মোহাম্মদ রফিক : গণমাধ্যমের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে একজন অতিরিক্ত উপকমিশনারকে প্রধান করে জনসংযোগ শাখা পরিচালনা করছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। সাংবাদিকদের তথ্য দিতে জনসংযোগ শাখা চালু করা হলেও এর সুফল মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিএমপি সম্পর্কে নানা অভিযোগ বা প্রশ্নের জবাব মিলছে না। এছাড়া সিএমপি কর্তৃক উদঘাটিত অপরাধমূলক নানা ঘটনার খবর দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে ‘সাফল্যের খবর’ সাংবাদিকদের দ্রুত জানাতে সিএমপির কিছু থানার ওসি নিজেদের উদ্যোগে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলেছেন। এসব গ্রুপ থেকে সংবাদকর্মীরা দ্রুত ‘সাফল্যের খবর’ পাচ্ছেন। ফলে সিএমপির জনসংযোগ শাখা নয়, থানাভিত্তিক ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপে চোখ রাখছেন সংবাদকর্মীরা।
একজন গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘সিএমপির জনসংযোগ শাখায় স্থবিরতা বিরাজ করছে। এ দপ্তর থেকে সিএমপি সম্পর্কে নানা অভিযোগের জবাব, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন নানা সাফল্যের সংবাদ যথাসময়ে কিংবা দ্রুত গণমাধ্যমকর্মীরা পাচ্ছেন না। অধিকাংশ সংবাদকর্মীর সঙ্গে সিএমপির এই দপ্তরের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। হাতে গোনা কিছু সংবাদকর্মী সিএমপির অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান।’
সংবাদকর্মীদের তথ্য প্রদানের জন্য হোয়াটসঅ্যাপে ‘জার্নালিস্ট’ নামে একটি গ্রুপ খুলেছেন নগরের চান্দগাঁও থানার ওসি মঈনুর রহমান। তার দাবি, এ গ্রুপে চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন মিডিয়ায় কর্মরত ৮০ জন সংবাদকর্মী যুক্ত আছেন।
তাহলে সিএমপির জনসংযোগ শাখার কাজ কী, এমন প্রশ্ন উঠলে শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) ১০টা ৩২ মিনিটে দৈনিক যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার নাসির উদ্দিন রকি চান্দগাঁও থানার ওসির ‘জার্নালিস্ট’ গ্রুপে লিখেছেন ‘সিএমপির পিআরও নেই বললেই চলে’। এরপর রনি নামে আরেক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘সিএমপি হেড কোয়ার্টার ও পুলিশ কমিশনারের সংবাদ প্রেরণ। আর অন্যান্য থানার বাছাইকৃত কিছু প্রেস রিলিজ দেয়। অন্য থানারগুলো সিএমপি পিআর থেকে দেয় অনেক বিলম্বে।’
রনি আরও লিখেছেন ‘থানাভিত্তিক তথ্য দ্রুত পেলে নিউজ দ্রুত দেওয়াটা সম্ভব হচ্ছে। ক্রাইম নিউজ যারা করেন তাদের জন্য অনেক ভাল উদ্যোগ।’ এর উত্তরে গ্রুপ এডমিন চান্দগাঁও থানার ওসি মঈনুর রহমান লিখেছেন, ‘থানা থেকে খুব দ্রুত সংবাদ আপনাদের কাছে পৌঁছানোর জন্যই এই উদ্যোগ। আর এই উদ্যোগ যদি পজিটিভ হয়, যদি আসলেই আপনারা উপকৃত হন, যদি আসলেই জনগণ উপকৃত হয়, তাহলে এর পজিটিভ দিকটাই আপনারা দেখবেন আশা করি।’ একই গ্রুপে দিদার নামে এক সংবাদকর্মী লিখেছন, ‘ভালো উদ্যোগ আমি মনে করি।’
পুলিশ কর্মকর্তারাই বলছেন, সাংবাদিকদের তথ্য আদান-প্রদানের জন্য সিএমপির নির্দিষ্ট একটি শাখা রয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন থানা থেকে সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়া যাবে না। কারণ এমনটি হলে তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারে।
হোয়াটসঅ্যাপে ‘জার্নালিস্ট’ নামে একটি গ্রুপ খোলার বিষয়টি সিএমপি কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন বলে জানিয়ে চান্দগাঁও থানার ওসি মঈনুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কোন সংবাদ গ্রুপে দেব, আর না দেব- সেটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেই কাজ করি। চাঞল্যকর এবং বড় কোন অপরাধমূলক ঘটনার সংবাদ সিএমপি’র পিআরও দপ্তরেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
এদিকে সংবাদ সংগ্রহে একসময় সিএমপি সদরদপ্তরে গণমাধ্যমকর্মীদের যাতায়াতে তেমন কড়াকড়ি ছিল না। এখন বেশ কড়াকড়িই অরোপ করেছে কর্তৃপক্ষ। সিএমপির কোন কর্মকর্তার সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মীকে সদরদপ্তরের মূল ফটকে দায়িত্বপ্রাপ্তদের নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হচ্ছে।
অন্যদিকে তথ্যের জন্য সিএমপির সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কোন কর্মকর্তার সাথে কথা বললে বলা হচ্ছে, আপনি (প্রতিবেদক) জনসংযোগ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করুন। ফোন করলে জনসংযোগ কর্মকর্তাও ‘সংশ্লিষ্ট’ বিষয়ে অবগত নন বলে জানান।
জানা গেছে, কয়েকমাস আগে দামপাড়া পুলিশ লাইনের ভেতর নান্দনিক একটি মসজিদ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় সিএমপি। কিন্তু মসজিদটির ব্যয় কীভাবে বহন করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন করলে স্পষ্ট কিছুই জানাতে পারেননি সিএমপির জনসংযোগ কর্মকর্তা ও এডিসি (পিআরও) শাহাদাত হুসেন রাসেল।
অপরদিকে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকার আরেফিন নগরে পুলিশ সদস্যদের জন্য একটি আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। জানা গেছে, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কের পাশে বিশাল জায়গাজুড়ে ‘স্পেক্ট্রা’ নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পাহাড় কেটে মালামাল রাখার ইয়ার্ড বানিয়েছে। কয়েকমাস আগে পাহাড় কাটার দায়ে এ প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
জানা গেছে, ‘স্পেক্ট্রা’ থেকেই বড় একটি জায়গা কিনে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলছে সিএমপি। প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে গত দুইদিন ধরে পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই বিষয়ে সিএমপির জনসংযোগ এবং স্টেট শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে কোন তথ্য দিতে পারেননি।
চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় পত্রিকার একজন সাংবাদিক বলেন, ‘বছর দুয়েক আগেও সিএমপির পিআরও শাখার এমন দশা ছিল না। সাংবাদিকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। তথ্য আদান-প্রদান হতো। এখন তথ্যের জন্য পিআরও সেকশন নয়, সাংবাদিকদের মুখিয়ে থাকতে হচ্ছে থানার ওসি’দের ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের দিকে।’
সিএমপির অনুষ্ঠানে হাতে গোনা সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানোর অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন জনসংযোগ কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদাত হুসেন রাসেল। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।’ এসময় গেল বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ‘একুশে পত্রিকা’সহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে কর্মরত পেশাদার সাংবাদিকরা আমন্ত্রণ পাননি বলে উল্লেখ করা হলে সিএমপির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
সিএমপির জনসংযোগ শাখা নয়, থানার ওসিদের হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুক মেসেঞ্জার থেকেই দ্রুত সংবাদ পান গণমাধ্যমকর্মীরা। ফলে সিএমপির জনসংযোগ শাখা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে গুরুত্ব হারাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে এডিসি শাহাদাত হুসেন রাসেল বলেন, ‘আমি ছুটিতে আছি। সিএমপিতে এসেই বিষয়টি এনালাইসিস করে দেখব।’