মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী : মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘কুল্লনাফসিন জা’য়িকাতুল মউত’। প্রত্যেক নফসকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এই স্বাদ দুনিয়ার সব স্বাদ বিনাশ করে। নফসের মৃত্যু হয় কিন্তু রুহের মৃত্যু হয় না। রুহের সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’ –অর্থাৎ আল্লাহর নিকট হতে আগমন এবং আল্লাহর নিকট প্রত্যাগমন হয়।
পৃথিবী নামক গ্রহটির মাঝে আজ যারা আছি, তারা এক সময় ছিল না, আরেক সময় সবাই নাই হয়ে যাবে। এটিই বিধাতার বিধান। অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আমাদের দুনিয়াতে আসা। কোনও শিশু সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার ডান পাশে আজান এবং বাম পাশে ইকামত দেওয়া ইসলামের বিধান। আজান ইকামতের পর নামাজের শুরু। ভূমিষ্ঠ শিশুর জন্মের পর আজান-ইকামত এবং মৃত্যুর পর জায়নাজার নামাজ আদায় করতে হয়। আজান ইকামতের মাঝখানে সংক্ষিপ্ত সময়টুকুই আমাদের জীবন।
ইসলামের একজন সেরা দার্শনিক আল্লামা ঈমাম গাযযালী (রাহ.) লিখেছেন, ‘আমরা যখন নিদ্রামগ্ন থাকি তখন স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নগুলো আমাদের বাস্তব মনে হয়। নিদ্রাভঙ্গের পর স্বপ্নগুলো কাল্পনিক মনে হয়, এ জগৎটিই মনে হয় বাস্তব। ইহজগৎ ত্যাগ করে যে দিন পরজগতে গমন করবো সেদিনই বুঝতে পারবো দুনিয়ার জগৎটা স্বাপ্নিক, পরকালটাই বাস্তব ও স্থায়ী।
আমাদের জীবনটা ক্ষণস্থায়ী হলেও অত্যন্ত মূল্যবান। এই সংক্ষিপ্ত জীবনের মাঝেই হতে হয় পুলসিরাত পর। সূরা ফাতিহায় বর্ণিত ‘ইহদিনাস্ সিরাতোল মোস্তাকিম’ সরল সঠিক পথে চলার প্রার্থনা করি।এই দুনিয়ার সঠিক পথ অতিক্রম করতে সক্ষম হলে পুলসিরাত পার হওয়া সহজ। জান্নাতও এই দুনিয়ায় অর্জন করতে হয়। তাই দুনিয়ার সংক্ষিপ্ত সময় অত্যন্ত মূল্যবান।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না, ধার করা যায় না, জমাও রাখা যায় না, টাকা দিয়ে ক্রয় করা যায় না তার নাম ‘সময়’। সময়ের মূল্য মানে জীবনের মূল্য। আমরা গাড়ির মূল্য বুঝি, বাড়ির মূল্য বুঝি, নারীর মূল্য বুঝি, সম্পদের মূল্য বুঝি কিন্তু জীবনের মূল্য বুঝি না। যে ব্যক্তি সময়ের মূল্য দেননি, সময় সে ব্যক্তির নিকট চরম প্রতিশোধ নিয়েছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না, ধার করা যায় না, জমাও রাখা যায় না, টাকা দিয়ে ক্রয় করা যায় না তার নাম ‘সময়’। সময়ের মূল্য মানে জীবনের মূল্য। আমরা গাড়ির মূল্য বুঝি, বাড়ির মূল্য বুঝি, নারীর মূল্য বুঝি, সম্পদের মূল্য বুঝি কিন্তু জীবনের মূল্য বুঝি না। যে ব্যক্তি সময়ের মূল্য দেননি, সময় সে ব্যক্তির নিকট চরম প্রতিশোধ নিয়েছে।
মানুষের বিদায়বেলায় রুহ আজরাইলের, সম্পদ ওয়ারিশের শরীরের মাংস পোকা মাকড়ের হাড় মাটির, শুধু মাত্র আমলই নিজের। আমল বা কৃতকর্মই আমাদের সাথে যাবে,আলমের ফল ভোগ সকলকেই করতে হবে।
একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন শূন্যহাত মুষ্টিবদ্ধ থাকে, কিন্তু যখন মৃত্যুবরণ করে মানুষ তখন কোনো অবস্থাতেই হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করানো যায় না। মানুষ দুনিয়া হতে কোনও কিছুই চলে যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে পারে না। শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়। এটি আমাদের জন্য বড় শিক্ষা।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘দ্য লাস্ট জ্যাকেট হ্যাজ নো পকেট’ শেষ কাপড়ের (কাপনের কাপড়) পকেট নেই। আলেকজেন্ডার দ্য গ্রেড দুনিয়া হতে বিদায় নেওয়ার পূর্বে তিনটি অসিয়ত করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর দুটি হাত যেন কফিনের বাইরে প্রসারিত রাখে। কারণ বিশ্ববাসী যেন দেখেন, বিশ্ববিজেতা বীর খালি হাতে ফেরত যাচ্ছেন। তাঁর কফিনটা যেন ডাক্তারের কাঁদে তুলে দেন, কারণ ডাক্তাররা দাবী করেন তারা মানুষ বাঁচান, তারা আমার মত অর্থবিত্ত ক্ষমতাধর মানুষ বাঁচাতে পারলো না।আর আমার সম্পদ সোনা রূপা, হিরা, টাকা সবগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে দিবে কারণ এসব আমার কোনও কাজে আসল না।
স্টিভ জবস, পৃথিবীর সেরা ধনীদের অন্যতম। এপেল কম্পিউটারের মালিক। কয়েক বছর পূর্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়ে বললেন, আমি আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। কিন্তু যমদূতকে আমি সমস্ত সম্পদ অর্পণ করেও একটি রাত বেশি বাঁচার কোনও উপায় নেই। এই হলো আমাদের জীবন।
স্টিভ জবস, পৃথিবীর সেরা ধনীদের অন্যতম। এপেল কম্পিউটারের মালিক। কয়েক বছর পূর্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়ে বললেন, আমি আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। কিন্তু যমদূতকে আমি সমস্ত সম্পদ অর্পণ করেও একটি রাত বেশি বাঁচার কোনও উপায় নেই। এই হলো আমাদের জীবন।
মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টি আল্লাহর আইন মানতে বাধ্য। কিন্তু জ্বীন ও ইনসানকে আল্লাহপাক দিয়েছেন ইচ্ছার স্বাধীনতা, এই দুনিয়ায় জ্বীন এবং ইনসান চাইলে মহান আল্লাহর আইন মানতে পারে, নাও মানতে পারে। কয়েকটি বিধান মানুষ মানতে বাধ্য। যেমন জন্ম-মৃত্যু দুর্ঘটনা। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বর্তমানে অসম্ভবকে করেছে সম্ভব। মানুষ যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারে না। এই ক্ষমতা মানুষের নেই। যত ক্ষমতাবান মানুষই হোক তাঁকে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হতে হবে। মানুষের ক্ষমতা মৃত্যুর কাছে অসহায়।
জন্মের পর মায়ের দোলনায় দোল খেতে খেতে জীবনের শুরু, বেড়ে উঠা, মৃত্যুর পর আরেক দোলনায় করে কবরে যাওয়া। দোলনা দিয়ে জীবন শুরু দোলনা দিয়ে জীবন শেষ। এই তো আমাদের জীবন। যতক্ষণ অসুস্থতায় না পড়ি ততক্ষণ বুঝতে পারি না, সুস্থতা মহান আল্লাহর কত বড় নেয়ামত। যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ বুঝতে পারি না জীবনের দাম কত! যে দিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আরেকটা নিঃশ্বাস নিতে পারবো না, সেদিন বুঝবো জীবনের মূল্য কত। কিন্তু তখন কিছুই করার থাকবে না। মৃত্যু তো একটি ওয়ানওয়ে ব্যবস্থা, একবার মারা গেলে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এমনভাবে দুনিয়াতে বসবাস কর যেন তুমি একজন মুসফির, অর্থাৎ পথ অতিক্রমকারী।
আমরা জন্মেছি মৃত্যুর জন্য। জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে যদি মানুষের জন্য কিছু করা যায় তা হবে জীবনের সার্থকতা।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যিনি মহামানবতার সেবায় নিজের জীবনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেন তিনিই মহামানব।
আজ মহামানব নয়, একজন নেহায়েত সাধারণ স্বাভাবিক মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। যে মানুষ সমাজের উপকার নয়, অপকার করে না, যে ন্যায় কাজ নয়, অন্যায় করে না, যে ভালোবাস নয় অন্তত ঘৃণা করে না, এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে, অথচ মানবকল্যাণই শ্রেষ্ঠ ইবাদত।
একশ্রেণির মানুষ আছে, ভোগবাদি। তারা বলে, ‘জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়’ অর্থাৎ শরীরে জান আছে তো আমার জন্য দুনিয়া আছে। আমি যদি না থাকি পৃথিবীটা স্বর্ণের দিয়ে মুড়িয়ে দিলে আমার কী? সাগরের সব পানি শরবত হলে আমার কী? তারা বলে, আমি না থাকলে কী হবে আমার শিল্পসাহিত্য প্রতিষ্ঠান দিয়ে!
আসলে এধরনের মানুষগুলো স্ববিরোধী। এসব মানুষগুলোও তাদের সন্তানদের যেন যোগ্য ও শিক্ষিত সে চেষ্টায় থাকে। সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে মরণপণ লড়াই করে। তারা বেঁচে থাকতে চায় সন্তানদের মধ্যে দিয়ে ।এতে আত্মস্থ হয় যে, মৃত্যুর পর স্বার্থপর মানুষগুলোও বেঁচে থাকতে চায়। পরিশেষে বলতে চাই, মানুষের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে মৃত্যু নিয়ে নয়। ইহকালের মধ্যে আছে পরকালের মুক্তি। তাই জীবনের মূল্য আত্মস্থপূর্বক সময়কে কাজে লাগানো উচিৎ।
মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী কলাম লেখক, রাজনীতিক