কোন জাদুবলে লুট হচ্ছে সাগর উপকূলের বালু


এম কে মনির : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সাগর উপকূলে বালু তোলার জন্য অনুমতি দেয়া হয়নি কাউকে। তাই সেখানে বালু উত্তোলন বন্ধ থাকার কথা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞাও আছে। কিন্তু এরপরও প্রকাশ্যে সেখান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সাগর উপকূল থেকে বালু তুলে আশপাশের নিচু জমি ভরাট করে আসছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। কিছু বালু আবার ট্রাক বোঝাই করা হচ্ছে। সেই ট্রাক চলে যাচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এই বালু তোলার পেছনে রয়েছেন প্রভাবশালীরা। বালু লুট থামাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেই।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, নির্বিচারে উপকূলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস, কৃষি জমি গ্রাস, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বনের জায়গা দখল করে পুরো সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলকে গিলে খাচ্ছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকটি শিল্প গ্রুপ। ইতিমধ্যেই বাঁশবাড়িয়ায় একশ একরের বেশি, মুরাদপুরের গোপ্তাখালীতে বিশ একর সমুদ্র তীরবর্তী নিচু ফসলি জমি গ্রাস করে উপকূল থেকে বালু উত্তোলন করে ভরাট করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ ও কোস্টাল এলপি গ্যাস।

অন্যদিকে বাড়বকুণ্ডের নড়ালিয়া মৌজায় এলপি গ্যাস কারখানা করতে এসে সমুদ্র-উপকূল গিলে খাচ্ছে ক্যাপিটাল পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। ২০১৯ সালে এলপি গ্যাসের যুগোপযোগী টার্মিনাল নির্মাণ ও স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ এনে দেওয়ার টোপ দিয়ে কৃষি জমি ক্রয় করে ওই এলাকায় গেড়ে বসে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ৩ বছর পার হলেও এলপি গ্যাসের কারখানা না করে বালু উত্তোলন ও বেশি মুনাফায় কৃষি জমি বেচাকেনার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে ক্যাপিটাল। খাল, বন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটাতে থাকে। এরপর সাগর থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কয়েকশ একর নিচু কৃষি ভূমি ভরাট করেছে তারা। ইতিমধ্যে কয়েক হেক্টর বনাঞ্চল কেটে সাবাড় করেছে ক্যাপিটাল। খনন করছে উপকূলীয় ভূমি, বালু। মাটি উত্তোলন করে গভীর খাদের সৃষ্টি করছে সমুদ্র তীরে।

সম্প্রতি বালু উত্তোলনে আরও আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে বিতর্কিত এ প্রতিষ্ঠানটি। জানা যায়, বাড়বকুণ্ডে বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশের এলাকায় ক্যাপিটালের কাছ থেকে কয়েক একর নিচু কৃষি জমি কিনে নেয় কেআর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এনবি স্টিল। কেনার সময় শর্ত ছিল, ক্যাপিটাল সাগর থেকে বালু উত্তোলন করে জায়গাটি ভরাট করে দিবে। এ অনুযায়ী বিশাল ওই কৃষি জমিতে মাটি কেটে স্তূপ করেছে এনবি স্টিল। চারপাশে পুকুরের পাড়ের মতো মাটি স্তূপ করা হলেও মাঝখানে করা হয়েছে বিশালাকার খাদ। আর খাদ ভরাটেই বালু উত্তোলনের আয়োজন। তিনটি স্কেভেটর দিয়ে সেখানে চালানো হচ্ছে মাটি খননের কাজ।

একইসাথে বেঁড়িবাধ এলাকা থেকে প্রায় ১ হাজার মিটার পশ্চিমে অবস্থিত সাগরে লম্বা জোড়া পাইপ বসিয়ে সাগর থেকে বালু উত্তোলনও চলছে দিনরাত। বন বিভাগ ও সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিযান চালিয়ে পাইপ কেটে দেয়াসহ বালু উত্তোলন বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেন প্রতিষ্ঠানটিকে। কিন্তু বালু উত্তোলনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে ক্যাপিটাল। প্রশাসনের নির্দেশ উপেক্ষা করে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে হাতের মুঠোয় নিয়ে রাতের আঁধারে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী ভাড়া করে উপকূল ঘেরাওয়ের মাধ্যমে সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে এখনো বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

কেবল এলপি গ্যাস প্রতিষ্ঠান নয়, সীতাকুণ্ডের সাগর উপকূল থেকে বালু উত্তোলনে পিছিয়ে নেই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোও। সমুদ্রে জাহাজ বিচিং করার নামে বালু উত্তোলনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আছে এমন প্রচার চালিয়ে অবাধে লক্ষ লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলন করছে বেশকটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি বাঁশবাড়িয়ার আকিলপুর সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে বালু উত্তোলন শুরু করেছে মাদার স্টিল লিমিটেড ও এনবি স্টিল লিমিটেড নামের দুটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। শিপ ইয়ার্ড সংলগ্ন সমুদ্র থেকে বালু উত্তোলন করে অন্য ইউনিয়নে ক্রয়কৃত নিচু কৃষি জমি ভরাট করছে এ দুই প্রতিষ্ঠান। মূলত সাগরের নাব্যতা বাড়ানোর নামে ক্রয়কৃত কৃষি জমি ভরাটের জন্যই বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে তারা।

জানা যায়, গত জানুয়ারি মাস থেকে বাঁশবাড়িয়া আকিলপুর সমুদ্র সৈকত এলাকায় চারটি শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে দিনরাত বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে মাদার স্টিল ও এনবি স্টিল নামের শীপ ব্রেকিং ইয়ার্ড দুটি। ইতিমধ্যে ১ লক্ষ ঘনফুটের বেশি বালু উত্তোলন করে ইয়ার্ডের জায়গায় স্তূপ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ একমাস লোকচক্ষুর আড়ালে জোয়ারের পানির নিচে পাইপ বসিয়ে বালু উত্তোলন করে আসছে তারা।

দিনরাত সীতাকুণ্ডে উপকূল ধ্বংসের এতসব আগ্রাসী আচরণের পরও নীরব জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। আইন লঙ্ঘন ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখলেও এসব কোম্পানির ক্ষেত্রে পাইপ কেটে ও নোটিশ দিয়েই দায় সারছে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। আইন প্রয়োগে প্রশাসনের এমন অনীহা ভূমিকা নিয়ে জনমনে ওঠেছে নানা প্রশ্ন। কোটি টাকা মূল্যের বালু উত্তোলনের প্রমাণ মিললেও এখনো জরিমানা পর্যন্ত গুণতে হয়নি পরিবেশ বিধ্বংসী কাজে লিপ্ত এসব প্রতিষ্ঠানকে।

এদিকে সমুদ্র উপকূল থেকে শিল্প গ্রুপগুলোর অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস হয়ে সমুদ্র উপকূল মারাত্মক হুমকির পড়ছে। পুরোপুরি বিলুপ্ত হচ্ছে এ উপজেলার শতশত একর ফসলি জমি। সীতাকুণ্ডের অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাতকে নিয়ে সরকারের নেয়া নানামুখী পরিকল্পনাও ভেস্তে যেতে বসেছে।

একুশে পত্রিকার দীর্ঘ অনুসন্ধানে ওঠে আসে সীতাকুণ্ডের প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র। জানা যায়, বসুন্ধরা, ক্যাপিটাল পেট্রোলিয়াম, কোস্টাল এলপি গ্যাস, মাদার স্টিল ও এনবি স্টিলসহ সমুদ্র উপকূলে এসব প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসী ভূমিকার শুরু বেশ কয়েক বছর আগে। দখল-ধ্বংসে সব প্রতিষ্ঠানই নিয়েছে একই কায়দা-কৌশল। শুরুতে বেড়িবাঁধের পাশে অল্প পরিমাণ কৃষি জমি কিনে সীমানা নির্ধারণ করলেও পরবর্তীতে এসব প্রতিষ্ঠানের লোভের থাবা থেকে বাদ পড়েনি এক টুকরো কৃষি জমিও। রাতারাতি উপকূলীয় বনাঞ্চল, খাল, পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা একের পর এক দখল করতে থাকে তারা। চতুর্দিকে জমি ক্রয় করে অনেক জমির মালিককে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করার অভিযোগও কম নয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এভাবে মাইলের পর মাইল কৃষি জমি গ্রাস করে, পরে সাগর থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ভরাট করা হচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে প্রকৃতি-প্রতিবেশ।

এখানেই শেষ নয়, এসব প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসন থেকে রেহাই পায়নি সীতাকুণ্ড উপকূলের পরিবেশবান্ধব কেওড়া বনও। এখানকার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে কেওড়া বনাঞ্চলটি ধীরে ধীরে কেটে সাবাড় করেছে সবকটি প্রতিষ্ঠান। ফলে নদী তীরের সৌন্দর্যমণ্ডিত সারি সারি ঝাউগাছ বিলুপ্ত হয়েছে। এতদিন সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়ানোর পাশাপাশি সারি সারি এসব ঝাউগাছ সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে উপকূলবাসীকে বাঁচানোর প্রাকৃতিক প্রাচীরও ছিল। একের পর এক কেটে সাবাড় করায় সীতাকুণ্ডের সমুদ্রসৈকত এখন গাছশূন্য প্রায়। ফলে পর্যটন সম্ভাবনা ম্লান হওয়ার পাশাপাশি প্রাণ হারাচ্ছে প্রকৃতিও।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূল, বনাঞ্চল ধ্বংস, সরকারি খাস জমি দখল করে সীতাকুণ্ডকে কৃষি শূণ্য করার মাধ্যমে পুরো উপকূলের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান। প্রকৃতি ধ্বংস করে উপকূল গিলে খাওয়ার আয়োজন এখানে সম্পন্ন হলেও কার্যকর ভূমিকা রাখেনি প্রশাসন। অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলনের পাইপ ফুটো করে দিয়েই দায় সারে প্রশাসন। স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ‘কদিন আগে বাড়বকুণ্ডে ক্যাপিটাল এলপি গ্যাসের বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে। সেদিন বালু পাইপ কাটতে না পারলেও ফুটো করে দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু প্রশাসনের লোকজন মহাসড়কে ওঠার আগেই ক্যাপিটালের লোকজন পাইপ জোড়া লাগিয়ে পুনরায় বালু উত্তোলন শুরু করে। প্রশাসন তাদের (ক্যাপিটালের) কাছে জানতে চায়, বালু উত্তোলন করা হচ্ছে কিনা? তখন ক্যাপিটালের লোকজন বলে, বালু উত্তোলন বন্ধ রেখেছি। এভাবে হলে বালু উত্তোলন বন্ধ হবে না।’

জানতে চাইলে ক্যাপিটাল পেট্রোলিয়ামের ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা নাজিম উদ্দীন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সব হাতের মুঠোয় আছে। আপনি এসব রিপোর্ট যাই করেন, কোন লাভ হবে না। বালু উত্তোলন চলবে। কেননা সব জায়গায় টাকা ঢেলেছি। এসব রিপোর্ট বাদ দেন। বুঝেন তো বড় কোম্পানির খেলা! আর এলপি গ্যাস কারখানা করতে হলে বালু উত্তোলন করতে হয়।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসিক মাহমুদের মুঠোফোন নাম্বার চাইলে তিনি দিতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে এনবি স্টিলের স্বত্বাধিকারী মো. তছলিম উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বালু উত্তোলনের বিষয়টি ক্যাপিটাল দেখছে। আমরা তাদেরকে কন্ট্রাক্টে দিয়ে দিয়েছি। আমি বলেছি অনুমোদন নিয়ে তারপর যাতে বালু উত্তোলন করা হয়। অনুমোদন না দিলে আমি বালু উত্তোলন বা ফেলতে দিব না। সংশ্লিষ্ট সকলকে অবগত করেই আইনগতভাবে বালু উত্তোলনের প্রক্রিয়ার পক্ষে আমি।’

বালু উত্তোলন বিষয়ে জানতে চাইলে মাদার স্টিল শিপ ইয়ার্ডের মালিক মাস্টার আবুল কাশেম একুশে পত্রিকার কাছে কোন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে না বলেই পরক্ষণে বালু উত্তোলনের কথা স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, শিপ ইয়ার্ড শিল্পকে বাঁচাতে যা যা করার তা করা যাবে। শিপ ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ বালু উত্তোলন করতে পারবে। তাছাড়া এটা আমাদের একার বিষয় নয়। এটি পুরো শিপ রিসাইক্লিং এসোসিয়েশনের বিষয়। জাহাজ ভেড়াতে সমুদ্রের গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে দাবি করে আবুল কাশেম বলেন, শিপ ইয়ার্ড শিল্পের স্বার্থেই এসব করা হচ্ছে। শিপ ইয়ার্ড বাঁচলেই তো আমরা বাঁচব। তাছাড়া এসব বালু উত্তোলন করে আমরা ব্যবহার করছি না। তোলার পর সেগুলো একপাশে রেখে দিয়েছি। এগুলো সমুদ্রের গভীরতা বাড়াতেই করা হচ্ছে। আপনি ধরে নেন বালুগুলো সরকারই তুলছে।’

স্টিল শিপ ইয়ার্ডের মালিক মাস্টার আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা আগামীতে গ্রীণ শিপ ইয়ার্ড করব। সেটা করতে হলে যা যা করার করা যাবে। শিপ ইয়ার্ড বালু উত্তোলন করতে পারে, সেটা শিল্প মন্ত্রণালয়ও জানে।’ এসময় সরকারের কোন সংস্থা মাদার স্টিলকে বালু তোলার অনুমোদন দিয়েছে- জানতে চাইলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। মাস্টার আবুল কাশেম নিজের প্রভাবের জানান দিতে প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাকে মাস্টার কাশেম বলে সেটা জানেন তো? দেশ ও দশ তথা বৃহত্তর কোন ক্ষতি হবে সেরকম কিছু করবেন না।’

বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আজিজুল হক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সাগর থেকে বালু উত্তোলন করে সমুদ্র উপকূলকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এভাবে বালু উত্তোলন প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ। পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হোক।’ একই কথা বললেন সীতাকুণ্ড সমিতির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার কামরুদ্দোজা। তিনি বলেন, ‘বালু উত্তোলন করে সমুদ্র উপকূল গিলে খাচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ অন্যতম। এভাবে বালু উত্তোলন করে আমাদের পুরো সীতাকুণ্ডকে ধ্বংস করা হচ্ছে। দ্রুত পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ড বন্ধের দাবি জানাই।’

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব, সীতাকুণ্ড গবেষক মো. গিয়াস উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রভাবশালীরা যখন অপকর্ম ও অবৈধ কাজে জড়িত থাকেন, তখন তাদের প্রতিহত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সীতাকুণ্ড উপজেলার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু উত্তোলন করে ফসলি জমি ভরাট করার মতো পরিবেশ বিধ্বংসী কাজটি তারই প্রতিফলন। দীর্ঘদিন ধরে সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূল থেকে বালু উত্তোলনের ফলে সন্দ্বীপ চ্যানেল এখন হুমকির মুখে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসব কাজে বাধা দিতে গেলে উল্টো হুমকি মিলছে। অবস্থা অনেকটা মগের মুল্লুকের মতো। যার যা খুশি করছেন, কিন্তু কারও যেন কিছু বলার নেই। স্থানীয় প্রশাসন তাহলে কী করেছে? এভাবে এত দিন ধরে প্রকাশ্যেই বালু তোলা হচ্ছে, তা কি প্রশাসনের চোখে পড়েনি? প্রশ্ন হচ্ছে প্রভাবশালী বলে কি তাদের যা খুশি তা করার অধিকার জন্মে গেছে? আইনের শাসন কি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? কেন তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা হচ্ছে না?’

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ধারা ৫-এর ১ উপধারা অনুযায়ী, পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। ধারা ৪-এর (খ) অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারী দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বলা বাহুল্য, এসব আইনের কোনো প্রয়োগই সীতাকুণ্ডে দেখা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল হোসাইন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সমুদ্র থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে সমুদ্রের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। ফলে সাগরের পাড় ভাঙতে থাকে। সীতাকুণ্ডে যা হচ্ছে তা সেরকমই একটি বিষয়। যারা অবৈধভাবে সাগর থেকে বেশি পরিমাণে বালু তুলছেন তারা সাগরের গভীরতা বাড়িয়েছেন। ফলে উপকূলে ঝাউগাছ, কেওড়া গাছসহ সব ধরনের বৃক্ষ উজাড় হবে। কেননা সাগরপাড়ের মাটি সরে গিয়ে মাঝ সাগরে জমাট হচ্ছে। উপকূলীয় বন উজাড়ের ফলে একদিকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতির কবলে পড়বে সংশ্লিষ্ট এলাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমুদ্র থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায় প্রকৃতি ধ্বংসের খেসারত আমাদেরকেই দিতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) চট্টগ্রাম এর সমন্বয়ক এডভোকেট জিয়াউর রহমান কল্লোল একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমরা সীতাকুণ্ডের বালু উত্তোলন ইস্যুতে ১৪টি সংস্থাকে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করেছি। ক্যাপিটাল পেট্রোলিয়ালসহ অন্যান্য বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ সমুদ্র উপকূল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। এভাবে সীতাকুণ্ডের প্রকৃতি-পরিবেশকে ধ্বংস করছে। বিরাট ঝুঁকিতে পড়ছে সমুদ্র উপকূল। আমাদের লিগ্যাল নোটিশের প্রেক্ষিতে সংস্থাগুলো কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা পর্যবেক্ষণ করছি। পর্যবেক্ষণ শেষে ফলাফল সন্তোষজনক না হলে আমরা আইন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেব।’

এ বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইয়াং পাওয়ার ইন স্যোসাল এ্যাকশনের (ইপসা) প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড, বাঁশবাড়িয়াসহ পুরো সীতাকুণ্ড সমুদ্র উপকূল এলাকায় বালু উত্তোলন ইস্যুটি বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি কারণে। প্রথম হচ্ছে পরিবেশ ইস্যুতে, দ্বিতীয়ত হচ্ছে সরকার সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। সরকার যখন একটি এলাকাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে নিশ্চয়ই সেখানে অনেক পরিকল্পনা, প্রকল্প থাকবে। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সাজিয়েই গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতকে পূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রে রূপ দেয়া হবে। কিন্তু সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূল থেকে অবাধে বালু উত্তোলন, কৃষি জমির শ্রেণি পরিবর্তন, কৃষি জমি গ্রাস, ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসসহ যেসব পরিবেশ বিধ্বংসী যেসব কাজ চলমান আছে তা থাকলে সরকারের সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এমন কর্মকাণ্ড সরকারের গৃহিত পরিকল্পনার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।’

তিনি আরও বলেন, ‘বালু উত্তোলনের ফলে সমুদ্র উপকূল যে ঝুঁকিতে পড়ছে সেটি কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। এর ফলে সীতাকুণ্ডে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা ম্লান হবে। এরকম বৈপরীত্য চলতে দেয়া যায় না। সুতরাং এখনি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কঠোর হস্তে এসব পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। সীতাকুণ্ডে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এলাকা সাগর থেকে বালু উত্তোলন করেই ভরাট করেছে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ। তারা দেশের প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা করছে না। এভাবে একদিকে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে গৃহিত পরিকল্পনা অন্যদিকে বালু উত্তোলন, কৃষি জমিতে শিল্পায়নসহ পরিবেশকে ধ্বংস করতে নানা কর্মকাণ্ড। এমন বৈপরীত্য প্রকৃতি-পরিবেশ, জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, বনাঞ্চলের জন্য যেমন হুমকি তেমনি পর্যটন শিল্পের জন্যও ক্ষতিকর।’

দেশের অন্যতম এনজিও সংস্থা ইপসার কর্ণধার এ গবেষক আরও বলেন, ‘উপকূলীয় বন, বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সকল সরকারি দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে আইনের মাধ্যমে এসব এখনই বন্ধ করা দরকার। পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হলে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশে জলাধার সংরক্ষণ, পরিবেশ, বন রক্ষা, বালু উত্তোলন ও মাটি ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন আইন বহাল রয়েছে। এসব বিধ্বংসী কাজ বন্ধে দেশের প্রচলিত এসব আইনই যথেষ্ট। যা কিছু করতে হবে আইনের মাধ্যমেই করতে হবে। তবে খুব দ্রুত করতে হবে। কেননা এসব জায়গা একবার দখল বা ভরাট করা হলে তা আর ফেরানো সম্ভব নয়। একইসাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, গণমাধ্যম কর্মী, উন্নয়ন সংগঠন, সমাজকর্মী, সচেতন নাগরিক মহলকে এসবের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নিজে সচেতন হতে হবে, অন্যকেও সচেতন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় সরকারেরও কিছু আইন রয়েছে পরিবেশ সংক্রান্ত। সেখানে বলা হয়েছে কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় করতে হবে। বালু উত্তোলনে ২০১০ সালের একটি আইন রয়েছে। যেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা ও উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। বালু উত্তোলন বন্ধে নতুন কোন আইন প্রয়োজন নেই। প্রচলিত আইনের প্রয়োগই যথেষ্ট।’

শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলনের বিষয়ে আরিফুর রহমান বলেন, ‘শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলনের জন্য একটা সীমা দেয়া হয়েছে। জাহাজ যখন বিচিং করতে সমস্যা হয় তখন ওই নির্দিষ্ট এলাকায় জাহাজ বিচিং করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই করা যাবে। কিন্তু শিপ ইয়ার্ডের নামে বালু উত্তোলন করে কৃষি জমি ভরাটে ব্যবহার করার অনুমোদন সরকারই কখনো দেয় না। এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু শিপ ইয়ার্ডে এ ধরণের কোন অনুমোদন আছে বলে আমার জানা নেই। এসব পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ মূলত যারাই করছে তারা বাংলাদেশের বড় বড় শিল্প-কর্পোরেট গ্রুপ। যার কারণে তারা আইনের কোন তোয়াক্কা করছে না।’

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যারাই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে তারা অন্যায় করছে। এটি প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সীতাকুণ্ডের পর্যটন সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিতে পারে বালু উত্তোলন। বালু উত্তোলন বন্ধ হওয়া দরকার।’ শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলন বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ দিদারুল আলম বলেন, ‘শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলন করার অনুমতি আছে। কেননা সাগরে জাহাজ ভিড়তে সমস্যা হয়। ফলে ড্রেজিং করতে হচ্ছে। আমি নিজেই শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলনের অনুমোদন এনে দিয়েছি।’

বালু উত্তোলনে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেই- এ প্রসঙ্গে সাংসদ দিদারুল আলম বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া তো কেউ শিপ ইয়ার্ড ব্যবসা করছে না। সবার নামেই তো পরিবেশের ছাড়পত্র আছে।’ এসময় বালু উত্তোলনের অনুমোদন ও শিপ ইয়ার্ড ব্যবসার অনুমোদন একই কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, ‘বন্দর বিপুল পরিমাণ বালু উত্তোলন করছে, পরিবেশ অধিদপ্তর কী করছে, জিজ্ঞেস করুন। তবে শিপ ইয়ার্ড ছাড়া সীতাকুণ্ডে অন্য বালু উত্তোলনকারীদের বিষয়ে আমি জানি না। বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের আরও জোরালো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি।’ সীতাকুণ্ডে অবাধে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ বালু উত্তোলন করলেও তা বন্ধে প্রশাসনে নিস্ক্রিয় কেন জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ‘নিস্ক্রিয় কেন সেটি আমি জানি না। তারাই ভালো জানে। আপনি ডিসির সাথে যোগাযোগ করুন। এ বিষয়ে তিনি ভালো বলতে পারবেন।’

এদিকে শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলনের অনুমোদন আছে- সাংসদের এমন দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বক্তব্য দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মফিদুল আলম। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘শুধু শিপ ইয়ার্ড নয়, সবার ক্ষেত্রে বালু উত্তোলনের আইন একই। যিনিই হোন না কেন বালু উত্তোলন করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি অবশ্যই নিতে হবে। শিপ ইয়ার্ড বালু উত্তোলন করতে পারবে- এমন কোন আইন আমার জানা নেই। আইন অমান্য করে সমুদ্র উপকূল থেকে বালু উত্তোলন দণ্ডনীয় অপরাধ। আমরা এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ক্যাপিটাল পেট্রোলিয়ামের বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে আমরা ইতিমধ্যে অভিযান পরিচালনা করেছি। তাদের বালুর পাইপ কেটে দেয়া হয়েছে।’ বর্তমানে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে দাবি করে ইউএনও বলেন, ‘ক্যাপিটাল বালু উত্তোলন বন্ধ রেখেছে, বন্ধের বিষয়ে তারা অঙ্গীকারও দিয়েছে। তবে শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলনের অনুমোদন আছে। তারা শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জাহাজ বিচিং করার স্বার্থে নাব্যতা বাড়াতে বালু উত্তোলন করে থাকে। সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’

জাহাজ ভাঙা শিল্পে নদীর নাব্যতা বাড়াতে উত্তোলিত বালু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বালু যেহেতু উত্তোলন করছে সেহেতু এক জায়গায় না এক জায়গায় তো তা রাখতে হবে।’

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনকে ব্যবহার করে বেড়িবাঁধের বাইরে ক্রয়কৃত কৃষি জমি ভরাটে সাগর থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জাহাজ ভাঙা শিল্পের জাহাজ বিচিং করার নাম দিয়ে মূলত নিন্ম কৃষি জমিই ভরাট করছে কোম্পানিগুলো। কিছু প্রতিষ্ঠান এক জায়গায় শিপ ইয়ার্ডের মালিকা হওয়ার সুবাধে বালু উত্তোলন করে নাব্যতা বাড়ানোর নাম দিয়ে বালু উত্তোলন করে অন্য ইউনিয়নে ক্রয়কৃত কৃষি জমি ভরাট করছে। সে সুযোগ আইনে আছে কিনা এমন প্রশ্নে ইউএনও বলেন, ‘কৃষি জমি ভরাট করে থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে শিপ ইয়ার্ড বালু উত্তোলন তাদের এলাকা থেকে করে থাকলে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিপ ইয়ার্ড সংলগ্ন এলাকায় বালু উত্তোলন করা হলে আমাদের করণীয় কিছু নেই। সেটি আলাদা বিষয়। তবে রাতের আঁধারে পুনরায় পাইপ জোড়া লাগিয়ে বালু উত্তোলনের বিষয়টি তদন্ত করা হবে এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আব্দুল হামিদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি যোগদান করেছি মাত্র দুদিন আগে। আপনি আমার কাছে কিছু জানতে চাইলে আমি জানাতে পারব না। একপক্ষে ১ মাস পর জানতে চাইলে আপনাকে জানাতে পারব। আমাদের বিভাগের অন্য কারও সঙ্গে আপনার যোগাযোগ থাকলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হুমায়ুন কবির একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের বালু উত্তোলন বিষয়ে আমি কোন তথ্য দিতে পারব না। আপনি চট্টগ্রামের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ছাড়পত্র, অনুমোদন, মামলা এসব বিষয়ে তারা বলতে পারবেন। আপনি সেখানে কথা বলুন।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নাজমুল আহসান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন কঠোর অবস্থান রয়েছে। ইতিমধ্যে সীতাকুণ্ডের যেখানে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে সেখানে সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিযান পরিচালনা করে বালু উত্তোলনের পাইপ কেটে দিয়েছে।’

বালু উত্তোলন বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সঠিক নজরদারি করা হচ্ছে না- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তো এত জনবল নেই যে রাতদিন সেখানে পাহারা দিয়ে বসে থাকতে পারবো। যখনই খবর পাচ্ছি, তখনই অভিযান করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকবার অভিযানে গিয়েছে এসিল্যান্ড। রাতের বেলায় যারা এসব করে তারা ক্রিমিনাল। আমরা অভিযানে গেলে তারা পালিয়ে যায়। কাউকে যদি ধরাশায়ী করতে না পারি তাহলে জেল-জরিমানা কাকে করব? প্রকাশ্যে করতে দেখলে আমরা কঠোরভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলনের বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, ‘শিপ ইয়ার্ডের বালু উত্তোলনের অনুমোদন আছে। জাহাজ বিচিং করার জন্য নদীর নাব্যতা ধরে রাখতে বালু উত্তোলন করতে পারবে। তবে সেই বালু অন্য এলাকায় কৃষি জমি ভরাটের উদ্দেশ্যে তুলতে পারবে না। এমনটা প্রমাণ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বালু উত্তোলন বন্ধের দায়িত্ব যাদের উপর অর্পিত তারাই এখানে ম্যানেজ। তারাই কোন না কোনভাবে বালু উত্তোলনকারীদের কাছে লাভবান হচ্ছেন। ফলে এসব কোম্পানিগুলো ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র উপকূলটাকে তারা তাদের পৈতৃক সম্পত্তি ভেবে নিয়ে যা খুশি তা করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীতে মানবের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ। আর সেই পরিবেশকে ধ্বংস করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে তারা। যারা এসব দেখভাল করবে তাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে বালু উত্তোলনকারীরা। এখনই সচেতন নাগরিক সমাজকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। না হলে আগামী প্রজন্মকে আমরা বাসযোগ্য পৃথিবী দিয়ে যেতে পারবো না।’