পারভীন আকতার : জীবনে কখন কার মেধা উদগীরণ হয়, পুরোপুরি কাজ করে কেউ জানে না।একমাত্র আল্লাহই মেধার বিকাশ ঘটান। এবার এসএসসি’র তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছেন অনেকেই। এছাড়া জেএসসি’র অপরিপক্ক ফলাফলের উপর ভিত্তি করে এসএসসি’র ফলাফল দেয়া হয়েছে। এটা কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। ৮ম শ্রেণীতে রেজাল্ট খারাপ করা দূরন্ত, অমনযোগী সন্তানকে অনেক অভিভাবক যত্নের সঙ্গে পড়িয়ে ভালো করে আনলেও আজ তার ফলাফল ‘জিরো’।
৮ম শ্রেণীর রেজাল্ট কী এমন আহামরি যোগ্যতা নির্ণয়ে সহায়ক, আমি জানি না। বারো-তেরো বছর বয়সের একটা শিশু কী বুঝে লেখাপড়ার? কয়জন যথাযথভাবে নেয় মাথায় এমন গুরুভার? এসএসসি’র মত আজীবন জড়িয়ে থাকা ফলাফল তৈরিতে এমন অপকৌশল কাম্য নয়। তিন বিষয়ে পরীক্ষা আর এসাইনমেন্টের ভিত্তিতে ফলাফল দেয়ার দরকার ছিল? এটা দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীর প্রতি অন্যায়।
অনেক শিক্ষার্থী ভালো করেও ৮ শ্রেণীর ফলাফলের প্রভাবে জীবনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে কিনা সন্দেহ। আর কিছুই বললাম না। গ্রেড আর জিপিএ এর মাঝে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিবিষ্ট এই দেশে।
মনে রাখতে হবে, যে দিতে জানে না, সে পেতেও বেগ পাবে আজীবন। উন্নয়ন শিঁকেই উঠবে। আগামী প্রজন্মকে আমরা কতটা সম্মান দিয়ে জায়গা দিয়েছি তারাও মনে রাখবে। এসএসসি’র এমন মনঃক্ষুণ্ন ফলাফল অনেক শিক্ষার্থীর জীবন যেন হতাশায় পর্যবসিত না করে এই কামনা করি।
জীবনে কেউ মেধার স্ফুরণ ঘটাতে চাইলে সুযোগ দেয়া উচিত, যা এই দেশের নিয়ম দেয় না। তবে হ্যাঁ, সবসময় দেখে এসেছি ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রটিই জীবনে সফল হয়েছে এবং সফলতার চূড়া ছুঁয়েছে। আল্লাহ আমাদের সফল হতে তৌফিক দান করুন।
মনে করুন, আপনার ছেলে জেএসসি পরীক্ষার সময় মারাত্মক অসুস্থ ছিল। সে হাসপাতালে থেকে কোনমতে পরীক্ষা দিল।এবং পাশও করেছে মোটামুটি। এখন সে অনেক গোছানো, পড়ালেখায় মনোযোগী। সব বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এখন কি তাকে জেএসসির মাপকাঠিতে এসএসসিতে উত্তীর্ণ করালে আপনি মেনে নেবেন? কখনোই না। করোনা হোক বা অন্য কিছু বর্তমান খাতায় সে কী মেধার বিকাশ ঘটাল তাই দিয়ে গ্রেড নির্ধারণ করা কি বৈধ ও যৌক্তিক নয়? এতে কার উপর দোষ বর্তায়?
এই ধরেনের ফলাফল দিয়ে ভালো কিছুই হয় না বরং চরম বৈষম্য সৃষ্টি হয়। আমাদের সন্তানদের উপর জীবনের শুরুতেই কালিমা লেপন করা হয়। মেধাকে অকেজো করে দেয়া হয়। মানসিক অস্থিরতা তৈরি করা হয়। সুন্দরের পথে অসুন্দর ঢুকিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হয়।
একজন চাকরীজীবী অভিভাবককে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে কতটা বেগ পেতে হয় জানেন সকলেই। তবে বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কতটা কঠিনতর তা কেবল ভুক্তভোগী বুঝেন। এর বাইরে অন্যরা এই সংগ্রাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
আর অভিভাবকদের কাঁড়ি কাঁড়ি আর্থিক অপচয় তো হচ্ছেই লেখাপড়ার মেধা খোলার উঠোন তৈরি করতে। অথচ রাষ্ট্র চিল্লায় সুশিক্ষিত, সুনাগরিক দেশ গঠনের নিয়ামক। অথচ রাষ্ট্র অভিভাবকের হাতে তুলে দেয় জ্বলন্ত লোহার দণ্ড। নিজে চির নির্বিকার!
রাষ্ট্র কলমের জোগান দেয়। কিন্তু খাতার জোগান, যথাযথ শিক্ষা দেয়ার ফর্মূলা বাতিয়ে দেয় না! জন্ম থেকে সবাই প্রখর মেধা সম্পন্ন হবে এমন অভিপ্রায় খুবই আপত্তিজনক এবং সৃষ্টিকে অবমূল্যায়ন করার সামিল। তাই বলি সিস্টেম বদলানোর সময় এখন। আত্মমর্যাদা আর সম্মানের সাথে শিশুদের প্রথম থেকে বাঁচতে না দিলে দেশ একটি স্বার্থপর আগামী প্রজন্ম পাবে। আমি লজ্জিত এই সময়টা আমাদেরও দেখে যেতে হচ্ছে চরম গ্লানি নিয়ে। সবাইকে সমান চোখে দেখলে রাষ্ট্রের ভালো বৈ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মেধার উঠোন গ্রেডে নয়, বরং সৎ, ন্যায়পরায়ণ, কর্মদক্ষ প্রজন্ম তৈরিতে যেন সহায়ক হয় সেই পন্থার উন্মোচন হোক।
আমাদের নবীজি হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবনী পড়লে মনটা পরম শান্তিতে ঠাণ্ডা হয়। একজন মেষশাবক পালক কোন ডিগ্রী ছাড়া, পড়ালেখা ছাড়া আল্লাহর প্রিয় বান্দা, নবী ও রাসূল হয়েছেন। পুরো দুনিয়ার বাদশাহ হয়েছেন। পরম করুণাময় যাকে ইচ্ছে নিজেই শিখিয়ে দেন, সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেন। সম্ভাবনাকে কেউ জোর করে টেনে দাবিয়ে রাখতে পারে না। নিয়তির বিধান আর চেষ্টায় মানুষ এগিয়ে যেতে চাইলে তার সাথে সৌহার্দ্যের করমর্দন করা উচিত রাষ্ট্রকে।
আজ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জীবনী পড়ে শান্তি মেলে। স্টিফেন হকিংয়ের হুইলচেয়ার দেখে মনে শক্তি ও সাহস জাগে।আপনার সন্তানকে কখনোই হতাশ হতে দেবেন না। আর অভিভাবক হিসেবে নিজে আরও শক্ত মনোবলে এগিয়ে যান। জয় নিশ্চয়ই আসবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক; চট্টগ্রাম।