মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইটের ভাড়া এত বেশি কেন?

প্রকাশিতঃ ১ ফেব্রুয়ারী ২০২২ | ১২:২৮ অপরাহ্ন


শরীফুল রুকন : আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের আগরতলা থেকে আবুধাবি যেতে অনলাইনে টিকিট খুঁজেছেন এ প্রতিবেদক। এতে দেখা যায়, আগরতলা থেকে ইনডিগো এয়ারলাইন্সের ইকোনমি ক্লাসের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৭ হাজার ৮৯১ টাকায়; এই পথের দূরত্ব ৩ হাজার ৭৩২ কিলোমিটার। অন্যদিকে একইদিন ঢাকা-আবুধাবি রুটে গালফ এয়ারের একটি টিকিটের দাম ৭৭ হাজার ২৯১ টাকা; এই পথের দূরত্ব ৩ হাজার ৬৪৫ কিলোমিটার। দুটি টিকিটের মূল্যের ব্যবধান ৫৯ হাজার ৪০০ টাকা।

একই সময় বুধবার বিকেল চারটায় প্রতিবেশী তিনটি দেশ থেকে সৌদি আরবের রিয়াদে যাওয়ার টিকিট খোঁজা হয় অনলাইনে। এতে দেখা যায়, সৌদি আরবের রিয়াদ যেতে টিকিট মূল্য ইসলামাবাদ থেকে ২৫ হাজার টাকা; কাঠমান্ডু থেকে ২৮ হাজার টাকা; কলম্বো থেকে ৩২ হাজার টাকা; ঢাকা থেকে ৮০ হাজার টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপাল কম ভাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রী বহন করতে পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না- সেই প্রশ্ন এখন উঠেছে।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী সাংবাদিকদের বলেন, সৌদি আরব এক বছর ধরে নিয়মিত ফ্লাইটের অনুমোদন দেয় না। বিশেষ ফ্লাইটের খরচ অনেক বেশি। সব মিলে উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো এখন লাইফ সাপোর্টে আছে। তবু ভাড়া না বাড়াতে সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, চেষ্টা চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের টিকিটের দাম আকাশচুম্বী। গত বছরের অক্টোবর থেকে এই সংকট শুরু হয়ে চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত টিকিটের মূল্য আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। রিয়াদ, জেদ্দা, মাসকাট ও দুবাই রুটে ইকোনমি ক্লাসের স্বাভাবিক সময়ে একমুখী ভাড়া ছিল ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এখন সেটা প্রায় ৮০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ ছাড়া এত বেশি টাকা দিয়েও এখন টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া একই গন্তব্যের ফিরতি পথের দূরত্ব একই হলেও টিকিটের দাম ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা মাত্র।

প্রবাসীরা বলছেন, কয়েক বছর আগেও সৌদি আরবে যেতে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকায় টিকিট পাওয়া যেত। দুই বছর আগে এটি বেড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার হয়, আর করোনায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে আবার চালু হলে টিকিটের দাম ৬০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর এখন ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার বেশি দিয়েও কেউ কেউ কিনছে টিকিট। এভাবে দেশি ও বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এর ফলে প্রবাসী, শ্রমজীবী, বিদেশগামী যাত্রী, ওমরাহ যাত্রী, রিক্রুটিং এজেন্সি, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটরসহ সবাই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

টিকিট সরবরাহকারীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সিস অব বাংলাদেশ (আটাব)-এর সাধারণ সম্পাদক মাযজারুল এইচ ভূইয়া বলেন, সৌদি যেতে ২৫ হাজার টাকার টিকিট এখন ৮০ থেকে ৯০ হাজারের কমে পাওয়া যাচ্ছে না। জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, যাত্রীও কম যাচ্ছে না। তবু এত ভাড়া, এটি কোনো দেশে নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদার চেয়ে যখন জোগান কমে তখন দাম বাড়ে। বাংলাদেশ থেকে স্বাভাবিক সময়ে সব কটি এয়ারলাইনস যত ফ্লাইট পরিচালনা করত, করোনাভাইরাসের প্রভাবে তা এখন অনেক কম। এখন ফ্লাইটের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ কমেছে। এর ফলে টিকিটের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া সৌদি আরব ও দুবাইতে জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে যাত্রীর চাপ বেড়েছে। ওমরাহ যাত্রীর যাতায়াতও বেড়েছে।

কোনো কোনো এয়ারলাইনসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গুটিকয় এজেন্সি এই সুযোগে টিকিট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি করে অসহায় বিদেশগামী যাত্রীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ আছে, কিছু এয়ারলাইনস টিকিট বিক্রি ও বিপণন নীতিতে নাম ছাড়া টিকিট বুকিং বা তা ব্লক রাখার কারণে টিকিটের কৃত্রিম সংকট আরও০ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভেশন সিস্টেমে ফ্লাইটে কোনো সিট খালি থাকলেও ব্লক করে রাখার কারণে সেসব টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে দেখানো হয়। এদিকে আবার আসন খালি রেখে ছেড়ে যায় এসব ফ্লাইট।

জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ যাত্রী বাংলাদেশ বিমানে যাতায়াত করেন। অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ যাত্রী বিদেশি এয়ারলাইনসে চড়েন। সে ক্ষেত্রে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ালে অন্যান্য এয়ারলাইনস বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা তো ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়াতে পারে না। আন্তর্জাতিক রুটে মাইলেজ হিসেবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। একই রুটের টিকিট এক মাস আগে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হলে এখন কেন ৮০-৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি হবে? এটি বিদেশগামী গরিব শ্রমিকদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

উড়োজাহাজের টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সাবেক সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব বলেন, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতা এবং চাহিদা ও জোগান সম্পর্কে কোনো তথ্য বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ চাহিদা নিরূপণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অনুমতি নিয়ে এয়ারলাইনসগুলো পরিচালিত হয়। বেবিচক সব এয়ারলাইনসের বিভিন্ন রুটের ভাড়া অনুমোদন করে থাকে। কেন বেবিচক অস্বাভাবিক ভাড়া নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিচ্ছে না এবং ফ্লাইট সক্ষমতা ও অতিরিক্ত ফ্লাইটের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না, সেটা এক বড় রহস্য। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও এর ফলে জনগণের ক্ষতির দায় বেবিচক কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। টিকিটের দাম কমাতে এক বছর ‘ওপেন স্কাই’ (প্রতিটি এয়ারলাইনসকে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ দেওয়া) করার দাবিও জানান এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব।

আটাবের সভাপতি মনছুর আহামেদ কালাম বলেন, অতিরিক্ত দামের জন্য নতুন কর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাড়িঘর ও জমি বিক্রি করে, সুদে টাকা নিয়ে অতিরিক্ত মূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছুটিতে আসা কর্মীরা দ্রুত কাজে যোগ দিতে নিয়োগকর্তার কাছ থেকে চাপে আছেন। এ অবস্থায় সরকারি সংস্থা বিমানসহ অন্য উড়োজাহাজ সংস্থার মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট বাড়ানো যেতে পারে। এতে যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা বাড়লে টিকিটের দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

তিনি আরও বলেন, উড়োজাহাজ সংস্থার চাহিদা অনুসারে স্লট (ফ্লাইট সংখ্যার অনুমতি) বরাদ্দের প্রক্রিয়া দ্রুত করতে পারে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রবাসী কর্মীদের সুবিধার্থে বিশেষ ভাড়া নির্ধারণে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। উড়োজাহাজ সংস্থার টিকিটের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে একটি রেগুলেটরি বোর্ড গঠন করা উচিত।

বাংলাদেশ হজযাত্রী ও হাজি কল্যাণ পরিষদ সভাপতি আবদুল্লাহ আল নাসের বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে বিমানে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০টি আসন খালি যাচ্ছে। এটা জাতীয় সম্পদের বিশাল অপচয়। হজ ও ওমরাহযাত্রীর মাত্র ৩০ শতাংশ পরিবহন করে বাংলাদেশ বিমান। বাকি যাত্রী বিদেশি উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো পরিবহন করে। এতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, গুটিকয়েক ট্রাভেল এজেন্সি অবৈধভাবে বিমানের মতিঝিল বিক্রয় কার্যালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে শত শত টিকিট বরাদ্দ নিয়েছে। এতে ঢাকা-জেদ্দা রুটে এক ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে বিমানের মতিঝিল কার্যালয়ের খাতা ও কম্পিউটার পরীক্ষা করা হলে এজেন্সির নামে বরাদ্দ করা টিকিটের হিসাব পাওয়া যাবে। এতে কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয়ের তথ্যও বেরিয়ে আসবে।

এদিকে প্রায় সব উড়োজাহাজ কোম্পানির টিকিট অনলাইনে কাটার সুযোগ থাকলেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ক্ষেত্রে সেই সুবিধা নেই। অনলাইনে বাংলাদেশ বিমানের টিকিট বিক্রির সেবা গত বছরের ১০ আগস্ট থেকে বন্ধ আছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯ সালে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিমানের সমঝোতা হয়। ওই প্রতিষ্ঠান অনলাইনে টিকিট বিক্রির দায়িত্বে ছিল। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস জানিয়েছে, দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি বিমানের প্রত্যাশিত কার্যক্রম সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধাপে বারবার ব্যর্থ হয়। গত বছরের ১০ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটি বিমানকে সংশ্লিষ্ট সেবা বন্ধ করে। এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উপমহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস শিগগিরই উন্নত অনলাইন সেবা দেবে যাত্রীদের।

এদিকে বিমানের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি গন্তব্যে ভাড়া কমিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ১৬ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তবে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এই পাঁচ গন্তব্যের টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে বলে বিমানের সেলস কাউন্টারগুলো থেকে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিমান যে ভাড়া কমিয়েছে, তাতে প্রবাসীদের কোনো কাজে আসছে না। কারণ, গত পাঁচ মাস অনলাইনেও টিকিট বিক্রি বন্ধ আছে। তাই ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামীদের বেশি দামে টিকিট কিনতে হচ্ছে। অবশ্য বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই তারা নতুন করে ভাড়া কমিয়েছে।

বিমান কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতি সপ্তাহে আবুধাবীতে বিমানের চারটি ফ্লাইট, দুবাইতে সাতটি, দাম্মামে পাঁচটি, জেদ্দায় সাতটি ও রিয়াদে ছয়টি ফ্লাইট যায়। বিমান কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ঢাকা-জেদ্দা গন্তব্যে ইকোনমি ক্লাসের প্রতি টিকেটের একমুখী সর্বোচ্চ ভাড়া বর্তমানে ট্যাক্সসহ ৭২ হাজার ৪৫৫ টাকা, যা কমিয়ে ট্যাক্সসহ ৬৪ হাজার ৮২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা-রিয়াদ বা দাম্মাম গন্তব্যে ইকোনমি ক্লাসের একমুখী সর্বোচ্চ ভাড়া বর্তমানে ট্যাক্সসহ ৭০ হাজার ৭৫৮ টাকা, যা কমিয়ে ট্যাক্সসহ ৬৩ হাজার ১২৩ টাকা করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিমানের মুখপাত্র উপমহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার বলেন, বিমানের ভাড়া কমানোর বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে, জানুয়ারি থেকে এবং আসন খালি থাকা সাপেক্ষে নতুন কমানো ভাড়ায় টিকিট পাওয়া যাবে। এ বিষয় ঠিক হতে আরও কিছুদিন লাগবে। পরে যারা টিকিট কিনবেন, তারা কমানো ভাড়াতেই কিনতে পারবেন।