মোহাম্মদ রফিক : ‘২০২০ সালে করোনায় আমার ফুসফুস প্রায় ৬০ ভাগ আক্রান্ত হয়। তখন থেকে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলাম আমি। এরপর ২০২১ সালের ১৮ জুলাই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের দুটি মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে যাই। টাকা না দেয়ায় অসুস্থ থাকার পরও আমাকে কারা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হচ্ছিল না। পরে বাধ্য নিয়ে আমার স্ত্রী কারা হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শামীম রেজার কাছে ১৭ হাজার টাকা পাঠান। এরপর ২৬ জুলাই সাধারণ ওয়ার্ড থেকে আমাকে স্থানান্তর করা হয় কারা হাসপাতালের বেডে।’
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত ১৮ জানুয়ারি মুক্তি পাওয়া বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি মোহাম্মদ সাজ্জাত হোসেন একুশে পত্রিকার কাছে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
সাজ্জাত অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রী এক কারারক্ষীর মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে বিকাশে ওই ১৭ হাজার টাকা ডা. শামীমের কাছে পাঠান। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালে অনিয়মই নিয়ম। চিকিৎসক শামীম রেজাসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য কারা কর্মকর্তাদের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করলেই মেলে হাসপাতালে থাকাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা।’
সাজ্জাদের দাবি, নামেই কারা হাসপাতাল। প্যারাসিটামল ছাড়া সেখানে আর কোন ওষুধ পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ‘গত ১৭ নভেম্বর আমার চোখের সামনেই বিনা চিকিৎসায় মারা যান কারাবন্দী বিএনপি নেতা ফকির আহম্মদ (৬৫)। এদিন সকালে কারাগারের মেঘনা-৩-এ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে এক কারারক্ষী মিরসরাইয়ের ওই বিএনপি নেতাকে ধমকও দেন।’
চট্টগ্রাম কারাগার সূত্রে জানা গেছে, বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, হাসপাতালে থাকা, আসামির জামিন, বন্দী রোগী বাইরের হাসপাতালে পাঠানো, পুনরায় গ্রেপ্তার, খাবার বা টাকা পাঠানো, মালামাল তল্লাশি করাসহ সবক্ষেত্রেই বাণিজ্য হয় কারাগারে।
সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া একজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘প্রতি মাসে কোনো হাজতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালে বেড পান। হাসপাতালের বেড পেতে হলে অসুস্থ হওয়া জরুরি নয়। কোনো নিয়ম বা বিধি অনুসরণেরও প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ টাকা দিলেই হাজতিদের দেওয়া হয় বেড। আর অসুস্থ হাজতিরা কম্বল বিছিয়ে থাকেন মেঝেতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কনকনে শীতেও তারা বেড পান না। বন্দিদের টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয় ওষুধ। জেলা প্রশাসক, মহা কারাপরিদর্শক বা কোন ভিআইপি কারা হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে তখন বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে অচল, বৃদ্ধ, রুগ্ন ও অসুস্থ হাজতিদের এনে মেডিকেলের ড্রেস পরিয়ে বেডে বসানো হয়। আর সুস্থ হাজতিদের বেড থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সাধারণ ওয়ার্ডে।’
অভিযোগ আছে, এসব অনিয়ম সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে ভিআইপিরা কারা হাসপাতাল পরিদর্শনের আগেই জেলার, ডেপুটি জেলার, কয়েদি ইনচার্জ (সিও ম্যাড), রাইটার, সেবক এবং ফার্মাসিস্টরা অসুস্থ হাজতিদের ‘আমি এই বেডেই থাকি। খাওয়া, চিকিৎসা ভালো হচ্ছে। আমার কোন অসুবিধা নেই’ এসব কথা শিখিয়ে দেন। ভিআইপিদের পরিদর্শন শেষে আবার সুস্থ হাজতিদের বেডে ফিরিয়ে আনা হয়।
সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আরেকজন ব্যক্তি বলেন, ‘কারা হাসপাতালে থাকা, খাওয়া, গল্প করা, গোসল করা, মুঠোফোনে কথা বলা, আড্ডা দেওয়া, তাস খেলা, টিভি দেখাসহ সব সুবিধাই মেলে এখানে। কারা হাসপাতাল যেন টাকাওয়ালা হাজতি-আসামিদের থ্রি স্টার বা ফাইভ স্টার হোটেল।’
এসব অনিয়মে কারাগারের সুবেদার থেকে শুরু করে কারা হাসপাতালের চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, জেলার ও সিনিয়র জেল সুপার পর্যন্ত জড়িত বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া কারাগারের ক্যান্টিনে অনিয়ম, বিধি না মেনে ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে খরচ দেখিয়ে সেই টাকা তুলে নেওয়া, কারাগারে বিক্রি হয় এমন পণ্যের মধ্যে অধিকাংশ পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
খাবারের মান নিয়ে নানা ক্ষোভ ও অসন্তোষ তো রয়েছেই। সম্প্রতি জামিনে বের হওয়া একাধিক আসামি জানান, ক্যান্টিনে খাবার বিক্রি বাবদ প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করে কারা কর্তৃপক্ষ৷
জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত সাবেক ছাত্রনেতা সাজ্জাত জানান, ক্যান্টিনে এক পিস মুরগির মাংসের দাম ৬৫ টাকা, এক কাপ চা ১০ টাকা, পরটা ১০ টাকা, ভাজা ডিম ২৮ টাকা। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অধিকাংশ বন্দি কারা কর্তৃপক্ষের দেয়া খাবার খান না। সাধারণ এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল বন্দীরা কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়া খাবার খেয়ে থাকেন। এভাবে প্রতিমাসে খাবার বিক্রি বাবদ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে।
কারা হাসপাতাল নিয়ে নানা অনিয়ম-অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে গতকাল সোমবার দুপুরে সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম খানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর তার মুঠোফোনে খুদে বার্তা দিলে তিনি ফিরতি এসএমএস’র মাধ্যমে একটি মিটিংয়ে থাকার কথা জানিয়ে এ প্রসঙ্গে জেলার দেওয়ান মো. তারিকুল ইসলামের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এরপর জেলার হোয়াটসআপে বার্তা পাঠিয়ে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য চাইলে তিনি ‘সিন’ করেও উত্তর দেননি। এরপর সোমবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জেলার দেওয়ান মো. তারিকুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি হাঁটতে বের হয়েছি। আপনি কারা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।’
টাকার বিনিময়ে সুস্থ বন্দীকে অসুস্থ দেখিয়ে কারা হাসপাতালে স্থানান্তর করার অভিযোগের বিষয়ে কারা চিকিৎসক শামীম রেজা বলেন, “কারা হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের রাখা হয়। টাকার বিনিময়ে কোন সুস্থ বন্দীকে অসুস্থ দেখিয়ে স্থানান্তর করা হয় না। সাজ্জাত বন্দী থাকা অবস্থায় কারা হাসপাতালে রাখার বিনিময়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে কোন কারারক্ষী ১৭ হাজার টাকা নিয়েছেন সেটি আমার জানা নেই।’
বিনা চিকিৎসায় বিএনপি নেতা মারা যাওয়া ও প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ওষুধ বিতরণ না করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কারা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাজ্জাদের অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা। জরুরি চিকিৎসার জন্য কারা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সব ওষুধ আছে।’
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের নানা অনিয়মের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি; হোয়াটসআপে বার্তা পাঠিয়ে অভিযোগের বিষয়গুলো জানানো হলেও তিনি কোন মন্তব্য করেননি।