টাকা। মাসে উঠে ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
এই টমটম গুলো থেকে চাঁদা তোলার কাজটি করেন যুবলীগ নেতা নামধারী মাসুম; চাঁদা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে আমি সবসময় লাইন নিয়ন্ত্রণ করতাম। কিন্তু এখন কিছুদিন করি। পুলিশকে টাকা দেওয়ার যন্ত্রণা আর ভাল লাগছে না।’
একই সড়কে চলাচল করে তিন চাকা বিশিষ্ট ‘এইচ পাওয়ার’। গাড়িগুলোর আবার নিবন্ধন নাম্বার আছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আনন্দবাজার পর্যন্ত চলাচল করার জন্য ১৩০টি ‘এইচ পাওয়ার’ গাড়িকে অনুমতি দিয়েছে বিআরটিএ; যদিও এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ওই সড়কে ‘এইচ পাওয়ার’ চলাচল করছে প্রায় ২৩০টি।
‘এইচ পাওয়ার’ থেকে চাঁদা আদায়ের কাজটি করেন মো. বিপ্লব নামের এক ব্যক্তি। চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বিপ্লব বলেন, ‘আপনি নিউজ করেন সমস্যা নাই।’
ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগায় কীভাবে চলছে এতগুলো অবৈধ গাড়ি, জানতে চাইলে সল্টগোলা ক্রসিংয়ের ট্রাফিক পরিদর্শক মো. বশির একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পাড়ার ভেতরে হয়তো এসব পরিবহন চলছে। কিন্তু আমার দায়িত্ব প্রধান সড়ক নিয়ন্ত্রণ করা, ভেতরের সড়ক নয়। এই ব্যাপারে কোনও অভিযোগ থাকলে ডিসি স্যারকে বলুন। আমার স্পষ্ট কথা, আমি কোনও টাকা-পয়সা নিই না।’
একই বিষয়ে মধ্যম হালিশহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই শরিফুজ্জমান ভূঁইয়া একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘গাড়ি থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আর গাড়ি দেখার দায়িত্বও আমার না। পরিবহনের সাথে ট্রাফিক বিভাগের সম্পর্ক।’
বন্দর থানার ওসি জাহেদুল কবির একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ওই সড়কে কিছু অবৈধ গাড়ি চলে, সেটা জানি। তবে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে কিছুই জানা নেই আমার। তবে কেউ যদি চাঁদাবাজির অভিযোগ করে তাহলে ব্যবস্থা নেব।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক-বন্দর) শাকিলা সুলতানা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অবৈধ গাড়ির ব্যাপারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমার কাছে তথ্য আসলেই সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কোনও পুলিশ সদস্য যদি অনৈতিক লেনদেনে জড়িত হয়ে এসব অবৈধ পরিবহন চলাচলে সহায়তা করে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) শামশুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অবৈধ গাড়ি থেকে পুলিশের চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা ছিল না। আপনার কাছ থেকে জানলাম। আপনি প্রতিবেদন প্রকাশ করুন। চাঁদাবাজির প্রমাণ পেলে জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’