রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা

প্রকাশিতঃ ১৪ মার্চ ২০২২ | ১:২৭ অপরাহ্ন


শান্তনু চৌধুরী : গেল ৬ মার্চ মানবজমিনে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রিপোর্টির শিরোনাম ছিল, ‘হারিছ নয়, মাহমুদুর রহমান মারা গেছেন’। রিপোর্টটি করেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। যেহেতু এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশ সরব সে কারণে রিপোর্টটি ভাইরাল হতেও সময় লাগেনি। প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সম্পর্কে হয়তো অনেকে জানেন তবু আলোচনার সুবিধার্থে সারাংশটি বলছি। এটি মূলত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু সর্ম্পকিত।

রিপোর্ট অনুসারে, তাকে রাষ্ট্রের তাবৎ গোয়েন্দা সংস্থা খুঁজে বেড়ালেও হারিছ চৌধুরী দীর্ঘ ১৪ বছর গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি ভারত বা লন্ডনেও যাননি। বাংলাদেশের ভেতরেই ছিলেন এবং ঢাকাতেই বেশিরভাগ সময় কাটান। ওয়ান ইলেভেনের পরপরই কিছুদিন সিলেটে অবস্থান করেন। ঢাকায় আসার পর তিনি নাম বদল করেন। নাম রাখেন মাহমুদুর রহমান। দীর্ঘ ১৪ বছর এই নামেই পরিচিত ছিলেন। পরিচয় দিতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে। ঢাকার পান্থপথে প্রায় ১১ বছর কাটিয়ে দেন এই পরিচয়ে।

রিপোর্টটি আলোচনায় এই কারণে যে, এখন মূলত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয় না বললেই চলে। তবে যারা মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছেন তারা জানেন তিনি সাংবাদিকতাকে কতোটা মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন বলেই এখনো এমন সব অনুসন্ধান তিনি করতে পারেন। এটি বলার কারণ হচ্ছে, এখন সংবাদ মাধ্যমের সংখ্যা বাড়লেও অনুসন্ধান তেমন একটা চোখে পড়ে না। একজন সাংবাদিক এটিকে রাষ্ট্রের সেন্সরশিপ বলে দোহাই দিয়ে পার পেতে পারেন না। একদম সাধারণ অনুসন্ধান বা স্কুপ নিউজও এখন সাংবাদিকের হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

হাল আমলের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরী ও রাজের বিয়ের কথাই যদি বলি, সেটিও কোনো বিনোদন সাংবাদিক আগে প্রচার করতে পারেননি যতোক্ষণ না তারা বলেছেন। এমন উদাহরণ আরো দেয়া যায়। সাংবাদিকরা যেন নিজেরা সবকিছু থেকে গুছিয়ে নিয়েছেন। যেন সেলফসেন্সরশিপে ভুগছেন তারা। সাংবাদিকের দায়িত্ব হচ্ছে প্রশ্ন করা, রাজনীতিকদের, আমলাদের কূটনৈতিকদের সবাইকে। এবং তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা। কিন্তু সাংবাদিকদের এই দায়িত্ব যারা জনগণের সেবক বা রাজনীতিবিদ তারা যে ভালো চোখে দেখবেন না সেটাই বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাদের খুশি রেখে কি সাংবাদিকতা চলে? ইদানিং তাই হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা অখুশি হবে এমন সংবাদ কেউ প্রচার করতে চান না। একইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতাতোষণকারী সাংবাদিকরাও তারাও চান সংবাদ সম্মেলন বা অন্য কোথাও ক্ষমতাসীনরা অখুশি হোক এমন কোনো প্রশ্ন করুক।

সাংবাদিকের কাজ সময়ের সত্যকে খোঁজা-দেখা-জানা-বোঝা আর জনমানুষকে তা জানানো। যাচাই-বাছাই করা তথ্য কোনো পক্ষ না নিয়ে যথাযথ প্রেক্ষাপটসহ জানানো। সাংবাদিকের সত্যান্বেষণকে পুস্তকি ভাষায় এভাবেই বর্ণনা করা যায়। আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সেই যাচাই বাছাইয়ের বিষয়টি আরো গভীরে। আরো আরো অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে খোঁজা। আগেই বলেছি, গেলো এক দশকে আমাদের দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেকটা লক্ষণরেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। করোনাকালে সেটি আরো প্রকটভাবে দেখা গিয়েছিল। অন্তত টেলিভিশন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একথা বলা যায়। সে সময়ের কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিস্কার হবে।

একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে গুলি করে দুই ভাই বিশেষ বিমানে বিদেশ পালাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্শেদ খান সস্ত্রীক চার্টার্ড বিমান ভাড়া করে যুক্তরাজ্য গেলেন। বিমান ভাড়া করে সস্ত্রীক যুক্তরাজ্যে গেছেন বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমানও। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের বড় ভাই। এছাড়া কানাডা গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফ। অথচ এসব বিষয়ে আমাদের তেমন কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্ট চোখেই পড়েনি। আর এই সব খবর জানাও গেছে তারা বিদেশ চলে যাওয়ার পর। করোনা ভাইরাসের কারণে বিমানবন্দরে নানা বিধি নিষেধ ছিল। এরপরও রন হক শিকদার এবং দিপু হক শিকদার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংকক গেলেন কীভাবে? তারা এমন কোনো অসুস্থও নন। তাদের নামে মামলা আছে, পত্রিকায় তাদের ছবিও ছাপা হয়েছে। অথচ তারা দেশ ছেড়ে পালাল সব দিক ম্যানেজ করে। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক কামাল আহমেদ এর একটা লেখা থেকে ধার নিচ্ছি।

তিনি লিখেছেন, ‘কয়েকজন ব্যবসায়ীর দেশছাড়ার খবর সাংবাদিকতার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আবারও তুলে ধরেছে। কিন্তু, এটি খবরের শেষ নয়, শুরু। এখনও জানা প্রয়োজন যারা বিদেশে গেলেন, তারা কোনধরনের বিমান ভাড়া করেছিলেন? দেশীয় বিমান সংস্থার, নাকি বিদেশি? যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে গন্তব্য হয়ে থাকলে ছোট বিমানে এই যাত্রা অসম্ভব। তাহলে কি বিদেশি কোম্পানির বিমান ভাড়া করা হয়েছে? ভাড়া বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়ে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেজন্যে নিশ্চয়ই অনুমোদন দিয়েছে? বিদেশি মুদ্রা খরচের জন্য তো কারণ দেখাতে হয়, বিশেষ করে যেখানে খরচের পরিমাণ ন্যূনপক্ষে কয়েক লাখ ডলার হবে। এই খরচ তো ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে নয়, যে কোম্পানির তহবিল থেকে খরচ হবে। ব্যাক্তিগত প্রয়োজনে যেখানে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা খরচের আইন আছে, সেখানে একটি সম্ভাব্য মহামন্দার কালে এতো বড় অংকের অনুমোদন কতটা স্বাভাবিক? সিকদার ভ্রাতৃদ্বয়ের মেডিকেল সার্টিফিকেট কি ভুয়া? কোন হাসপাতাল বা চিকিৎসক তা ইস্যু করেছেন? রাজনীতির সঙ্গে টাকার যোগসূত্রগুলো বোঝার জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। আবার যদি আমরা সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলর কথা বলি, যিনি কুয়েতে ভিসা বাণিজ্যের নামে মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের চক্রের অভিযোগে কারাগারে আছেন। তার বিষয়টিও আমরা জেনেছি কুয়েতে আটকের পর।

একথা ঠিক যে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখন আর আগের অবস্থানে নেই। এর প্রধান কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র এক ধরনের অলিখিত চাপ দিয়ে রেখেছে, সেটা একদিকে আইনের মাধ্যমে, অন্যদিকে সংবাদ মাধ্যমের মালিকপক্ষ এবং সাংবাদিক নেতাদের পকেটস্থ করে নানা সুযোগ সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে। যে কারণে ‘তিনি বলেন’, ‘তিনি আরো বলেন’ সাংবাদিকতা এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, নিউ এজ এর মতো কয়েকটি সংবাদমাধ্যম যে ব্যতিক্রম নয় তা বলবো না, তবে তাদেরও এগুতে হচ্ছে নানা প্রতিকূলতার মাঝে। আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে, পাবলিক সংবাদের ওই উপাদান গ্রহণ করে কিনা। সোজা বাংলায় খায় কিনা! সেটি টিআরপি, ফেসবুক লাইক কমেন্ট বা ইউটিউবের ভিউ বলে দেয়। প্রযুক্তির এই যুগে এসবকে এড়িয়ে যাওয়া যেমন ঠিক হবে না, আবার একথা ঠিক যে, পাবলিক খাওয়া নিয়ে সাংবাদিকতা হয় না। সে কারণে অনেক বিষয় পাবলিক না খেলেও সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে হবে। কারণ সংবাদ মাধ্যমের কাজ শুধুমাত্র সংবাদ প্রচার করা নয়। পাঠক বা দর্শকের মন, মনন, রুচি গঠনেও তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। প্রেস রিলিজ, ভক্সপপ, বাইট, ভিডিও বার্তা বা ফোনালাপ মার্কা সাংবাদিকতা আর যাই হোক নিজের ক্যারিয়ারে যেমন বাড়তি কিছু যোগ করবে না তেমনি পাঠক বা দর্শক সমাজেও কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক