আবছার রাফি : দেশের পোশাক শিল্প তথা জিন্স রপ্তানির লিজেন্ড খ্যাত প্যাসিফিক জিন্সের প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দিনের শারীরিক পরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা বলেছিলেন পর্যায়ক্রমে কেমো ও রেডিয়েশন থেরাপির সফল প্রয়োগের মাধ্যমে আরো পাঁচ বছর বেঁচে থাকা সম্ভব।
৭১। সাথে ৫ বছর যোগ হলে ৭৬। ৭৬ বছর বেঁচে থাকাও অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই নাসির উদ্দিনও খুশি হয়েছিলেন, চেয়েছিলেন আর ৫টা বছর বেঁচে থাকতে। এই সময়টাতে বিশ্ব পোশাক শিল্পে স্বপ্নের ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া নিজের গড়া প্যাসিফিক জিন্সকে আরও একটু গুছিয়ে দিতে পারলেন, অসমাপ্ত কাজগুলো করে যেতে পারলেন!
এই ব্যাটা দেখতো, আমার বলে কীসব ক্যান্সার-ট্যান্সার! আমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ। সামান্য একটু ব্যথা-টেথা তো হবেই– ব্যাংককের হাসপাতালে বসে সন্তান-ভাতিজাদের কাছে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে এমন সাহস দেখানো মানুষটা পরক্ষণে নিমিশে মিলিয়ে গেলেন ভয়ংকর স্বাস্থ্যহানির অতল গহ্বরে। মাত্র একটা কেমোর ধকল সইতে না পেরে সরাসরি কোমায়, সেখান থেকে ১ মাস ১৮ দিন পর চিরতরে নাই হয়ে গেলেন এ দেশের পোশাক শিল্পের আলোকবর্তিকা খ্যাত চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান নাসির উদ্দিন। মৃত্যুর প্রায় ২০ দিন পর প্রয়াতের পারিবারিক সূত্রেই জানা গেলো তাঁর অসুখ-বিসুখ-চিকিৎসা ও ‘আকস্মিক মৃত্যু’ নিয়ে অপ্রকাশিত গল্পগুলো।
পরিবার সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যভাগে বিষেশায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্র ব্যাংককের সামিটিবেজ হাসপাতালে চেকআপে যান শিল্পপতি নাসির উদ্দিন। সেখানে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরে পেটসিটি স্ক্যান করে জানতে পারেন সেই ক্যান্সার পাকস্থলী থেকে ধীরে ধীরে লিভার ও বোনে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপরও আশা ছাড়েননি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
জানা যায়, দেড়বছর আগেই নাসির উদ্দিনের শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু তৈরি হলেও শরীরের ওজন ছিল অপরিবর্তিত। খাওয়া-দাওয়া, রুচি এসবেও কোনো হেরফের হয়নি। তাই ক্যান্সার প্রশ্নে পাত্তাই দিতে চাননি নাসির উদ্দিন; বরং বলেন-দূর কীসব ক্যান্সার-ফ্যান্সার। নিজেই উল্টো সন্তান-ভাতিজা ও স্বজনদের হাসপাতালের বেডে বসে সাহস দিতে থাকেন। বললেন-৫ বছর বেঁচে থাকলে যথেষ্ট। আরও অনেক কাজ করা যাবে।
পারিবারিক সূত্র মতে, একবুক আশা নিয়ে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয় শিল্পপতি নাসির উদ্দিনের শরীরে কেমোর প্রথম সাইকেল প্রয়োগের মধ্যদিয়ে। কেমোর কমবেশি প্রভাবের কথা সবারই জানা, কিন্তু এ কেমো এতটা ভয়ংকর ও আগ্রাসী হয়ে ওঠবে কে জানতো!
হ্যাঁ, সে কেমোই কাল হলো। কেমো প্রয়োগের দুদিনের মাথায় আইসিইউতে চলে যেতে হলো বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কিংবদন্তি নাসির উদ্দিনকে। ১ মাস ১৮ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে চিরতরে চলে গেলেন কীর্তিমান এ মানুষটি।
শিল্পপতি নাসির উদ্দিনের ভাতিজা (বড় ভাইয়ের ছেলে) সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমার চাচা ছিলেন অত্যন্ত নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ মানুষ। ভদ্রতা, বিনয় ও পরোপকারের ব্যতিক্রম উদাহরণ। মানুষকে অকাতরে দান করতেন, যিনি দান গ্রহণ করতেন তিনি ছাড়া আর কেউ জানতেন না। স্কুল-কলেজ, মসজিদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রসারণে দান-অনুদান দিতেন শর্ত জুড়ে দিয়ে। বলতেন, কেউ জানবে না, কাউকে জানাবেন না-এই শর্ত মানলে আমি সহযোগিতা করতে পারি।
মামুন বলেন, ‘এই হলেন আমার চাচা। তাঁর মতো বহুরৈখিক উদারতা ও পূর্ণাঙ্গ চরিত্রের মানুষ আজকের সমাজে সত্যিই বিরল। তাঁকে হারিয়ে আমরা অসহায়, অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম।
এসময় অজস্র-অগণন কীর্তির কারিগর চাচা নাসির উদ্দিনের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন ভাতিজা এস এম আল মামুন।
১৯৮৪ সালে মাত্র ২০০ শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্যাসিফিক জিন্স। চট্টগ্রামে তৎকালীন কারখানার নাম ছিল এনজেডএন ফ্যাশন। এক দশক পর ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেডে কারখানাটি প্যাসিফিক জিন্স নামে নতুনভাবে পথচলা শুরু করে। তখন কারখানাটিতে কাজ করতেন দেড় হাজার শ্রমিক। বর্তমানে প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেডে প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের।
প্রতিষ্ঠানটিকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসার মূল কাণ্ডারি ছিলেন নাসির উদ্দিন। বর্তমানে প্যাসিফিক জিন্স’র ব্যবসায় সামলাচ্ছেন তার তিন সন্তান সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, সৈয়দ মোহাম্মদ তানসীর এবং সৈয়দ মোহাম্মদ তাহমীর।
একুশে/এআর/এটি