শান্তনু চৌধুরী : মৃত্যু বড় নির্মম নিষ্ঠুর। আত্মীয় পরিজনের মর্মবিদারী কান্না কাকুতি-মিনতি কিছুই তার কানে প্রবেশ করে না। বিদায়ের সানাই বেজে উঠে, মনে হয় জীবন ফুরলো নাকি। এমনিতে কার কোথায় মৃত্যু সেটা জানতে নির্ভর করি সৃষ্টিকর্তার ওপর। কিন্তু ইচ্ছামৃত্যু! কতোটা অন্তর্দহন, কতোটা মানসিক অবসাদে থাকলে সেটা ঘটতে পারে।
সম্প্রতি গীতিকার রাসেল ও’নীলের আত্মহত্যার পর প্রশ্নটি আবার নতুন করে মনে এসেছে। যদিও উনার সাথে সরাসরি আমার পরিচয় ছিল না। কিন্তু গানের সুবাধে চিনতাম। তবে মৃত্যুর পর সুইসাইড নোটে যেটা জেনেছি সেটাও বেশ অবাক করার মতো!
এক সময় গান লেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করলেও দু’বছর ধরে ছিলেন বেকার। কিছুদিন আগে মৃত্যুবার্ষিকী গেল আরেক সাংবাদিক ও গীতিকার সঞ্জীব চৌধুরীর। তাকেও বেকারত্বের স্বাদ নিতে হয়েছে। হায়রে চাকরি! ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সিও।
এমন দিন খুব কম যায়, যেদিন পত্রপত্রিকায় আত্মহত্যার খবর থাকে না। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে গড়ে দৈনিক ২৮ জন আত্মহত্যা করেন। বেশির ভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী।
এছাড়া বাংলাদেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে আছেন। তাঁদের বেশির ভাগই অল্প বয়সী এবং ৮৯ শতাংশই নারী। প্রতিবছরই বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। তবে করোনাকালে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। এক যুগ আগে আত্মহত্যা করা সাংবাদিক মিনার মাহমুদের একটি চিঠির কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি।
‘সাংবাদিকতা পেশায় মেধাহীন আমি শ্রমই দিয়েছি। নিউজপ্রিন্টের ওপর বলপয়েন্ট দিয়ে ক্রমাগত লিখে যাওয়া-হাত ফুলে উঠতো, লাইট বাল্বের উত্তাপ দিয়ে সেক দেওয়া। আবার লেখা। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, সাংবাদিকতা পেশার নাম বিনিয়োগ করে কখনও আমি কি কোনও সুবিধা নিয়েছি? নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন চার হাজার টাকা। কোনও বাড়ি অথবা দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জমি নেই। আক্ষরিক অর্থে সর্বহারা।
একটা সময়ে বাংলাদেশকে আমি দেখেছি পর্বতের উচ্চতা থেকে। নিজের জন্য সম্পদ মাথায় আসেনি। আমি সর্বহারা। ‘কিছু নেই’ একজন মানুষ। বিচিন্তা আবার প্রকাশ করেছিলাম, পাঠকরা নেয়নি। পরে একটি চাকরির জন্য কত চেনা-অচেনা পত্রিকা, মিডিয়ায় চেষ্টা করেছি কেউ নেয়নি। অবাক হয়েছেন নিয়মিত লেখা এক সাংবাদিক। হাজিরা দেব, নিয়মিত লিখব, মাস শেষে একটা বেতন কোথাও হয়নি। কাউকে অভিযোগ করিনি’।
আসলে আত্মহত্যা কেন করে মানুষ? তার সঠিক কারণ কি কেউ কখনো বলতে পারে। তবে গবেষণা হয়েছে বিস্তর, হচ্ছে। আশির দশক পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করতেন, গভীর বিষন্নতা এবং অন্যান্য মানসিক রোগ, যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাই-পোলার, মুড ডিজর্ডার ইত্যাদির সঙ্গেই শুধু আত্মহত্যা জড়িত।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০ শতাংশ আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কোনো রকমের মানসিক রোগ জড়িত ছিল না। শুধু তা-ই নয়, আত্মহত্যার রোগীদের মস্তিষ্কের গঠন এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক পদার্থ এগুলোর মধ্যেও পার্থক্য পাওয়া যাচ্ছে একজন সাধারণ সুস্থ মানুষের তুলনায়। বিজ্ঞানীরা আরও খুঁজে পেয়েছেন জিনেটিক বা বংশগতির সূত্র। প্রায় ১৫-১৬ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই বংশগতির বা জিনেটিকের যোগসূত্র একেবারে প্রমাণিত। সেই সঙ্গে সামাজিক, পরিবেশগত কারণ এবং অন্যান্য ঝুঁকি মিলিয়ে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে।
ব্রিটিশ কবি থমাস শ্যাটারটন আত্মহত্যা করেছিলেন এই বলে যে ‘আমার মতো কোমল হৃদয়ের জন্য এই নির্মম পৃথিবী যোগ্য নয়।’ কেউ পৃথিবীর অযোগ্যতা, কেউ দেশের অযোগ্যতা, কেউ পরিবারের অযোগ্যতা, কেউ বা ব্যক্তির অযোগ্যতাকে অজুহাত করে এই আত্মহননের পথে যেতে পারে।
জাতপাতের বৈষম্য নিয়ে হায়দ্রাবাদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দলিত ছাত্র রোহিত ভেলমুলারের আত্মহত্যার ঘটনা বেশ আলোচনায় ছিল। তিনি লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমি বিজ্ঞান, আকাশের তারা, প্রকৃতিতে ভালোবাসতাম। কিন্তু তারপর একদিন মানুষকে ভালোবেসে ফেললাম। বুঝিনি প্রকৃতি থেকে মানুষের দীর্ঘদিন আগে এক বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। বুঝিনি, আমাদের অনুভূতি ধার করা। প্রেম বানিয়ে তোলা।
আমাদের বিশ্বাসেরও রঙ আছে। আমাদের নিজস্বতা প্রমাণিত হয় বানিয়ে তোলা শিল্পে। এসব কিছুই বুঝিনি আমি। কিন্তু বুঝেছি, দুঃখ না পেয়ে ভালবাসা সত্যিই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে’।
হার্ট অব ডার্কনেস–-এর লেখক জোসেফ কনরাড যৌবনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন জুয়ায়। জুয়া খেলায় প্রথম দিকে বেশ কিছু টাকা জিতে ভেবেছিলেন, খুব দ্রুত ধনী হয়ে যাচ্ছেন। তাই মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বেশুমার জুয়া খেলতে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু কপাল মন্দ, ভাগ্য সহায় হয়নি। খুব দ্রুতই হারতে শুরু করলেন জোসেফ। ধীরে ধীরে তাঁর কাঁধে চাপতে থাকল ঋণের বোঝা। শেষে তিনি বুঝতে পারলেন, এই ঋণ শোধ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। এখন কী করা যাবে? প্রতিদিনই তো বাড়িতে আসতে শুরু করেছে পাওনাদারেরা। পাওনাদারদের হাত থেকে মুক্তি পেতে এক উপায় বের করলেন জোসেফ-ভাবলেন মৃত্যু এ পরিস্থিতি থেকে তাঁকে দিতে পারে প্রত্যাশিত মুক্তি। তবে মরা কি এতই সস্তা?
‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়’ প্রবাদের মতো এখানেও কপাল খারাপ এই লেখকের। নিজের বুকে গুলি চালানোর পরও বেঁচে গিয়েছিলেন জোসেফ। গুলিটি তাঁর হৃৎপি-ে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এ ঘটনা ঘটেছিল ১৮৭৮ সালে। জোসেফের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে দীর্ঘ ১৬ বছর কাজ করেছেন তিনি, ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-দেশান্তরে। হয়তো এই ভ্রমণই তাঁকে লেখায় উৎসাহী করে তুলেছিল এবং তিনি লিখেওছিলেন বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাস-আউটকাস্ট অব দ্য আইল্যান্ড, লর্ড জিম, দ্য সিক্রেট এজেন্ট প্রভৃতি।
আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ফেসবুকে আত্মহত্যার স্ট্যাটাস দিয়ে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন। তিনি লেখেন, ‘মন চাইছে আত্মহত্যা করি। একটি চেকে আমি ডিসেম্বর বাংলায় লিখেছি বলে কাউন্টার থেকে চেকটি ফেরত দিয়েছে। কোন দেশে আছি?’ তিনি হয়তো জানেন, এই সেই দেশ, যেদেশে একদিকে উন্নয়নের জোয়ার বয়। গুটিকয়েক মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা হয়। অপরদিকে কিছু মানুষের জীবনযাপন ক্রমেই অভিশপ্ত হয়ে উঠে। যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে তাই পৃথিবীর অনেক দেশে আত্মহত্যাকে বৈধ করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে সারকো নামে এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে যা ব্যথা বেদনা বিহীন এক মিনিটে মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করবে। যা দেখতে অনেকটা কফিনের মতো। সেটির আইনি স্বীকৃতিও মিলেছে।
শুরু করেছিলাম রাসেল ও’নীলের আত্মহত্যার ঘটনা দিয়ে। যার পুরো নাম মেহবুবুল হাসান রাসেল। তার গানের কথা দিয়েই শেষ করি। তিনি গানে বলেছিলেন, ‘চোখে চোখে কথা হোক’। অথচ তিনিই বুঝে ফেললেন চোখ। বলে গেলেন, ‘যত দূরেই যাই/জানি না তো কবে/জেনে রেখো শুধু/ফের দেখা হবে।’ অথচ, তিনি সবাইকে ছেড়ে এতো ূূরে চলে গেলেন কে জানে ফের দেখা হবে কিনা? হয়তো দেখাও হতে পারে। কারণ এমনি করেই সবাই যাবে, যেতে হবে। দেহের মাপের মাঠির ঘরে শুতে হবে।
শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।