সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

বান্দরবান পরিবেশের মৃত্যুপরোয়ানা, এক ইউনিয়নেই ২৮ ইটভাটা!

প্রকাশিতঃ ১৫ মার্চ ২০২২ | ৮:৩০ অপরাহ্ন


রিজভী রাহাত, বান্দরবান : বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন ২৮টি ইটভাটা। এসব ভাটার জন্য নিয়মিত কাটা হচ্ছে পাহাড়। পাশাপাশি ইট পোড়াতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা জন্য বনের গাছ।

এ ছাড়া লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ১৪টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হলেও তা কখনোই বন্ধ হয়নি। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত চলে যাওয়ার পরপরই আবার কার্যক্রম চালু করে ইটভাটা মালিকরা, যা এখন পুরোদমে চালু।

জানা গেছে, ভাটাগুলো ফসলি জমি, বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বনাঞ্চল ও পাকা সড়কের পাশে অবস্থিত। পরিবেশবান্ধব চুল্লি না থাকায় সেখান থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া লোকালয়ে চলে আসছে। এতে পরিবেশ দূষণ ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, জেলার সাত উপজেলায় ৭০টি ইটভাটার মধ্যে শুধু ফাইতং ইউনিয়নে ২৮টিসহ লামা উপজেলায় রয়েছে ৩৩টি ভাটা।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩-তে বলা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা নির্মাণ, ইট তৈরিতে কৃষি জমি বা পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করতে পারবে না। অনুমতি ছাড়া পাহাড় কাটা, খাল, পুকুর, নদীরপাড় বা চরাঞ্চল কেটে মাটি সংগ্রহ করা যাবে না। এলজিইডির সড়ক ইট ও মাটি পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো ধরনের কাঠ পোড়ানো যাবে না বরং মানসম্পন্ন কয়লা পোড়াতে হবে। অথচ নিয়মনীতি উপেক্ষা করেই গড়ে তোলা হয়েছে ভাটাগুলো। ভাটায় নেই পরিবেশবান্ধব চুল্লি নেই।

এদিকে একটি ইটভাটায় দৈনিক ২৫-৩০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে কয়েক লাখ ঘনফুট কাঠ পোড়ানো হচ্ছে এসব ইটভাটায়। তাই শুধু জরিমানা দিয়ে নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় ইটভাটা তৈরিতে সরকারী নিয়ম মানানোর পাশাপাশি জনসচেতনতাও দরকার বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির সব অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম সাতদিনের মধ্যে বন্ধের আদেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি প্রতিবেদন আকারে দাখিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. কায়েসুর রহমান ও মামুনুর রশীদ। এ সময় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইউএমবি, এসকেবি, এসবিডব্লিউ, এফএসি, ইবিএম, এমবিএম, এসবিএম, এমএমবি, পাইভএমবি, এমবিআই, এনআরবি, ইউএমবিসহ ১৪টি ইটভাটা বন্ধ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন তারা।

এছাড়া প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)-এর বিভিন্ন ধারায় অনুমতিবিহীন ইটভাটা স্থাপনের দায়ে ওই ১৪টি ইটভাটার মালিককে সর্বমোট ১৬ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল কাদের বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটা মালিক এতই প্রভাবশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না।

এইচবিএম ব্রিক ফিল্ডের মালিক হুমায়ন কবির জানান, তিনি অবৈধভাবে কোনো ব্লিক ফিল্ড চালাচ্ছেন না এবং পাহাড়ের মাটিও কাটচ্ছেন না।

স্থানীয় লোকজন প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করলে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। জেলা প্রশাসনের ১৪টি বন্ধ করে দিলেও ভাটার কাজ বন্ধ হয়নি। এ ঘটনা আমাদের বিস্মিত করেছে। আমরা আরো বেশি অসহায় বোধ করছি।

ইটভাটায় পাহাড়ের মাটি ব্যবহারের কথা অস্বীকার ও সরকারি নিয়মানুযায়ী কয়লার চুল্লি দিয়ে ইটভাটা তৈরিতে খরচ বেশি হওয়ায় নিয়ম মানা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ফাইতং ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কবির খান। তিনি বলেন, সরকারি নিয়মকানুন মেনে ইটভাটা পরিচালনা করতে গেলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। কয়লার দাম অনেক বেশি বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, আমরা আয়কর ও শুল্ক দিয়ে ব্রিক ফিল্ড পরিচালনা করে আসছি। পরিবেশ অধিদপ্তরেও আমরা আবেদন করে আসছি। কিন্তু আমরা ছাড়পত্র পাইনি।

বন্ধ ঘোষণার পরও ইটভাটা চালু রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগের তৈরি কাঁচা ইটগুলো পোড়ানো হচ্ছে। নতুন করে কোনো ধরনের ইট তৈরি করা হচ্ছে না। কয়েক কোটি টাকা লোকসান থেকে রক্ষা পেতে প্রশাসনের এ নিষেধাজ্ঞা মানতে পারছে কেউ।

বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তর কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, ‘বান্দরবানে মোট ৬৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর কোনোটিতেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ফলে সব ইটভাটাই অবৈধ। আগামী সপ্তাহে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে পুনরায় ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেব। ’

তবে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় পাহাড় কেটে গড়ে উঠা অবৈধ এসব ইটভাটা বন্ধে অভিযান পরিচালনার কথা জানান পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মফিদুল ইসলাম।

তিনি আরো বলেন, ‘বান্দরবন জেলায় কোনো ইটভাটা বৈধ নয়। পরিবেশ আইন অনুযায়ী এ জেলায় কোনো ইটভাটা পরিচালনা যাবে না। হয় আইন পরিবর্তন করতে হবে, না হলে ইটভাটা উচ্ছেদ করতে হবে।