মো. রেজুয়ান খান : দশম শ্রেণি পড়ুয়া স্কুলছাত্রী বর্ষা থানায় গিয়ে পুলিশের সাহায্য চেয়ে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকানোর মাধ্যমে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করে। সরকারের পক্ষ থেকে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যা দিবস অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর বর্ষাকে ক্রেস্ট ও সংবর্ধনাসহ ‘সাহসী কন্যা’ উপাধি প্রদান করে। পুলিশ তাৎক্ষণিক বর্ষার বাল্যবিয়ে বন্ধসহ তার ইচ্ছানুযায়ী পড়ালেখা অব্যাহত রাখার পথকে সুগম করে দেয়।
বর্ষা চুয়াডাঙ্গা সদর ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। মামা, খালারা জোর করে বর্ষাকে বাল্যবিয়ে দিতে চায়। বর্ষার মাকেও বাল্যবিয়ের শিকার হতে হয়েছিল। বর্ষার বাবা বহু আগেই তার মাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। বাবা তাদের খোঁজখবর রাখে না। বর্ষা কাছ থেকে মায়ের দুঃখ, কষ্ট উপলব্ধি করেছে। মামা, খালাদের জোরের কাছে বর্ষার মায়ের কোনো অধিকার ছিল না বর্ষাকে রক্ষা করার। বর্ষা উপায় না দেখে সরাসরি চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় গিয়ে হাজির হয়। চুয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীনের কাছে তার বাল্যবিয়েতে অসম্মতি এবং পড়ালেখা চালিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করে। ওসি মহসীন তাৎক্ষণিক পুলিশ বাহিনী নিয়ে বর্ষাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। মামা, খালারা পুলিশ দেখে ভয়ে কোনো শব্দটি করেনি। এভাবে বর্ষার সুন্দর জীবন নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পায় বর্ষা।
অতিমারি করোনার ভয়াবহতায় বিশ্বের অনেক দেশেই মেয়েদের বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়ে গেছে। করোনা মহামারীর কারণে সারা দেশে আঠারো মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর সরকার ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল, কলেজ খুলে দেয়। বর্ষা আবারও স্কুলে যাওয়া আসা করছে। তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক সহপাঠীদের কাছে বর্ষা এখন সাহসী কন্যা। একইভাবে গত ১৫ অক্টোবর পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার জামতলী বাঙালি পাড়ায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা মুস্তফা।
এছাড়া, গত ১৩ অক্টোবর ভোলা জেলার লালমোহনে নবম শ্রেণির এক মাদ্রাসা ছাত্রী বাল্যবিয়ে ঠেকাতে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে পুলিশ প্রশাসন মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে না দেওয়ার মুচলেকায় মা-বাবার কাছে তাকে হস্তান্তর করে। ৭ অক্টোবর বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া আরেক সাহসী কন্যা রোজি খাতুন তার শিক্ষক ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। ৫ অক্টোবর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত জাতীয় কন্যা শিশু দিবস উপলক্ষ্যেও আলোচনা সভায় সাহসী কন্যা আমিনা, জেরিনা, মনোয়ারার মতো লড়াকু কন্যারা প্রশাসনের সহায়তায় তাদের বাল্যবিয়ে বন্ধ করাসহ উন্নত জীবনের জন্য পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার গল্প বর্ণনা করে। ৪ অক্টোবর জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার এক প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক তার নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে রাতের আঁধারে বাল্যবিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খবর পেয়ে রাত ১০টায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ঐ শিক্ষকের বাড়িতে হাজির হন এবং তাকে জরিমানাসহ মুচলেকা নিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করেন। এভাবে সাহসী কন্যাদের খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে।
মানবাধিকার অর্জনের অন্যতম শর্ত হলো নারীর অধিকার রক্ষা করা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর কখন বিয়ে হবে, কখন সন্তান নিতে হবে, নিরাপদ মাতৃত্ব ও পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, তা জানার অধিকারই হলো নারীর সাধারণ অধিকার। বাল্য বিয়ের কারণে শিশু কন্যাটির বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হতে পারে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়ের ভূমিষ্ট শিশুর শারীরিক গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়, অপুষ্টিতে ভোগে, এমনকি অপরিণত বয়সে মা হতে গিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকাটি মৃত্যু ঝুঁকিতেও থাকে। অপরিণত বয়সে মা হতে গিয়ে গর্ভের শিশুটি রোগাক্রান্ত হয়, শারীরিক পূর্ণতা পায় না। শিশুটির সুস্থ মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। সর্বোপরি অপরিণত বয়সে মা হওয়া বালিকাটিসহ তার শিশুটিও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবেই বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েটি ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কর্মহীনতা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে যায়। বাল্যবিয়ে বহু বিবাহের সৃষ্টি করে, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় এবং নারী নির্যাতনের হার বাড়ায়। এর ফলে দেশের উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
আধুনিক সমাজে কোনোভাবেই বাল্যবিয়েকে মেনে নেওয়া হয় না। বাল্যবিয়ে দেওয়া মানে হলো একটি সম্ভাবনাময় জীবনকে আটকে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সকলের অংশগ্রহণে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকার বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কন্যা শিশুর ঝরে পড়া বন্ধ করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। পাত্র বা পাত্রী যে কারও একজনের বয়স অপ্রাপ্তবয়স্ক, শিশু বা নাবালক হলে, তাদের বিয়েকে বাল্যবিয়ে হিসেবে গণ্য করা হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও তাৎক্ষণিক বিচারের জন্য ভ্রাম্যমান আদালতকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের সর্বোত্তম স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য জাতীয়ভাবে যাচাই কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় কমিটিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী সভাপতি হন। জেলা কমিটিতে সভাপতি হন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক।
উপজেলা কমিটিতে সভাপতি হন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং ইউনিয়ন কমিটিতে সভাপতি থাকেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকার ভ্রাম্যমান আদালত চালু করেছে। ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনায় ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকায় থাকেন ইউএনও। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে বন্ধে সরকার বাস্তবমুখী কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।
বাল্যবিয়ের প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে লোকসংগীত, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ স্থানীয় পত্রিকা, ক্যাবল নেটওয়ার্ক, বিলবোর্ড, পোস্টার, লিফলেট, প্রামাণ্যচিত্র, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং সামাজিক নেটওয়ার্কিং-এর মাধ্যমে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে প্রচারব্যবস্থাকে আরও জোরদার করা হয়েছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং তা নিরসনে জাতীয় কমিটির কাছে সুপারিশ প্রেরণসহ ৬৪টি জেলায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। নারী নির্যাতন ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকার চালু করেছে জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার। দেশের নারীদের সহায়তার জন্য যে কেউ যে কোনো প্রান্ত থেকে ১০৯-এ কল করে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পেতে পারেন। এছাড়া ৯৯৯-এ কল করেও পুলিশের সহায়তা নেওয়া যায়। সরকার দেশের ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন ও ৩৩০টি পৌরসভায় ৮ হাজারটি কিশোর-কিশোরী ক্লাব নির্মাণ করেছে। কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাদের এ ক্লাবগুলি জনগণকে সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছে এবং নিজেরাও বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রশংসনীয় কাজ অব্যাহত রেখেছে।
বাল্যবিয়ে দেশে প্রত্যাশিত প্রজন্ম তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে। বাল্যবিয়ে বন্ধে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কন্যাশিশুদের শিক্ষা লাভের সুযোগ ও এর বিকাশে বিশেষ কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার ফলে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছে। নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য অবদানস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬-এ ‘Planet 50-50 Award’, ‘Agent of Change Award’-এ ভূষিত হয়েছেন। গ্লোবাল উইমেন্স সামিট-২০১৮ সম্মেলনে ‘Global Women’s Leadership Award’ এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের Sustainable Development Solutions Network শীর্ষক নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার অর্জন করেছেন।
বিশ্বব্যাপী এখন প্রায় ৬৫ কোটি নারী জীবিত রয়েছেন যাদের বিয়ে হয়েছিল শিশু হিসেবে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বছরে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মেয়ের শিশু বয়সে বিয়ে হয়। নতুন এই তথ্য নির্দেশ করছে যে, ১০ বছর আগেও বিশ্বব্যাপী যতো সংখ্যাক মেয়ে শিশুবিয়ের শিকার হতো বলে মনে করা হয় সে সংখ্যাটি বৈশ্বিকভাবে ২ কোটি ৫০ লাখ কমেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুবিয়ে বন্ধ করতে অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় দ্রুততর করতে হবে। আরো দ্রুততর করা সম্ভব না হলে ২০৩০ সাল নাগাদ আরও ১৫ কোটির বেশি মেয়ে তাদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হবে। যদিও গত দশকে শিশুবিয়ে কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া নেতৃত্ব দিয়েছে।
শিশু বিয়ের বৈশ্বিক বোঝা এখন সাব-সাহারান আফ্রিকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে, তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিয়ে হওয়া শিশুবধূদের মধ্যে প্রতি তিনজনের মধ্যে প্রায় একজনই সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলের হলেও এক দশক আগে ছিল প্রতি পাঁচজনে একজন। নতুন তথ্য আফ্রিকা মহাদেশে অগ্রগতির সম্ভাবনাকেও নির্দেশ করে। ইথিওপিয়া যেখানে এক সময় সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে শিশুবিয়ের ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচ দেশের একটি ছিল, সেখানে এই দেশে বাল্যবিয়ের হার গত ১০ বছরে এক তৃতীয়াংশ কমেছে। তবে যেহেতু বিশ্ব ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুবিয়ে বন্ধের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তাই এই ভয়াবহ চর্চা এবং কণ্যা শিশুদের শৈশব চুরি করা ঠেকাতে সম্মিলিতভাবে আমাদের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে।
একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকারও ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে অঙ্গিকারবদ্ধ। বাল্যবিয়ে রোধ এবং কিশোরী কন্যাশিশুদের স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ ও সার্বিক আত্মউন্নয়নে সরকারিভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে যে বালিকারা বিশেষ ভূমিকা রাখছে, সরকারি উদ্যোগে তাদের ‘সাহসী কন্যা’ উপাধিসহ পুরস্কৃত করা হয়েছে। সারা দেশে এমন সাহসী কন্যাদের বীরত্বের কথা বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কন্যা শিশুদের আধুনিক প্রযুক্তিশিক্ষা লাভের পরিবেশ সৃষ্টি করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মানসে সকলকে সমস্বরে বাল্য বিয়েকে ‘না’ বলার অনুশীলনে ব্রত হতে হবে এবং তা হতেই হবে।
লেখক : তথ্য অফিসার, পিআইডি, ঢাকা।