রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

স্বপ্নের বেঁচা কেনা করাই জীবন

প্রকাশিতঃ ২৮ মার্চ ২০২২ | ৯:০৯ পূর্বাহ্ন


শান্তনু চৌধুরী : জাপানিদের দীর্ঘ ও সুখী জীবনের রহস্য নিয়ে হেক্টর গারসিয়া ও ফ্রান্সেস মিরালেস এর লেখা বই ‘ইকিগাই’ পড়ছিলাম। জাপানিদের দীর্ঘায়ুর কথা কারো অজানা নয়। তবে দেশটির দক্ষিণের দ্বীপ ওকিনাওয়ার কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। স্বাস্থ্যকর ডায়েট, বাইরে হাঁটাহাঁটি, গ্রিন টি এবং উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার পাশাপাশি তারা মেনে চলেন ‘ইকিগাই’। জাপানিদের মতে প্রতিটি মানুষের জীবনে রয়েছে ইকিগাই। যার সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘বেঁচে থাকার কারণ’। আমাদের সবার মাঝেই লুকিয়ে আছে এই ইকিগাই। একে খুঁজে পেতে প্রয়োজন গভীর চিন্তা।

ইকিগাই হলো সেটাই যা আমাদের রোজ সকালে জাগিয়ে তোলে। জীবনে যাই করা হোক না কেন কখনোই যাতে না থামে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, জাপানিরা তাদের অবসরের পরও প্রাণবন্ত থাকেন। বেশিরভাগ জাপানিই কখনোই অবসরে যেতে চান না। বরং যতোদিন বেঁচে থাকেন কাজ চালিয়ে যেতে চান। জাপান সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা রাখেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর প্রতিবেদক ড্যান বাটনার। তার মতে, জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া জাপানি সংস্কৃতিতে এতোটাই পোক্ত যে অবসরের ধারণা তাদের মাঝে অনুপস্থিত।

ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের একটা বাণিতে পড়েছিলাম, ‘এক আদেশে চলেন যারা-তাদের নিয়েই সমাজ গড়া’। জাপানিদের মধ্যে যাদের গড় আয়ু একশোর বেশি সেসব অঞ্চলের মানুষের সম্পর্কে গবেষণায় দেখা গেছে, ওরা জীবনকে মিনিমালিনিজম (যেটা নিয়ে আমি এর আগে লিখেছি) করতে শিখেছি। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে এরা এমন কিছু নিজের জন্য করে না যা অনাবশ্যকীয়। এর মানে হলো লোক দেখানো কোনো কিছুই এরা করেন না। মোয়াই একটি জাপানি শব্দ এর অর্থ হলো এমন একদল লোক, যাদের চিন্তাধারা একই। মিলেমিশে চলাটা যেন তাদের সমাজের রীতিতে পরিণত হয়েছে। অনেক আগে জাপান যখন প্রযুক্তির দিক থেকে এতোটা সমৃদ্ধ ছিল না, সামান্য ফলনের জন্য কৃষকদের অনেক পরিশ্রম করতে হতো। তেমনই এক কঠিন সময়ে মোয়াই শব্দটির উৎপত্তি। যখন তারা পর্যাপ্ত ফলন ফলাতে ব্যর্থ হতেন, নিজেদের কৃষি কৌশলগুলো ভাগাভাগি করতেন। এভাবে তারা পরস্পরের সহযোগিতায় ফলনের উন্নতি করেন।

ইকিগাই নিয়ে আলোচনা আসলে দীর্ঘ। তবে কিছু বিষয় বলে বিরতি টানি। কম পরিশ্রম করা, আলস্য এবং মানসিক চাপ মানুষকে দ্রুত বুড়িয়ে ফেলে। কাজেই যতোটা সম্ভব এসব পরিহার করার কথা বলা হয়েছে ইকিগাই-এ। দৈনন্দিন রুটিনে কিছু পরিবর্তন এনেও নিজেকে সচল রাখা যায়, যেমন-হেঁটে অফিস করা, দৈনিক অন্তত ২০ মিনিট হাঁটা। বহুতল ভবনে উঠার সময় সিঁড়ি ব্যবহার করা, টিভি দেখা কমিয়ে দেয়া, নিয়মিত সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া, জাঙ্ক ফুডের বদলে ফলমূলকে গুরুত্ব দেয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো, বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো, পশুপাখি পুষা, খেলাধূলা করা এমন সব। সবচেয়ে বড় কথা, অহংকে পরিত্যাগ করা, কম্পোমাইজ করার প্রবণতা। অনেক কিছু মেনে নেয়া। এ বিষয়ে যারা মধ্যবিত্ত তাদের নিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটা লেখা শেয়ার করছি পাঠকদের সাথে।

সেখানে বলা হচ্ছে- মিডলক্লাস ফ্যামিলির ছেলে-মেয়েগুলো খুব ছোটবেলা থেকে যে জিনিসটা শিখে…সেটা হলো কম্প্রোমাইজ। তাদের বাথরুমে শেষ হয়ে যাওয়া একটি শ্যাম্পুর বোতল সবার অলক্ষ্যে দিনের পর দিন পড়ে থাকে। সেই বোতলে সুযোগমতো কেউ না কেউ পানি ঢুকিয়ে রাখে। টুথপেস্ট শেষ হয়ে গেলে সেই টিউবের গলা কেটে টিপে টিপে পেস্ট বের করাটাও নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। বড় ভাইয়ের শখের জ্যাকেট অথবা বড় বোনের পছন্দের কামিজ এখানে বাতিল বলে ফেলে দেওয়া হয় না। ছোটরা নিশ্চিন্ত মনে সেগুলো বছরের পর বছর পরে যেতে পারে। এখানে হরলিক্স বা মালটোবার বোতলে আচার শোভা পায়। আগের কেনা পুরনো বিস্কুটের টিনে মুড়ি। এদের বাসার শো-কেসে শুধুমাত্র শো-পিস ছাড়াও ডিনার সেট এবং নতুন থালা-বাসন-গ্লাসও রাখা হয়। যেগুলো শুধু অতিথিদের জন্যে বরাদ্দ। এখানে মা সন্তানের গৃহশিক্ষক একদিন পড়াতে না এলে চিন্তায় অধীর হন।

এই ছেলেমেয়েগুলো জন্মদিনে খুব পাংশুমুখে ঘুরে বেড়ায়, সারাদিন বাসায় কাটায়। রেস্টুরেন্টে বসে কেট কেটে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়াটা অনেকটা ড্রিম কাম ট্রুর মতো। ঈদের বাজারে কোন পাঞ্জাবি বা জামা খুব বেশি পছন্দ হলেও বাবার অসহায় মুখ দেখে হাসিমুখে বলতে পারে, ‘এটার রঙটা তেমন সুন্দর না… অন্যটা দেখি…’। এরা হাফ কেজি আইসক্রিম সব ভাই-বোন মিলে খেতে জানে। পুরনো কোনো প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে হঠাৎ একশ’ টাকার কোনো নোট পাওয়া গেলে বন্ধুদের সঙ্গে সেই গল্প করতে করতে এরা সারাদিন আনন্দ নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। বাসা থেকে বাইরে যাবার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে বড় ভাইয়ের বডি-স্প্রেটা একটু লাগিয়ে নিতে ভুল করে না সদ্য কলেজ শুরু করা ছোট ভাইটা। প্রেমিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে ছেলেগুলো প্রেমিকার কাঁধে হাত রেখে বলতে পারে না, ‘তুমি শুধু আমার হবে’। এরা নিচু স্বরে বলে, ‘আচ্ছা… আমি ব্যাপারটা দেখবো’।

মেয়েরা কারো ভালোবাসায় দিন-রাত অন্তরে কষ্ট পুষে রাখলেও সেই ভালবাসার প্রকাশ এখানে বালিশের কভারে চোখের জল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বাবা-মার কান পর্যন্ত সেই ভালোবাসা’র কথা পৌঁছায় না। মিডলক্লাস মানুষরা আছে বলেই শহরের সমস্ত রিকশাগুলো… প্রায়ই একই ছাতার নিচে দেখা যায় মা-ছেলে বা বাবা-মেয়েকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উচ্চারণ ও শব্দ করে পড়তে হয়। শিক্ষকেরা শুনে কোনো ভুল থাকলে তা শুধরে দেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শব্দ করে পড়ার ঐতিহ্য ছিল। তবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এই চিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। এই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। জীবন থেকেতো কতো কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারানোর গল্প না হয় অন্য একদিন হবে!

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক