:: একুশে প্রতিবেদক ::
চট্টগ্রাম: দুই হাজার টাকা দিয়ে স্যামসাং গ্যালাক্সি জে ওয়ান স্মার্টফোন কিনলাম। শো-রুম থেকে এ মোবাইল কিনতে গেলে ৮হাজার টাকা লাগতো। সামান্য পুরনো হলেও অনেক সস্তায় পেয়েছি। তাই কিনে নিলাম। -চট্টগ্রাম নগরীর ‘চোরাই মার্কেট’ থেকে মোবাইল কেনার পর এভাবেই নিজের কথা বলছিলেন শাকিল নামের এক যুবক।
নগরীর কোতোয়ালী থানার স্টেশন রোডের পুরাতন রেল স্টেশন থেকে নতুন রেল স্টেশনের প্রবেশপথ পর্যন্ত ফুটপাতের ওপর গড়ে উঠা দোকানগুলোকে ‘চোরাই মার্কেট’ হিসেবে চেনে নগরবাসী। গত সোমবার ওই মার্কেটে গেলে কথা হয় শাকিলের সাথে।
সরেজমিন দেখা গেছে, চোরাই মার্কেটে প্রায় ২০০ দোকান রয়েছে। দোকানগুলোর পরিসর বড় নয়। ছোট ছোট কাঠের চকি বানিয়ে বসানো হয়েছে নানা পণ্যের পসরা। কেউ কেউ কাঁচের শো-কেসেও পণ্য রেখেছেন বিক্রির জন্য। কি নেই এসব দোকানে? মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ, ঘড়ি, জুতা, স্যান্ডেল, কাপড় থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকসের নানা জিনিসপত্র। বেশীরভাগ পণ্যই দামি ও কিছুটা পুরনো, কিন্তু এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে একেবারেই কম দামে! এভাবে দাম কম থাকায় চোরাই মার্কেটের প্রতি অনেক ঝোঁক বেশি নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের। সন্ধ্যার পর এ মার্কেটে ভীড় বাড়ায় পণ্যের বেচা-কেনা সামাল দিতে কোন কোন দোকানে একাধিক বিক্রেতাকেও কাজ করতে দেখা গেছে।
ক্রেতা সেঁজে চোরাই মার্কেটের এক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, চোরাই মোবাইল কেনার পর ‘পুলিশী ঝামেলা’ এড়ানোর জন্য ‘ব্যবস্থাও’ রেখেছে তারা। এক্ষেত্রে দামি চোরাই মোবাইলের ‘আইএমইআই’ (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল স্টেশন ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি) নম্বর বদলে বিক্রি করা হয়। এতে প্রযুক্তি ব্যবহার করেও মুঠোফোন ট্র্যাকিং করে চোরাই মোবাইলের অবস্থান নিশ্চিত হতে পারেনা পুলিশ। আইএমইআই নাম্বার পাল্টে ফেলে বিক্রি করা এ ধরনের মোবাইল সেট গুলোর দাম অন্য সাধারণ সেট গুলোর চেয়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেশী বলে জানা গেছে।
‘চোরাই মার্কেটে’ মালামাল কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে, এখানকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বাসা বাড়ি থেকে পুরোনো জিনিসপত্র কিনে আনা হয়। অনেকে নিজেদের পুরোনো মোবাইল, ট্যাব, জুতা স্যান্ডলও বিক্রি করেন। এছাড়া বিভিন্ন গার্মেন্টস থেকে কমদামে কাপড়-চোপড় ও জুতা-স্যান্ডল এনে এখানে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি দোকানে দৈনিক গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার মালামাল কেনাবেচা হয়। সবাইকে চাঁদা দিয়ে তাদেরকে ব্যবসা করতে হয় বলেও জানান তারা।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ছিনতাই হওয়া মালামাল জমা হয় চোরাই মার্কেটে। এখানকার দোকানের ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত কম দামে এসব পণ্য অপরাধীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ফের বিক্রি করে দেয়। দোকানগুলো সারাদিন খোলা থাকলেও দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর থেকে জমে উঠতে শুরু করে। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ক্রেতার ভিড় থাকে প্রচুর।
কম দামে পণ্য পাওয়া যায় বলে চার বন্ধুকে সাথে নিয়ে গত সোমবার পণ্য কিনতে চোরাই মার্কেটে এসেছেন পোশাক কর্মী শাহেদুল ইসলাম।
চোরাই মার্কেট থেকে মালামাল কেনায় ঝুঁকি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৮-১০ হাজার টাকার মোবাইল এখানে দুই হাজার টাকায় পাওয়া যায়। বছর খানেক আগে এক বন্ধুর সাথে এখানে প্রথম এসে বিষয়টা জানতে পারি। এরপর থেকে কেনাকাটা এখান থেকেই করি। তবে এখানে মালামাল কেনায় ঝুঁকি রয়েছে। আশপাশে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীরা অবস্থান করে। মাল কেনার পর কেউ আবার কেড়েও নিতে পারে। তাই এখানে যতবারই আসি, ততবারই কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে আনি। দেড় হাজার টাকা দিয়ে আমি একটি মোবাইল নিয়েছি। ৩শ টাকা দিয়ে আমার বন্ধু আশিক এক জোড়া জুতা নিয়েছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাই মার্কেটে যারা ব্যবসা করছেন তাদের বেশিরভাগই অপরাধ কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। ছিনতাই-চুরির কাজে ভাসমান মানুষদের সংগঠিত করে আসছেন তারা। স্টেশন রোড এলাকায় ভাসমান শিশু ও লোকজনদের টার্গেট করে প্রথমে মাদকে আসক্ত করানো হয়। এরপর মাদকের টাকা সংগ্রহে বাধ্য হয়ে ছিনতাই ও চুরি-ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে ভাসমান লোকজন। নেশার টাকা যোগাড় করতে লুট করে নিয়ে আসা পণ্য কম দামে চোরাই মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন মাদকাসক্ত ভাসমান লোকজন। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় চোরাই মোবাইল নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে চোরাই মার্কেটের ব্যবসায়ী চেইন কবির ছুরিকাঘাত করে তার দোকানের কর্মচারী জাবেরকে খুন করে।
এদিকে পরিচয় গোপন করে গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ‘চোরাই মার্কেটে গিয়ে সরেজমিন দেখা গেছে, মাদকসেবী এক ব্যক্তি পাঁচটি মোবাইল ফোন বিক্রি করতে এসেছেন। সবগুলো মোবাইলই সিম্পনি ব্র্যান্ডের মাঝারি মানের। অনেক দরদামের পর এক ব্যবসায়ী ওই পাঁচটি মোবাইল কিনে নেন প্রতিটি ৩০০ টাকা দরে। পাশে দাঁড়িয়ে এ ঘটনা দেখার একপর্যায়ে একদল ‘ব্যবসায়ী’ ঘিরে ফেলে এ প্রতিবেদককে। পরে কৌশলে নিজেকে ‘ক্রেতা’ প্রমাণ করে তাদের কাছ থেকে ছাড়া পান এ প্রতিবেদক।
স্টেশন রোডের চোরাই মার্কেটের বিপরীতে রিয়াজউদ্দিন বাজার। ওই বাজারের মুদি দোকানি আবদুস সবুর বলেন, ‘নগরীর মধ্যে কারও দামি কোন জিনিস চুরি-ছিনতাই হলে স্টেশন রোডের চোরাই দোকানগুলোতে এসে খোঁজ নিলে পাওয়া যায়। এমন নজির অনেক রয়েছে। তাই অনেকেই জিনিসপত্র হারিয়ে এখানে আসেন ফের কিনতে। কিন্তু চোরাই পণ্যের দোকানিরা ক্রেতা দেখলেই আগে একনজর চোখ বুলিয়ে নেয় যে, সে সত্যিকারের খদ্দের কিনা। যদি কেউ এমনি এমনি এসে দাম যাচাই-বাছাই করে তবে বিপদ তার অনিবার্য। এখানকার সবাই জোটবদ্ধ হয়ে সন্দেহভাজনকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে নাজেহাল করে।’
এদিকে স্টেশন রোডের মত ব্যস্ত স্থানে প্রশাসনের নাকের ডগায় কিভাবে চোরাই পণ্যের বেচা-বিক্রি চলছে- এ নিয়ে বিস্মিত সচেতন নগরবাসী।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, নিউমার্কেট থেকে পুরাতন রেল স্টেশন পর্যন্ত ফুটপাতে যে সব দোকান গড়ে উঠেছে, তা উচ্ছেদ করার দায়িত্ব আমাদের না। তবে ওইসব দোকান ঘিরে কোন অপরাধ কর্মকান্ড বা অবৈধ কিছু ক্রয়-বিক্রয় হলে আমরা ব্যবস্থা নেব।