এম কে মনির : হাইকোর্ট থেকে স্থিতাবস্থার (স্ট্যাটাস কো) আদেশ নিতে অন্তত সাতটি ‘পরিবেশ ছাড়পত্র’ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে; সবকটি রিটেই বাদী পক্ষে আছেন সজল মল্লিক নামের একজন আইনজীবী।
এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্টের দেয়া একটি আদেশ পেয়ে রাঙামাটির কাউখালীর বেতবুনিয়ার সুগারমিল আদর্শ গ্রাম এলাকার ‘জালালিয়া ব্রিকস ম্যানুফেকচারিং’সহ তিন পার্বত্য জেলার মোট ৬৪টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেয় প্রশাসন।
এরপর স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাস কো) চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন (২২৪৬/২২) করেন জালালিয়া ব্রিকস ম্যানুফেকচারিং নামক ইটভাটার মালিক সিরাজুল ইসলাম। আবেদনটি করার সময় জালালিয়া ব্রিকসের নামে ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল ইস্যু করা একটি ‘পরিবেশ ছাড়পত্র’ সংযুক্ত করে দেয়া হয়।
উক্ত আবেদনের উপর গত ২০ ফেব্রুয়ারি শুনানি নিয়ে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খন্দকার দিলারুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। এরপর জালালিয়া ব্রিকসের কার্যক্রম চালু করেন মালিক সিরাজুল ইসলাম।
তবে একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাইকোর্টে দাখিল করা পরিবেশের সেই ছাড়পত্র জালিয়াতি করে তৈরি করা। জাল ছাড়পত্রটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল তাদেরকে (জালালিয়া) পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করেছে ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল। সেখানে স্বাক্ষর দেয়া হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাবেক পরিচালক মো. নাজমুল হকের।
অথচ মো. নাজমুল হক ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই থেকে ২০০৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সরকারের সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা নাজমুল হকের স্বাক্ষর জাল করে ছাড়পত্রটি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়েও ছাড়পত্রটি জাল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পরিবেশ ছাড়পত্র জালিয়াতি করে উচ্চ আদালতে উপস্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে জালালিয়া ব্রিকস ম্যানুফেকচারিংয়ের মালিক সিরাজুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব এখন আর বলিয়েন না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। বাদ দেন। খুব টেনশনে আছি। আপনি আমাকে পরে ফোন দিয়েন নিরিবিলি কথা বলব।’ জাল ছাড়পত্র কীভাবে পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন আপনাকে এতো কথা বলতে পারব না। আমাদের ভাটা বন্ধ বর্তমানে।’
উচ্চ আদালতে সিরাজুলের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন সজল মল্লিক; যদিও এক প্রশ্নের জবাবে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সজল মল্লিক নামের কাউকে আমি চিনি না। এগুলো অন্য একজনকে দিয়ে করেছি।’ এসময় জালিয়াতির বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে সিরাজ এ প্রতিবেদককে সাংবাদিক মহলে তার পরিচিতির কথা তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।
জালালিয়া ব্রিকস ম্যানুফেকচারিংয়ের পথ ধরে আরও অন্তত ছয়টি ইটভাটা উচ্চ আদালত থেকে স্থিতাবস্থার আদেশ গ্রহণে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
হাইকোর্ট থেকে স্থিতাবস্থার আদেশ পেতে জাল পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়ে রিট আবেদন করেন রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার রাইখালীতে অবস্থিত আশা ব্রিকস ম্যানুফেকচারের মালিক স্বপন কান্তি মহাজন (রিট আবেদন নং-২২৪৭/২২), বেতবুনিয়ায় অবস্থিত মেসার্স কাদের ব্রিকস ম্যানুফেকচারের মালিক মো. সৈয়দ হোসেন (রিট আবেদন নং-২২৪৮/২২), তারাবুনিয়াস্থ মেসার্স খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) ব্রিকসের মালিক মো. ফারুক মিয়া (রিট আবেদন নং-২২৪৯/২২), গাড়িছড়া এমবিএম ব্রিকসের মালিক মো. নাসির উদ্দিন (রিট আবেদন নং-২২৫০/২২), মাতব্বরখোলাস্থ মেসার্স আমেনা-তাসফিয়া ব্রিকসের মালিক মো. মূছা (রিট আবেদন নং-২২৪৪/২২) ও মেসার্স আল মদিনা ব্রিকসের মালিক মো. আবু মনচুর মিয়া (রিট আবেদন নং-২২৪৫/২২)।
এদের মধ্যে আশা ব্রিকস ও আমেনা-তাসফিয়া ব্রিকসের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২০ এপ্রিল শুনানি নিয়ে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খন্দকার দিলারুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে কাদের ব্রিকস, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, এমবিএম ও আল মদিনা ব্রিকসের আবেদনের শুনানি করা হয় গত ৭ মার্চ। সেই শুনানিতেও পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
উপরোক্ত সবকটি ইটভাটাই হাইকোর্টে আবেদনের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ‘ছাড়পত্র’ যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যদিও তাদের কাউকেই পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়নি। সম্পূর্ণ জাল পরিবেশ ছাড়পত্র তৈরি করে হাইকোর্টে প্রদর্শন করেছেন এসব ইটভাটার মালিকরা।
ইটভাটাগুলোর রিট আবেদনে যুক্ত করা পরিবেশ ছাড়পত্রগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, আশা ব্রিকস যুক্ত করেছে ২০১৮ সালের ১০ মে ইস্যু করা ছাড়পত্র, কাদের ব্রিকস করেছে ২০১৮ সালের ৯ মে ইস্যু করা ছাড়পত্র, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী করেছে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইস্যু করা ছাড়পত্র। আর গাড়িছড়ার মেসার্স এমবিএম ব্রিকস করেছে ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর ইস্যু করা ছাড়পত্র, আল মদিনা করেছে ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ও আমেনা-তাসফিয়া ব্রিকস করেছে ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর ইস্যু করা ছাড়পত্র। উপরে উল্লেখিত আশা ব্রিকস রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত হলেও বাকিগুলো কাউখালী উপজেলায় অবস্থিত।
এসব ইটভাটার হাইকোর্টে প্রদর্শন করা সবকটি পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ছাড়পত্রে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রামের সাবেক পরিচালক মো. নাজমুল হকের (উপসচিব) স্বাক্ষর রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের নামে জাল করা এসব ছাড়পত্র ২০১৮ ও ২০১৭ সালের। অথচ স্বাক্ষর দেখানো নাজমুক হক ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই থেকে ২০০৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।
সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাজমুল হকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এসব ছাড়পত্র তৈরি করা হয়েছে। তাও আবার কর্মস্থল ছেড়ে যাওয়ার ১৩ বছর পরে। এছাড়াও এসব ছাড়পত্র জাল বলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ছাড়পত্রগুলো জাল তা দেখলেই বুঝা যায়। তাছাড়া তাদের কেউ কেউ নতুন ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। যদি আগে পেয়েই থাকতো তাহলে নতুন করে আবেদন করার কথা নয়। তারা হাইকোর্টকে বলে আমাদের কাছে বারবার আবেদন করার পরও নাকি আমরা ছাড়পত্র দিচ্ছি না। সেক্ষেত্রে আমরা আদালতকে লিখিত জবাব দিই। পরিবেশের অবস্থানগত ও পরিবেশগত বিষয় অনুকূলে না থাকায় আমরা ছাড়পত্র প্রদান করিনি এসব তথ্য আদালতে উপস্থাপন করি।’
জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সবগুলো আবেদনে ইটভাটার মালিক পক্ষের আইনজীবী সজল মল্লিক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাকে যে কাগজপত্রগুলো জমা দিয়েছে, আমি সেগুলো দিয়ে আবেদন করেছি। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ছাড়পত্র জাল নাকি আসল তা যাচাইয়ের সক্ষমতা আমার নেই। যদি সেরকম কিছু হয়ে থাকে আগামীকাল আমি নিজেই বিষয়গুলো হাইকোর্টের নজরে আনব।’
এ বিষয়ে কাউখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুন আরা সুলতানা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘তারা (ইটভাটা) স্থিতাবস্থা এনেছেন। আমাদের দিয়েছেন। আদেশে আমাদেরকে স্থিতাবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে। কাজেই আমরা হাইকোর্টের আদেশ মানতে বাধ্য। এখন তারা কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে আদেশ লাভ করেছেন, সেটি সম্পর্কে বলার এখতিয়ার আমরা রাখি না। আমরা হাইকোর্টের আদেশ দেখার পর অভিযান বন্ধ রাখি। তাদেরকে উচ্ছেদ করতে পারি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলে আপিল করতে পারে। কেননা পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশেই আমরা অভিযান করে থাকি। হাইকোর্টের নির্দেশেই ইটভাটা গুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে ভালো হবে।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে অবগত ছিলাম না। তাছাড়া এটি পরিবেশ অধিদপ্তর দেখবে। আমিও তদন্ত করে দেখছি।’
এ বিষয়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে যারা ইন্টারেস্টেট তাদেরকে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হতে হবে। কোর্ট মনে করেছে ছাড়পত্রগুলো আসল। এখন জালিয়াতির বিষয়টি নজরে আনা হলে রিট বাতিল হবে। এমনকি শাস্তির আওতায়ও আনা হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তরের নিজস্ব আইনজীবী আছে। তারাও বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনতে পারে। ছাড়পত্র নিয়ে এতো বড় জালিয়াতি করা হয়েছে তাদের দপ্তর নিয়ে, তাদের তো করণীয় থাকবে।’
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জালিয়াতির বিষয়টি আদালতের। আদালতে জালিয়াতি করা হলে আমাদের কিছু করার নেই। আদালত যদি আমাদের কাছে জানতে চাইতো তাহলে আমরা বিবেচনা করে জবাব দিতাম। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা যেতে পারে।’
পরিবেশ ছাড়পত্র জালিয়াতি করে আদালতে উপস্থাপনের বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘একটি দালাল চক্র এসব করছে। বিষয়টি হাইকোর্টকে জানানো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা কয়েকটি অপরাধ সংঘটিত করেছেন। তারা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র জাল করেছেন, সাবেক পরিচালকের স্বাক্ষর জালিয়াতি, উচ্চ আদালতে মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছেন। এসব শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলে উচ্চ আদালতে আবেদন করে রিট বাতিল করতে পারে।’