বই সেতো অনন্ত যৌবনা


শান্তনু চৌধুরী : ‘ক্লাসে নির্বোধ শব্দটি দিয়ে বাক্য রচনা করতে বলা হলো। আমি লিখলাম, আমার বাবা একটি নির্বোধ। খাতা দেখে বাংলা স্যারতো প্রথমে হেসে খুন, তারপর জানতে চাইলেন নির্বোধের মানে জানি কি না। আমি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ক্লাস ওয়ানের সপ্রতিভ ছাত্র, চট করে উত্তর দিলাম, নির্বোধ মানে বোকা।

হাসি থামিয়ে ভালো করে দেখলেন আমাকে টিচার। তাহলে এই কথা লিখেছ যে? তোমার বাবা কি বোকা? হ্যাঁ আমার আম্মু রোজ বলে’। এটি প্রয়াত থ্রিলার লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘আমিই মাসুদ রানা’ বই থেকে নেয়া। যেটি বইয়েরও আগে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল প্রথম আলো পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশ হয়েছে। ১৭ মার্চ শেষ হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এমনিতে সারাবছর বই কেনা হয়। বইমেলা এলে সেই নেশা যেন চাগিয়ে উঠে।

প্রতিবার একটা বাজেট থাকে মেলায় বই কেনার জন্য। এবার সে বাজেটে যুক্ত হয়েছে একুশে পত্রিকা থেকে পাওয়া লেখার সম্মানী আর বন্ধুদের বই গিফট। আমি সবসময় বলি যারা আমাকে খাওয়াতে চান কোথাও বা কিছু গিফট দিতে চান তারা যেন বই উপহার দেন। সেই তরিকায় এবার বেশ বই উপহার পেলাম। আর বইকেনার পর যেটা শুরু হয়, দ্রুত পড়ে ফেলার তাগিদ। অনেকটা গরম গরম জিলাপির মতো। মচমচে থাকতে খেতেই বুঝি স্বাদ। যদিও বইয়ের বিষয়টা তেমন নয়। বই চিরকালই নতুন।

বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশ হওয়া যে বইটি এবার প্রথম পড়তে শুরু করেছিলাম সেটি হরিশংকর জলদাসের ‘দুর্যোধন’। ‘দুর্যোধনকে নিকৃষ্ট কয়েদির মতো হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কুরুক্ষেত্রের দিকে। দ্বৈপায়ন হ্রদ থেকে কুরুক্ষেত্র দীর্ঘপথ। এবড়োখেবড়ো। দুর্যোধনের পদক্ষেপ মন্থর, কিন্তু দৃঢ়। তাঁর অহংকার ও আত্মবিশ্বাস সেই পদক্ষেপে ঝংকার তুলছে যেন!’ ‘দুর্যোধন’ উপন্যাসের শুরুতেই ভিন্ন কিছুর আভাস দিচ্ছেন ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস। পাঠকের মনে জাগিয়ে দিচ্ছেন অনুসন্ধিৎসা। ভাবছিলাম শেষ পর্যন্ত সেটি অটুট থাকবে। কিন্তু না! বেশ কয়েক পৃষ্টা পড়ার পর আর আগ্রহ জাগলো না। তিনি ‘কথিত’ উচ্চবর্ণকে আক্রমণ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন সব বিষয়ের অবতারণা করেন যা আমার কাছে ঠিক বোধগম্য নয়। এটি হয়তো পাঠক হিসেবে আমার সীমাবদ্ধতা। অথচ রামায়ণ মহাভারত নিয়ে নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরীর বিশ্লেষণ মনকে আলোড়িত করে। ভাবায়।

বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘খুন ও আনন্দকুসুম’ পড়লাম। টান টান উত্তেজনার উপন্যাস। বিশেষ করে কাহিনীর নানা টুইস্ট যে কোনো বয়সী পাঠক ধরে রাখতে সক্ষম বলে আমার বিশ্বাস। পড়লাম মাসউদ আহমাদ এর গল্পগ্রন্থ ‘জনৈক কবির স্মরণসভা’। এক কথায় অসাধারণ। কবি জীবনানন্দ দাশ জীবিত অবস্থায় কতোটা অবহেলার শিকার হয়েছেন তা যেন বলার অপেক্ষা রাখে না।

পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন এর লেখা ‘হ্যালো পুলিশ স্টেশন’ প্রতিদিনকার জীবনে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিবরণ যেন। যা থেকে শিক্ষা নিতে পারেন সচেতন পাঠক। সেই বইয়ে ‘কেসবুক থেকে ফেসবুক’ অংশের কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরছি।

‘৫ বোতল কিনে ৮ বোতলে ভরে ফেনসিডিল বিক্রি করে কিশোর সাইফুল। প্রিয় ফেনসিডিলপ্রেমীরা, বাকি ৩ বোতল এই সাইফুলের প্রস্রাব! টাকা দিয়ে সাইফুলের প্রস্রাব কিনে খাচ্ছেন!’

‘১৪ বছরের শিশু, এই বয়সেই করে মাদক বিক্রি! তাকে দিয়ে এগুলো করায় তারই আপন বোন! যেদিন সে মাদক বিক্রি করতে পারে না, তার খাবার বন্ধ, ঘরে ঢোকাও বন্ধ’।

‘পরকীয়া, প্রেমিকের ফোন। এক ফোনেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে হাজির প্রেমিক। বিকেলে বাসায় দেখা করতে গেলেন। আর রাতেই থানায় আসলেন। বাসায় ডেকে চড় থাপ্পড়ে আপ্যায়ন করে রোমান্টিক কিছু ছবি তুলে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে আই লাভ ইউ বলেছে সেই প্রেমিকা। প্রেমিক এখন মামলা করবেন। কিন্তু সেই মেয়েকেও চেনেন না। ঠিকানাও জানেন না। হায়রে প্রেম!’

‘ফেসবুকে পরিচয়। সেই পরিচয় দৌড়ে গিয়ে রূপ নেয় প্রেমে। প্রেমের টানে ঘর ছাড়ে সানজিদা। পালানোর সময় ছয় সাত ভরি স্বর্ণ ও নগদ প্রায় ১০ হাজার টাকাও সাথে নিয়ে যায়। রাতে ভার্চুয়াল সেই প্রেমিকের সাথে একটা হোটেলে উঠে। সকালে উঠে সানজিদা দেখে প্রেমিক নেই। সাথে নেই সেই স্বর্ণ ও টাকা। সানজিদা সেই স্বর্ণ ও টাকা চুরির অভিযোগ নিয়ে থানায় এসেছে। কিন্তু আগের দিনইতো একই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে গেছেন তার বাবা’।

‘কানাডা প্রবাসী মেয়ে। পরহেজগার, ডিভোর্সি। পাত্র চায় মধ্যবয়স্ক, মধ্যবিত্ত এবং পরহেজগার। এসব রিকোয়ারমেন্ট দেখেই পাঁচ লক্ষ টাকা দেনমোহরে বিয়ে করেন অভিষেক। মেয়ের চাহিদা অনুযায়ী বাসর রাতেই পরিশোধ করেন দেনমোহর। এরপর মেয়েটি এখন কানাডায়। আর অভিষেক থানায় এসেছে প্রতারণার মামলা করতে’।

জাপানিদের দীর্ঘ জীবনের কথা সবাই জানেন। অর্থপূর্ণ জীবন কীভাবে সুখের সন্ধান দিতে পারে সেটি নিয়ে ‘ইকিগাই’ যার ভাবার্থ ব্যস্ততার আনন্দ। এই বইটি লিখেছেন হেক্টর গারসিয়া ও ফ্রান্সেস মিরালেস। আমি পড়ছি ইউসুফ মুন্নার অনুবাদ। বেশ ভালো লাগছে। ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহেনাসহ পরিবারের প্রবাসে দুঃসহ জীবন নিয়ে গবেষণামূলক লেখা লিখেছেন সরাফ আহমেদ। বেশ খেটেকুটে লেখা এই বইটি অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান যেমন দেয় তেমনি দেশের প্রতি তাদের ত্যাগে কৃতজ্ঞ চিত্তে মাথা নত হয়ে আসে। সংগ্রহে রাখার মতো বইটিও পড়ে ফেললাম একটানা।

সবশেষ যেটি পড়ছি মহিউদ্দিন মোহাম্মদ এর ‘আধুনিক গরুর রচনা’ বইটি। একটু ভিন্ন চিন্তা বা ভিন্ন ধারার লেখা বলে বইটি নিয়ে আগ্রহ জাগছে। সাথে সাথে তাঁর অন্য লেখা নিয়েও। এটিই হয়তো তিনি চেয়েছেন। তাই বইয়ের ফ্ল্যাপে লিখেছেন, ‘লেখকের পরিচয় তাঁর লেখা থেকেই খুঁজে নেয়া উচিত। তিনি কবে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন, কী ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তিনি দরিদ্র ছিলেন কি না, তাঁর ধর্ম কী, তিনি দেখতে কেমন, বয়স কতো, এগুলো কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়’। তাঁর লেখা থেকে কয়েকটি উদ্বৃত্তি এখানে দিলে বুঝতে পারবেন কেন তাঁর লেখাকে ভিন্ন বলছি।

‘একদিন আমাদের আকাশ আমাদের মাথার ওপর টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে লাগলো। কিন্তু আমাদের রাজা একটিবারও ভাবলেন না-আকাশের একটি ভাঙা টুকরো তার মাথায়ও পড়তে পারে’।

‘আমি যখন আমার ভূঁড়ির দিকে তাকাই, তখন বুঝতে পারি-কোথাও কেউ না কেউ না খেয়ে আছে বলেই ভূঁড়িটি হয়েছে। ভূঁড়ি হলো ধনী মানুষদের শরীরে জমা ক্ষুধার্ত মানুষের মাংস’।

‘বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে অন্ধকারের বিরুদ্ধে কথা বললে টর্চলাইটেরা মিছিল বের করেন’।
পড়া থেমে নেই। ওমর খৈয়াম বলে গেছেন বই অনন্ত যৌবনা। তাই তার স্বাদ নেয়া যায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক