মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১

দায়মুক্তি পাচ্ছেন ডিসি-মেয়রসহ দেড় শতাধিক অভিযুক্ত!

| প্রকাশিতঃ ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২২ | ৮:৫৬ পূর্বাহ্ন

 

জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার : প্রধানমন্ত্রীর ডজনখানেক অগ্রাধিকার ভিত্তিক মেগা প্রকল্পসহ কক্সবাজারে ৭৫টি প্রকল্পে সাড়ে ৩ লাখ কোটি হাজার টাকার উন্নয়নের কাজ চলছে।তন্মধ্যে মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, এসপিএম প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, ট্যুরিজম পার্ক, সাবমেরিন বেস, রেল ট্র্যাকস, শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, পিবিআই কার্যালয়, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প অন্যতম।

এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০ হাজার একরের অধিক ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ ঘিরে শিকড় গেড়েছে অবিশ্বাস্য দুর্নীতি। শাখা প্রশাখায় গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন সংঙ্ঘবদ্ধ দালাল চক্র। যারা এরই মধ্যে ভুমি মালিকদের অধিগ্রহণ বাবদ পাওয়া প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা থেকে কৌশলে ২০ % থেকে ৫০% পর্যন্ত কমিশন হিসাবে আনুমানিক আড়াই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

বিষয়টি নজরে আসলে দুর্নীতিবাজ সংঙ্ঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে কক্সবাজারে জোড়ালো অভিযান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। অভিযানে বড় ধরনের সফলতা পায় সংস্থাটি। ভূমি অধিগ্রহণ দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে এলএ শাখার সার্ভেয়ার ও দালালসহ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে সংস্থাটি।তাদের কাছ থেকে ঘুষের বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ৭ বস্তা সরকারি নথিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাগজপত্র উদ্ধারের ঘটনাও রয়েছে।

এ ছাড়াও তিনটি প্রকল্পের শুরুতেই ভূমি অধিগ্রহণে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প তিনটি হলো, কক্সবাজার পৌরসভার পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প, কক্সবাজার শহরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কক্সবাজার কার্যালয় নির্মাণ এবং মহেশখালীতে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) নির্মাণ প্রকল্প। গত ২০১৮ সাল থেকে এসব প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়।আলোচিত ও সদ্য চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন এসব অভিযান পরিচালনা এবং তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেন।

তদন্তে আমলা, রাজনীতিকসহ ১৫৫ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিনটি তদন্ত প্রতিবেদনে তিনটি প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে মোট ৭৮ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে তছরুপ হয়েছে প্রায় ৫৯ কোটি টাকা।

দুর্নীতিতে অভিযুক্ত দেড়শোতাধিক

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজার চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির সাথে কক্সবাজারের সাবেক ডিসি কামাল হোসেনসহ ৫৭ জন কর্মকর্তা- কর্মচারী ও দুর্নীতিতে বিভিন্নভাবে জড়িত রয়েছে দেড়শ’ ব্যক্তি। সেখানে জনপ্রতিনিধি, আওয়াগী লীগ নেতা, বিএনপি নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিকের নামও রয়েছে।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তার দেওয়া অভিযোগপত্র ও প্রতিবেদনে ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির সঙ্গে ১৫৫ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসার পর তাদেরকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য পৃথক তিনটি মামলা করে দুদক। তদন্তকারী কর্মকর্তার ৭৫০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ২৩ পদস্থ কর্মকর্তাসহ মোট ৪৪ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এতে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, সাবেক জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফসারসহ ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়।

এছাড়াও দুদকের তালিকায় দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে সাতজন রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে, তারা হলেন- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান এবং তাঁর ছেলে হাসান মেহেদি রহমান, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসেদুল হক (রাশেদ), মহেশখালী উপজেলার কালামারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান (শরীফ) এবং কক্সবাজার যুবদলের সভাপতি শরীফুল ইসলাম।

অভিযুক্তদের হুংকারে পিছু হটছে দুদক!

দুর্নীতির অভিযোগ উঠা তিন প্রকল্পে জড়িতরাসহ ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩০ জুন অভিযোগপত্র জমা দিলেও দুদক থেকে ওই তদন্তের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এত দিনেও। উল্টো ওই তিনটি তদন্ত বাতিল করে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ নিয়ে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারের সচেতন মহলের অভিযোগ, বিভিন্ন সময় কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা প্রকাশ্যে দুদক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিনকে শিবির আখ্যা দিয়ে বদলি ও চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়েছিলেন।

নাম প্রকাশ না করে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন বদলি পর গত প্রায় এক বছর ধরে কক্সবাজারে দুদকের অভিযান বন্ধ রয়েছে।

এ ছাড়াও এখনো পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়নি। এতে করে বোঝা যাচ্ছে প্রভাবশালীদের হুঙ্কারে দুদক পিছু হটেছে দুদক।

কক্সবাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযাগের শুরু থেকে অভিযোগ ছিল, অভিযুক্তরা অনেকেই দল বেঁধে ঢাকায় গিয়ে কক্সবাজারে দুদুকের অভিযান বন্ধে মন্ত্রী-সচিব এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জোর তদবির চালাচ্ছিলেন।

তবে প্রভাবশালীদের হুংকারে পিছু হটার অভিযোগ মানতে নারাজ কক্সবাজারের দুদকের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম।তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের অভিযান আগেও ছিল এখনো চলছে।