মানবসেবার অনন্য নজির— পারিশ্রমিক ছাড়া হাজারের বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন


একুশে প্রতিবেদক : অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। জমানো টাকায় গাড়ি না কিনে, ডায়ালাইসিস মেশিন কিনেছিলেন তিনি। বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে গড়ে তুলেছেন বিশেষায়িত হাসপাতাল। সেখানে পারিশ্রমিক ছাড়াই শুরু করেন কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট। গত ১৪ বছরে সহস্রাধিক অপারেশনে সফলতার হার ৯৫ শতাংশ।

ডা. কামরুল জানালেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতার প্রতি সম্মান জানাতেই তাঁর এই প্রচেষ্টা। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রোগীদের নিরাশ করতে রাজি নন তিনি। দুপুর থেকে প্রতিদিনই রোগী দেখেন, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেন সপ্তাহে চার দিন।

পাবনার ঈশ্বরদীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. আমিনুল ইসলামের ছেলে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে এফসিপিএস এবং ২০০০ সালে বিএসএমএমইউ থেকে ইউরোলজিতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকে তিনি এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ইউরোলজি সোসাইটি স্বর্ণপদক প্রদান করে।

দেশে যখন অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে না পারা অসংখ্য কিডনি রোগী অনিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছিলেন ঠিক তখনই ২০০৭ সালে নামমাত্র মূল্যে কিডনি সংযোজনসহ এ রোগের চিকিৎসায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতাল। করোনাকালেও থেমে থাকেনি তার চিকিৎসা।

তার প্রতিষ্ঠিত সিকেডি হাসপাতালে বিকল কিডনি রোগীদের জন্য অল্প খরচে কিডনি ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। নিজেই কিডনিদাতা ও গ্রহীতার অপারেশন করেন। বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক নেন না। শুধু অপারেশনই নয়, প্রতিস্থাপন-পরবর্তী রোগীর সব চিকিৎসাসেবা বিনা পয়সায় করেন তিনি।

সিকেডি হাসপাতালে অপারেশন-পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বিনামূল্যে করার ব্যবস্থা করেছেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সফলভাবে এক সহস্রাধিক রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। সাফল্যের হার শতকরা ৯৫ ভাগ, যা আন্তর্জাতিকপর্যায়ের সমকক্ষ।

প্রতি সপ্তাহে চার থেকে পাঁচটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় তার হাসপাতালে। প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তার ভাষ্য- সিকেডি হাসপাতাল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। অর্থ নয়, সেবাই তাদের কাছে প্রথম। ১০-১৫ লাখ টাকার ব্যয়বহুল কিডনি প্রতিস্থাপন চিকিৎসা সেখানে আড়াই-তিন লাখ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।

নিজের যাত্রা শুরুর গল্প তুলে ধরে ইউরোলজিস্ট এন্ড ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, একটি মেশিনের নতুন দাম বেশি হওয়ায় পুরাতন মেশিন কিনলাম দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকায়। সেখানে বেঁচে গেলো প্রায় ১০ লাখ টাকা। যে টাকা দিয়ে দুইটি ডায়ালাইসিস মেশিন কিনতে পারি। পরবর্তীতে আমার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মামাকে বলার পর উনি তার বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতায় আমাকে আরও দুইটি মেশিন দান করে। সর্বমোট ৪টি ডায়ালাইসিস মেশিন নিয়ে ২০০৫ সালে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম।

নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমদিকে বুকে ব্যথা করতো যে কিডনি প্রতিস্থাপন করছি সেখানে যদি ভুল হয়ে যায়? বা কোনো ধরনের দুর্ঘটনা হয় তাহলে সবাই তো আমাকে ধরবে। অল্প খরচে ২২টি বেডে কিডনি ডায়ালাইসিস হয় এখানে। আছে, কিডনি গ্রহীতার আজীবন বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা।’

সহপাঠীরা যখন উন্নত দেশে বিলাসি জীবন যাপন করছেন তখন বিভিন্ন সময়ের অফার গ্রহণ করেননি এই চিকিৎসক। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘আমিও অনেক অফার পেয়েছি, কিন্তু এ মাটি আমাকে ছাড়েনি। আমার বাবা এ দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। এ দেশের মাটিতে বাবার রক্ত লেগে আছে। আমিও চেষ্টা করছি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করার।’

এদিকে গত ১৫ মার্চ অতিরিক্ত সচিব মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী স্বাক্ষরিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদকের’ জন্য মনোনীতদের নাম প্রকাশ করা হয়। তাতে চিকিৎসাবিদ্যা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য গুণী এ চিকিৎসককে মনোনীত করা হয়।

অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলামের স্বাধীনতা পদক পাওয়ার খবরে মো. এমএ রাজ্জাক ফেসবুকে লিখেছেস, “২০০৭ সাল থেকে আমার বোনের চিকিৎসা চলাকালীন দীর্ঘ সময় তাঁকে খুব কাছে থেকে চেনার ও জানার তৌফিক দিয়েছিলেন আল্লাহ, যার বদান্যতায় আশাহত মৃত্যু পথযাত্রী আমার বোনসহ অসংখ্য রোগী নতুন করে বাঁচার আশার আলো দেখতে পান। দীর্ঘ দিন মনমরা মানুষগুলোর মুখে হাসি দেখেছি। দোয়া করি মহান এমন ভালো মানুষগুলোকে দুনিয়া ও আখিরাতের সর্ব কল্যাণ দান করুন আমিন।’

রোজি আলম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার আম্মা আপনার পেশেন্ট, আমি অনেকদিন আম্মার সাথে ছিলামও আপনার হাসপাতালে। অনেক কাছ থেকে দেখেছি আপনাকে। আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুক। যেন আমার আম্মার মত রোগীদের আপনি সেবা দিয়ে যেতে পারেন।’

মোহাম্মাদ হোসাইন লিখেছেন, ‘ওনার কাছে একবার আমার ফ্যামিলি মেম্বারের চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অসম্ভব ভালো মানুষ।
নিজে চোখে দেখেছি দুপুরে লাঞ্চ তিনি অধস্তন কর্মীদের সাথে ক্যান্টিনে বসে খেতেন, যা রান্না হতো সেটা দিয়ে খেতেন এবং খুব মুখরোচক ভাবেই। তাঁর প্রতিষ্ঠানে গেলেই বুঝা যায় তিনি কেমন মানুষ, তাঁর অধস্তন কর্মীরাই তার সম্পর্কে বলা শুরু করবে। আল্লাহ নেক হায়াত দান করুন স্যারকে, সুস্থ রাখুক তাঁর ফ্যামিলিকে।’

সালাউদ্দিন মোল্লা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আপনারাই হলেন বাস্তব জীবনের নায়ক, মানবতার ফেরিওয়ালা। আপনারা আছেন বলেই পৃথিবী এখনও সুন্দর।’