মোহাম্মদ রফিক : জীবনের অর্ধেকটা সময় মধ্যপ্রাচ্যে জীবনযুদ্ধ করে ফেরা সেই বৃদ্ধ আবুল কালাম আজাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে কিছুই আর জানা যাচ্ছে না। গত ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের বাকলিয়া ধানাধীন সৈয়দশাহ রোডে শেষ সম্বল হিসেবে অবশিষ্ট থাকা ভিটেমাটি থেকে পরিত্যক্ত ঘর অপসারণে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। বিষয়টি থানা পুলিশ ও র্যাবকে অবহিত করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে আদালতে। আদালত নিখোঁজকে উদ্ধারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছে। এরপর দিন, সপ্তাহ গড়িয়ে মাস অতিক্রম হতে চলেছে। তবে নিখোঁজের আজও সন্ধান মিলেনি।
নিখোঁজ আবুল কালাম কালাম আজাদের সন্ধানে দায়েরকৃত মামলার বাদী শাহাব উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘নগরের ব্যস্ততম সড়ক থেকে দিনে দুপুরে জলজ্যন্ত একজন মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছেন। বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয়। তবে বাহিনীগুলোর দায়সারা মনোভাব ও রহস্যজনক নিরবতা আমাদের খুবই বিস্মিত করেছে। আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?’ প্রশ্ন শাহাব উদ্দিনের।
আবুল কালাম আজাদ (৬০) চট্টগ্রাম মহানগরের বাকলিয়া ধানাধীন সৈয়দশাহ রোডের সৈয়দশাহ কলোনী সোসাইটির ২৬৭৮/৩৯৭১ হোল্ডিংয়ের বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বিনাজুড়ি কাগতিয়ার মজিদা পাড়ার প্রয়াত ফয়েজ আহমেদ তালুকদারের পুত্র। এবং তিনি দুই কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক।
মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, আবুল কালাম আজাদ দীর্ঘদিন মধ্যপ্রচ্যের দুবাই শহরে চাকরি করেছেন। এসময় দেশে ছেলে-মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। ছোট মেয়েকে বিয়ে দেন ঢাকা এবং বড় কন্যাকে চট্টগ্রামে। বাবার টাকায় দুই ছেলে পাড়িদেন আমেরিকা-অস্টেলিয়ায়। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে খুবই অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আবুল কালাম আজাদ গত চার বছর আগে দেশে ফিরেন। এর এক বছর পর তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়।
অভিযোগে বলা হয়, প্রবাস থেকে পাঠানো সব অর্থ ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা, ছেলেদের বিদেশ পাঠানো, নিজেদের ভরন পোষণ, বাসা ভাড়া এবং বিয়েশাদীতে ব্যয় করেন তার স্ত্রী। তবে নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে দেশে ফিরে চিকিৎসা এবং থাকা খাওয়ার চরম কষ্টে পড়েন আবুল কালাম। আশ্রয় নেন ছেলের কাছে। দেশে ফেরার এক বছরের মাথায় স্ত্রী মারা যান। এরপরই তার জীবনে নেমে আসে চরম বিপত্তি। মায়ের মৃত্যুর পর অসুস্থ বাবাকে আর বাসায় রাখতে রাজি নন ছেলেরা। মেয়েদের কাছেও আর আশ্রয় মিলেনি। এমনকি বিদেশে থাকাকালিন নগরীর বাকলিয়া সৈয়দশাহ রোডের সৈয়দশাহ কলোনী সোসাইটিতে ক্রয়কৃত ভিটেমাটিতে থাকা পরিত্যক্ত সেমিপাকা টিনশেড ঘরে আশ্রয় নিতে গেলে সেখান থেকেও বিতাড়িত করা হয়। স্থান হয় খোলা আকাশের নিচে রাস্তার ধারে।
শাহাব উদ্দিন জানান, গত ৮ রমজান আবুল কালামকে খুবই অসুস্থ অবস্থায় নগরের অক্সিজেন এলাকায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। ওই সময় তার অসহায়ত্ব ও দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে তাকে স্থানীয় অক্সিজেন শীতল ঝর্ণা মাজার গলির জুলির মায়ের কলোনীর ব্যাচলর বাসায় নিয়ে আশ্রয় দেন। এরমধ্যে নিজের চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে ধার-দেনা করে লাখ টাকার বেশি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন।
শাহাব উদ্দিন বলেন, নিজের শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্নজনের কাছে ধার-দেনা করেন আবুল কালাম। এতে বেঁকে বসেন শ্যালক ও ছেলে-মেয়েরা। এ নিয়ে থানা পুলিশ ও সামাজিকভাবে বেশ কয়েকবার বৈঠকও বসে। তবে ছেলে-মেয়েরা এসবেও সফল হতে পারেনি।
মামলায় বলা হয়, গত ১৮ ডিসেম্বর স্বপন নামক এক চাচাতভাইকে সঙ্গে নিয়ে নগরের সৈয়দ শাহ রোডে অবস্থিত নিজের জায়গায় থাকা পরিত্যক্ত ঘরগুলো অপসারণে শ্রমিক নিয়ে যান আবুল কালাম। সে সময় বড় মেয়ে, ছোট ছেলে ও শ্যালক তাকে মারধর করে সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। এরপর থেকে তার আর খোঁজ নেই। এই বিষয়ে র্যাব ও থানা পুলিশকে জানানো হলেও কোনো প্রতিকার মিলেনি।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ও চট্টগ্রাম জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এডভোকেট মোহাম্মদ ফৌজুল আমিন চৌধুরী বলেন, প্রবাস ফেরত আবুল কালামকে ফিল্মি স্টাইলে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখার ঘটনায় নিখোঁজের ছেলে রিয়াজ উদ্দিন আহম্মদ, মেয়ে ফাহিমা আক্তার ও ফারহানা আক্তার এবং শ্যালক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৬৪ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। আদালত অভিযোগটি গ্রহণ করে নিখোঁজ ব্যক্তিকে দ্রুত উদ্ধারের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছে।
একই সঙ্গে নিখোঁজের মোবাইলের সিডিআর, সংবাদদাতার সঙ্গে নিখোঁজের সম্পর্কের সময়কাল এবং অতীত অবস্থান নিশ্চিত হয়ে আদালতকে অবহিত করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।