মোহাম্মদ রফিক : চট্টগ্রামের উত্তর ফতেয়াবাদ হাজীপাড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘আল্ট্রা ডিজাইন এন্ড ফ্যাশন লিমিটেড’ নামের একটি কারখানা। সেখানে সূতা তৈরির সময় সৃষ্টি হওয়া অপ্রীতিকর গন্ধ বাইরে বের করে দিতে কারখানার দেয়ালে লাগানো হয়েছে বড় আকারের আটটি এক্সহস্ট ফ্যান। এছাড়া কারখানার জেনারেটরের বিকট শব্দ তো রয়েছেই।
নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে স্থানীয় আলী আহমদ সেক্রেটারির বাড়ির বাসিন্দা ফরিদা বেগম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের ঘরের সঙ্গে আল্ট্রা ডিজাইন এন্ড ফ্যাশন লিমিটেডের কারখানা। কারখানার এক্সহস্ট ফ্যান ও জেনারেটরের শব্দে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সূতার বর্জ্যে ঘরের ছাদ, মেঝে, আসবাবপত্র ভরে যাচ্ছে। সূতার বর্জ্য এবং শব্দ দূষণ থেকে বাঁচতে ঘরের দরজা-জানালা দিনভর বন্ধ রাখতে হয়। ভিটে ছেড়ে যাওয়ারও উপায় নেই। নয়তো চলে যেতাম।’
একই এলাকার বাসিন্দা আবদুল করিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নাক-মুখ দিয়ে ঢোকা সূতার বর্জ্যে আমাদের পরিবারের সদস্যরা প্রায় সময় সর্দি, কাঁশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এক্সহস্ট ফ্যান সরিয়ে নিতে একাধিকবার বলা হলেও আমলে নিচ্ছেন না কারখানা মালিক সরওয়ার আলমগীর।’ অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার সরওয়ার আলমগীরের মুঠোফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
মুধু উত্তর ফতেয়াবাদ হাজীপাড়া নয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ও হাটহাজারীর একাংশজুড়ে অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে। নিয়ম-নীতি না মেনে লোকালয়ে গড়ে উঠা এসব শিল্পকারখানার কারণে মানুষের জীবন ও পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
হাটহাজারীর নন্দীরহাটের পশ্চিমে মাহমুদাবাদ পর্যন্ত গেলে ঘনবসতি এলাকায় চোখে পড়বে অন্তত পাঁচটি শিল্পকারখানা। এরমধ্যে আছে হারবিস কার্টন, পাইওনিয়ার কার্টন, বিজলী কার্টন, ফনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ নামে তিনটি কার্টন ফ্যাক্টরি এবং জেসন ব্রিডার লিমিটেড’ নামে একটি পোল্ট্রি খামার। এসব কারখানার বেশিরভাগের ফটকে কোন সাইনবোর্ড নেই।
মাহমুদাবাদের শেষ প্রান্তে ফসলি জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘আর জেএন ফুটওয়্যাার লিমিটেড’ নামের একটি কারখানা। এটির তিনপাশে সীমানা দেয়াল করা হয়েছে। এখনো কোন অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। নন্দীরহাটের পশ্চিমে শৈলবালা স্কুল রোডে আছে তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে ফোর এইচ গ্রুপের গার্মেন্টস কারখানা ‘চার্ম ফ্যাশন’। একই এলাকায় পুরনো বসতবাড়ি কিনে ‘সেঞ্জুরি ফুড প্রোডাক্টস’ নামে একটি ময়দার মিল গড়ে তুলেছে এস আলম গ্রুপ।
চার্ম ফ্যাশন ও ময়দার মিল লাগোয়া বাসিন্দাদের অভিযোগ, দিনরাত ময়দার মিলের এবং গার্মেন্টস কারখানার জেনারেটরের শব্দে অতিষ্ঠ তারা। ভুক্তভোগী চন্দন কুমার দাশগুপ্ত একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কারখানাগুলাের শব্দ দূষণে ঘুমাতে পারি না। কারাখানার পাশ দিয়ে কানে আঙ্গুল দিয়ে চলাফেরা করে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা। কারখানা মালিকরা প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।’
নন্দীরহাটের উত্তর পাশে ২০-২২ বছর আগে গড়ে উঠেছিল এশিয়া গ্রুপের ‘চিটাগাং এশিয়ান পেপার মিল’। যদিও এটির বিষাক্ত বর্জ্যে হালদা নদী দূষিত হওয়ায় সেটি বন্ধ করে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
উত্তর ফতেয়াবাদ হাজীপাড়ায় আছে এবিএস কাটন ফ্যাক্টরি। এই এলাকায় ফসলি জমি ভরাট করে ৮-১০ হাজার বর্গফুট জায়গায় গড়ে তোলা হচ্ছে বিশাল একটি গুদাম। এটি গড়ে তুলছেন মো. আইয়ুব নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। নকশা অনুমোদন না নিয়ে গুদাম নির্মাণকাজ পরিচালনা করায় কিছুদিন আগে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে সিডিএ। এ গুদাম লাগোয়া চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক ঘেঁষে ফসলি জমিতে কারখানা গড়ে তুলতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছেন ইকবাল নামে এক ব্যক্তি। এর অদূরে কারখানা গড়ে তুলতে ফসলি জমি ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে সীমানা প্রাচীর।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেল জংশনের অদূরে রেললাইন ঘেঁষে সাইনবোর্ডবিহীন কারখানা গড়ে তুলেছেন জনৈক সিরাজ নামে এক ব্যক্তি। তিনি থাকেন অক্সিজেন এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, ওই প্রতিষ্ঠানে সাবান তৈরির কাঁচামাল প্রস্তুত করা হয়। হাজী পাড়ার কৃষক নুরুল ইসলামের অভিযোগ, সাবান ফ্যাক্টরি থেকে প্রতিদিন বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য বের হয়। এতে জমির ফসল বিনষ্ট হচ্ছে। সাবানের কাঁচামাল প্রস্তুতের সময় হাজীপাড়ায় উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
পশ্চিম ছড়ারকুল এলাকায় সৈয়দ কাসেম সড়ক ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে সাইনবোর্ডবিহীন প্লাস্টিক বোতল রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট। এ প্ল্যান্টের রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে প্ল্যান্ট সংলগ্ন খাগড়িয়া ছড়ায়। ছড়া হয়ে রাসায়নিক বর্জ্য চলে যাচ্ছে হালদা নদীতে। রাসায়নিক বর্জ্যের কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দা গাজী মোহাম্মদ ইউনুচ বলেন, ‘প্লাস্টিক বোতল রিসাইক্লিং করতে প্রতিদিন ব্যবহার করা হচ্ছে কাস্টিক সোডাসহ ক্ষতিকর নানা রাসায়নিক পদার্থ। ছড়ার মাধ্যমে এসব বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে লোকালয় ও ফসলি জমিতে। সম্প্রতি এলাকার কৃষকরা প্ল্যান্টের মালিক জনৈক চিকিৎসক শহীদুল্লাহ্’র স্ত্রীকে আপত্তি দিলেও তিনি তা আমলে নিচ্ছেন না।’
সাইনবোর্ডবিহীন প্ল্যান্টের বিপরীতেই বাড়িঘর ঘেঁষে পাশে গড়ে তোলা ‘খাজা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কারখানার চুল্লি থেকে দিনরাত বের হয় বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। ওই কারখানার মেশিনের শব্দে অতিষ্ঠ ইমাম শরীফের বাড়ির বাসিন্দারা। দেখা গেছে, ইমাম শরীফের ঘরের পাশেই খাজা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ।
ভুক্তভোগী নুর বক্স বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শব্দ দূষণের কারণে জীবন বিষিয়ে উঠেছে। অতিমাত্রায় শব্দ দূষণের কারণে আমাদের বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কালো ধোঁয়া ও শব্দ দূষণের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কারখানার মালিককে বললেও তারা তা কানেই নিচ্ছেন না।’ পরিবেশ দূষণের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিষয়টি নিয়ে একুশে পত্রিকাকে কোন বক্তব্য দেবেন না বলে জানান খাজা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’র মালিক আব্দুল মোতালেব।
পশ্চিম ছড়ারকুল সন্দ্বীপ কলোনির পাশে ১০ একর ফসলি জমি ভরাট করে ‘রাজ’ নামে একটি আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আবছার। স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইউনুচের অভিযোগ, সরকারি সংস্থার অনুমোদন ছাড়া ফসলি জমি ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছেন আবছার। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পে চার-পাঁচটি ভবন গড়ে উঠেছে।অপরিকল্পিতভাবে এ ধরনের আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ। বর্ষা মৌসুমে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি নিষ্কাশন। পানির গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে স্থানীয়দের বাড়িঘর প্লাবিত হচ্ছে।
ফতেয়াবাদ স্টেশন রোডের পশ্চিমে সাবেক কমিশনার জাফর আলম চৌধুরীর বাড়ি পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি পলিথিন ফ্যাক্টরি। তবে এই ওয়ার্ডে শিল্প আগ্রাসনের ভয়ংকর চিত্র দেখা গেছে, চৌধুরীহাট কলেজ রোড ধরে পশ্চিমে গেলে। এই রোড ধরে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে চোখে পড়বে অসংখ্য শিল্প কারখানার ছড়াছড়ি। কলেজ রোডের আশপাশ এবং পাহাড়ি এলাকায় অন্তত ১০ থেকে ১৫টি মাঝারি এবং বড় কারখানার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দেখলে মনে হবে- এটি কোন জনপদ বা লোকালয় নয়, যেন মিনি শিল্পাঞ্চল। কোনটি রাস্তার পাশে ফসলি জমিতে, কোনটি বাড়িঘরের সাথে লাগানো, আবার কোনটি গড়ে তোলা হয়েছে পাহাড় কেটে।
কারখানাগুলোর মধ্যে আছে চটের ফ্যাক্টরি, গ্লোরি ট্যাবস, আল আমিন বেকারি, ইসমাঈল নিটিং এন্ড গার্মেন্টস, বেনকর ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন, সাফারি ফুড, সাকিব এলমুনিয়াম ফ্যাক্টরি ইত্যাদি। স্থানীয় বাসিন্দা মাহফুজ আলম বলেন, ‘এক দশক ধরে এলাকার পরিবেশের উপর তাণ্ডব চালাচ্ছেন পুঁজিপতিরা। সিডিএ’র নতুন মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এটা শিল্পাঞ্চল নয়। সরকারি সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একের পর এক শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালীরা।’
চসিকের ‘ঠান্ডাছড়ি’ পর্যটন স্পটের দক্ষিণ পাশে পাহাড়বেষ্ঠিত ভূমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে এস আলম গ্রুপের সোলার প্ল্যান্ট। এর উত্তরে পাহাড়ি এলাকায় ২০২০ সালে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আল রাজী ক্যামিকেল কমপ্লেক্স লিমিটেড’ নামের একটি কারখানা। এ কারখানার পাশেই একই গ্রুপের আছে আরও দুটি কারখানা। এরমধ্যে একটিতে প্লাস্টিক দরজা অন্যটিতে পিভিসি পাইপ উৎপাদন হচ্ছে।
জানা গেছে, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ আরও কিছু রাসায়নিক উৎপাদন করতে আল-রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড গড়ে তোলা হয়। রাসায়নিক এই উপাদানটি টেক্সটাইল, ডাইং, ফার্মাসিউটিক্যালস, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, সাবান এবং পেপারের মতো শিল্পে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ব্যবহৃত হয়। প্রায় ১২ হাজার ১৪১ বর্গমিটার এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি নির্মিত। এই কারখানায় দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা হল শূন্য থেকে ৬০ শতাংশ ঘনত্বের ১৫০ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড।
অভিযোগ, পাহাড় কেটে ক্যামিকেল কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে। এ কারখানায় ইটিপি থাকলেও যথাযথ ব্যবহার হয় না। প্রতিদিন কারখানা থেকে লাল, নীল ও হলুদ রংয়ের তরল রাসায়নিক বর্জ্য ছড়িয়ে বের হয়ে খাল ও ছড়ায় পড়ছে। এসব বজ্য চলে যাচ্ছে হালদা নদীতে। স্থানীয়দের প্রশ্ন, পাহাড়ি এলাকায় ক্যামিকেল ফ্যাক্টরির মতো এতবড় কারখানা গড়ে তোলার জন্য সরকারি সংস্থা কীভাবে অনুমোদন দিল। কৃষকদের অভিযোগ, এই কারখানা থেকে প্রতিদিন বিষাক্ত তরল বর্জ্য পাহাড়ি ছড়া দিয়ে বয়ে স্থানীয় খাগড়িয়া ছড়া হয়ে হালদা নদীতে গিয়ে পড়ছে। এর ফলে বিপন্ন হচ্ছে এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী।
সরেজমিন দেখা যায়, আল রাজী ক্যামিকেল কমপ্লেক্সের মূল ফটকে কোন সাইনবোর্ড নেই। কারখানার পেছনে তেরি করা কয়েকটি নিষ্কাষন পথ দিয়ে বিষাক্ত পানি বের হয়ে পড়ছে ছড়ায়। পানির রং স্বচ্ছ হলেও উৎকট দুর্গন্ধ। স্থানীয় একজন বাসিন্দা জানান, দিনের বেলায় ক্যামিকেল কারখানা থেকে বের হওয়া পানির রং স্বচ্ছ দেখা গেলেও রাতে লাল, হলুদ, নীল বর্ণের পানি বের হয়।
কারখানা থেকে বিষাক্ত তরল বর্জ্য বের হওয়া প্রসঙ্গে আল রাজী ক্যামিকেল কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক মো. মবিন হোসাইন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাদের কারখানা থেকে পরিবেশের ক্ষতিসাধন হয় এমন তরল রাসায়নিক পদার্থ বের হওয়া অসম্ভব। আমাদের ইটিপি আছে। আমাদের কারখানায় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উৎপাদন হয়। আপনি (প্রতিবেদক) যেকোনো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বললে জানতে পারবেন, যেসব কারখানায় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উৎপাদন হয় সেসব কারখানার কারণে পরিবেশের ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব নেই। আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে।’
আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স থেকে বের হওয়া তরল বর্জ্য থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পানিতে কোন রং নেই এবং দুর্গন্ধও নেই।’ হালদা নদীতে পানি পড়া ও পাহাড় কেটে কারখানা স্থাপনের বিষয়েও তিনি জানেন না বলে জানান।
দক্ষিণ পাহাড়তলীতে যত্রতত্র গড়ে উঠা শিল্প কারখানার কারণে পরিবেশের ক্ষতিসাধন হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করেননি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গাজী শফিউল আজিম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। বসবাস করেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। এলাকাটির পশ্চিমে পাহাড়, উত্তরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণে চট্টগ্রাম সেনানিবাস এবং পূর্বে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক। এলাকাটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মহাপরিকল্পনায় আওতাভুক্ত। গত দুই দশকের ব্যবধানে বদলে গেছে দক্ষিণ পাহাড়তলীর চেহারা। নব্বইয়ের দশক থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকায় শতাধিক ইটভাটা স্থাপন করে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলে। পাশাপাশি নদী ভাঙনের শিকার বিশাল জনগোষ্ঠি কোথাও পাহাড় কেটে, আবার কোথাও পাহাড়ের পাদদেশে শত শত বসতি গড়ে তুলেছেন।
আগের সেই ইটভাটা এখন বিলুপ্ত বলা চলে। কিন্তু ২৫-৩০ বছর ধরে ইটভাটার কালো ধোঁয়ার ক্ষত না শুকাতেই দক্ষিণ পাহাড়তলীতে দেড় দশক আগে থেকে শুরু হয়েছে শিল্পের আগ্রাসন। অবশ্য এর আগে এ এলাকায় হাতেগোনা কিছু কারখানা গড়ে উঠেছিল। বিগত দেড় দশকে বদলে গেছে দক্ষিণ পাহাড়তলীর চেহারা। কোথাও পাহাড় কেটে, কৃষিজমি বিনষ্ট করে, আবার কোথাও বাড়িঘর ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধশতাধিক ছোট, মাঝারি এবং বড় শিল্প কারখানা। কারখানার মধ্যে আছে- ক্যামিকেল, পোশাক, কার্টন, রাবার, চট, সাবান, জুতা উৎপাদন এবং প্লাস্টিক বোতল রিসাইক্লিনিং প্ল্যান্ট।
অভিযোগ আছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ‘ম্যানেজ’ করে এসব শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন শিল্পপতিরা। এর মধ্যে পাহাড়বেষ্ঠিত এলাকায় গড়ে উঠা ক্যামিকেল কারখানা এবং প্লাস্টিক বোতল রিসাইক্লিনিং প্ল্যান্ট থেকে নির্গত বিষাক্ত তরল দুষিত করে চলেছে খাল-বিলসহ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে। পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণ ছাড়াচ্ছে উত্তর ফতেয়াবাদ এলাকায় গড়ে উঠা রাবার, সাবান, চট ও পোশাক তৈরির কারখানা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দেড় দশক ধরে বিত্তশালীরা এলাকার পরিবেশ বিনষ্ট করে আসলেও সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকজন আছেন ঘুমিয়ে। পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনকেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। এতে স্বাস্থ্যগতভাবে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এলাকার দুই লাখ মানুষ। ব্যাহত হচ্ছে এসব মানুষের জীবনযাত্রা।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য অনুয়ায়ী, দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে গড়ে উঠা অধিকাংশ কারখানারই অনুমোদন নেই। সংস্থাটির ডিআইজি আব্দুল্লাহ আল সাকিব বলেন, ‘ঘনবসতি এলাকায় গড়ে তোলা এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। পাশাপাশি বায়ু, পানি, মাটি ও পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থাও সংকটের মুখে ফেলেছে। কেউ কেউ ফসলি জমি দখল করে খাল-ছড়ার গতিপথ পরিবর্তন ঘটিয়েছে।’
পরিবেশবিদরা বলেছেন, দক্ষিণ পাহাড়তলীতে গড়ে উঠা পরিবেশ বিধংসী শিল্প কারখানার বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে না পারলে আগামীতে মহাবিপর্যয় ঘটবে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মফিদুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’