মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

লবণের কেজি ৩৫ টাকার বেশি, চাষি পাচ্ছেন ৩ টাকা

প্রকাশিতঃ ২১ মার্চ ২০২২ | ৮:১২ অপরাহ্ন


জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার : গত কয়েক বছর ধরে দেশের বাজারে আয়োডিনযুক্ত লবণের এক কেজি ওজনের একটি প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু চাষাবাদে জড়িত প্রান্তিক চাষিরা সাধারণত প্রতি কেজি লবণের মূল্য পেয়ে থাকেন ৩ টাকা থেকে সাড়ে ৩ টাকা। কোন সময় সংকট তৈরি হলেও চাষিরা প্রতি কেজি লবণের দাম পেয়ে থাকেন মাত্র সাড়ে ৪ টাকা থেকে সর্বোচ্চ মাড়ে ৬ টাকা পর্যন্ত। এর বেশি কখনোই পান না।

গতকাল রোববার ও আজ সোমবার কক্সবাজারের মহেশখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রান্তিক চাষিরা মণ প্রতি লবণ বিক্রি করেছেন ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত। তাও আবার সর্বনিম্ন ৪৫ কেজিতে হিসেব করা হয় এক মণ। সেখান থেকে শ্রমিক খরচ ও কমিশন বাবদ গচ্চা ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এতে করে এক মণ লবণের মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১৪০ টাকা। সে হিসেবে কেজি প্রতি মূল্য দাঁড়ায় ৩ টাকার একটু বেশি।

আবার দেশে যখন লবণের সংকট তৈরি হয়, তখন মণ প্রতি লবণ যদি ৩৫০ টাকায়ও বিক্রি হয়, শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য খরচ ৫০ টাকা চার্জ বাদ দিয়ে এক মণ লবণের মূল্য দাঁড়ায় ৩০০ টাকা। এভাবে যদি কখনো লবণের দাম বৃদ্ধি পায়, ৪৫ কেজিতে মণ হিসেব ধরে একজন প্রান্তিক চাষি কেজি প্রতি সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ টাকা দাম পেতে পারেন।

লবণ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশে লবণের কোন ঘাটতি না থাকলেও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্য লবণ) আমদানি অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে দেশে উৎপাদিত লবণের দরপতন অব্যাহত থাকায় ক্রমেই দেশীয় লবণ শিল্প হুমকির মুখে ধাবিত হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এভাবে বিদেশ থেকে সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছেন মিলাররা।

সোডিয়াম সালফেট সাধারণত টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও ওষুধ কোম্পানিগুলো ব্যবহার করে। ২০১৫ সাল থেকে সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি বেড়েই চলেছে। প্রতি মাসে ৫০ হাজার টন সোডিয়াম সালফেট আমদানি হচ্ছে। চীন ও ভারত থেকে এসব আমদানি করা হয়। এতে ক্ষতি হচ্ছে দেশীয় লবণ শিল্পের।

এদিকে লবণের দরপতনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কক্সবাজার জেলায় লবণ উৎপাদনে জড়িত লক্ষাধিক প্রান্তিক চাষি। গত বছর থেকে লবণ চাষাবাদের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িত হয়ে গেছেন অনেকেই।

প্রান্তিক চাষিরা বলছেন, পরিবারের মুখে দু’বেলা দুই মুঠো ভাত তুলে দিতে রোদের খরতাপ উপেক্ষা করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লবণ উৎপাদনের কাজ করতে হয়। এরপরও ঠিক মতো দুই বেলা ভাত জুটছে না। চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এখন লবণ চাষীদের ঘরে ঘরে নিরব দুর্ভিক্ষ।

মহেশখালী কালারমারছড়া বাসিন্দা ও লবণ চাষী মো. ইলিয়াছ বলেন, জরুরি প্রয়োজনে আমি ৪৫ কেজি ওজন করে ৩৩ মণ লবণ বিক্রি করেছি। প্রতি মণের দাম পেয়েছি ১৮০ টাকা। কিন্তু লেবার চার্জ বাবদ মণ প্রতি ২৫ টাকা ও স্থানীয় এক লবণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বাকিতে পলিথিন নেয়ায় তার জন্য মণ প্রতি কমিশন ২০ টাকাসহ মোট ৪৫ টাকা খরচ হয়েছে। এতে ৪৫ কেজির এক মণের দাম পড়েছে ১৩৫ টাকা। সে হিসেবে আমার এক কেজি লবণের দাম পড়েছে ৩ টাকা। ১ কেজি চালের দাম ৬০ টাকার বেশি। তাই এক কেজি চাল কিনতে ২০ কেজি লবণ বিক্রি করতে হয়।

প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন, মাতারবাড়ির ওয়াসিম আকরাম, আবদুর রহমানসহ জেলার অর্ধশতাধিক চাষি। তারাও বলছেন, বর্তমানে ২০ কেজি লবণ বিক্রি করলে এক কেজি চাল মিলছে।

লবণ চাষিদের দেয়া তথ্যমতে, মাঠ পর্যায়ে প্রতি মণ লবণে ৫ থেকে ৭ কেজি পানি হিসেব করা হয়। এ কারণে ৪০ কেজির জায়গায় ৪৫ থেকে ৪৭ কেজি লবণে এক মণ হিসেব করা হয়। তারা জানায়, লবণ বিক্রি করলেও তা তাদের খরচে ট্রলার কিংবা গাড়িতে তুলে দিতে হয়। এতে প্রতি মণে ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরি দিতে হয়। এ ছাড়াও সরকারিভাবে লবণ চাষিরা কোনো সহায়তা না পাওয়ার কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লবণ চাষাবাদের জন্য প্রতি বছর পলিথিন নিতে হয়, এ জন্য মণ প্রতি ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত তাদের কমিশন দিতে হয়।

লবণ ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান মানিক বলেন, প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে প্রায় ৪ টাকা খরচ হয়। প্রতিদিন লবণের এভাবে দরপতন হলে সে খরচ খরচ পুষিয়ে উঠতে লাভের মুখ দেখা সম্ভব না।

তিনি বলেন, গত দুই বছরে অনেক লবণ চাষি চাষাবাদ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। বিষয়টি লবণ শিল্পের জন্য অশনি সংকেত। লবণ শিল্প বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।

এদিকে অর্ধশতাধিক লবণের মিল রয়েছে কক্সবাজারের নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর লবণ শিল্পনগরীতে। এখানকার মিল মালিকদের সভাপতি শামসুল ইসলাম আজাদবলেন, দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ লবণ শিল্প রক্ষায় সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। শিল্পটি এখন অনেকটাই অভিভাবকহীন। থেকেও কেউ নেই।

তিনি বলেন, দেশে লবণের কোন ঘাটতি না থাকলেও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে অবৈধভাবে সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্য লবণ) আমদানি অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে দেশে উৎপাদিত লবণের দরপতন অব্যাহত থাকায় ক্রমেই দেশীয় লবণ শিল্প হুমকির মুখে পড়ছে।

সোডিয়াম সালফেট আমদানিতে কয়েকগুণ ভ্যাট বৃদ্ধি করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের কিছু লোভি মিল মালিক রয়েছেন যারা চাষিদের কথা বিবেচনা না করে প্রতিবছর লবণ আমদানির চেষ্টা করেন। আর এর প্রভাব পড়ে লবণের বাজারে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি প্রান্তিক চাষিরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান শামশুল ইসলাম আজাদ।

একই অভিযোগ করলেও লবণ আমদানির পক্ষে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি মো. নুরুল কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, গত বছর লবণ উৎপাদনে ২২ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ১৬ লাখ মেট্রিক টনের মতো লবণ উৎপাদন হয়েছে। এ কারণে গত বছর ৩ লাখ মেট্রিক টন লবণ আমদানির জন্য রাজি হয়েছিল সরকার। কিন্তু ইসলামপুরের সভাপতিসহ সেখানকার মিল মালিকরা লবণ আমদানির বিরোধিতা করার কারণে তা আর হয়নি।

গত শনিবার নুরুল কবির চৌধুরী আরও বলেন, এখনও চট্টগ্রামের মাঝিরঘাটে সোডিয়াম ক্লোরাইডের শতাধিক গাড়ি লাইন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৈধভাবে লবণ আমদানির সুযোগ পেলে কালোবাজারিরা এই সুযোগ পেত না। দেশে লবণের দাম স্বাভাবিক থাকতো। তবে ভরা মৌসুমে লবণের দরপতন স্বাভাবিক বলে মনে করেন নুরুল কবির চৌধুরী। তার মতে, বৈধভাবে লবণ আমদানি হলে সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্য লবণ) আমদানি কমে যেত।

এদিকে মাত্র ৩ থেকে ৪ টাকায় লবণ কিনে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় লবণ বিক্রির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও নীতিমালাকে দায়ী করলেন মিলাররা।

বিসিকের তথ্যমতে, কক্সবাজার ও বাঁশখালীর কিছু অংশ নিয়ে প্রায় ৫৭ হাজার ২৭০ একর জমিতে এ বছর লবণ চাষ হয়েছে। এতে অন্তত ৫৫ হাজার লবণচাষি রয়েছেন। এ ছাড়া লবণের ওপর বিভিন্ন ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন আরও কয়েক হাজার মানুষ। এ বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। ইতিমধ্যে সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার জেলা ম্যানেজার (ডিএম) জাফর ইকবাল জানান, দেশে ২০২১ সালে লবণের চাহিদা নির্ধারণ হয় ২২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। ২০২১ মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন। তবে, ২০২০ সালে তিন লাখ ৪৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উদ্বৃত্ত ছিল। সে হিসেবে ২০২১ সালের লবণের মজুদ ১৯ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। কাগজে কলমে দুই লাখ মেট্রিক টন লবণ ঘাটতি থাকলে কোন সমস্যা হয়নি।

তিনি বলেন, সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্য লবণ) আমদানি বিষয়টি জানা নেই। মাঠ পর্যায়ে লবণের দরপতন হলেও বাজারে ৪০ থেকে ৫০ টাকা লবণ বিক্রি ও কখনো দাম না কমা প্রসঙ্গে জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।

তবে ফোন রিসিভ না করায় এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, লবণ শিল্পের সকল সমস্যাগুলো চিহিৃত করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রান্তিক চাষিরা যাতে সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা চলমান রয়েছে।