আজাদ তালুকদার, চেন্নাই (ভেলোর) থেকে : সায়েদাপেট বাজারের মেইন বাজার রোডে জমজমাট বাঙালিদের বাস, অর্থাৎ সিএমসিতে চিকিৎসা নিতে আসা বিশেষত বাংলাদেশি মুসলিমদের অবস্থান এখানে একটু বেশি। কারণ এদিকটায় লজ-এর ভাড়া তুলনামূলক একটু কম। রেডিও টুডের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান আবৃত্তিশিল্পী বিশ্বজিৎ পালের কল্যাণে ভেলোরেই দেখা হয় চট্টগ্রামের আবৃত্তিশিল্পী রুমি-জোবায়ের দম্পতির।
চিকিৎসা শুরুর আগে ৯০০ নম্বর ভবনে প্রাক রেজিস্ট্রেশনের সময় পরিচয় হয় খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের শিক্ষক আলমগীর ও তার স্ত্রীর সাথে। দুশিক্ষক-শিল্পীর গাইডার বা অ্যাটেনডেন্স হিসেবেই এসেছেন তাদের প্রিয়তম স্ত্রীদ্বয়।
চিকিৎসা সংক্রান্ত শিডিউল প্রাপ্তির দৌড়ঝাপ, ডায়াগনোসিস, চিকিৎসক অ্যাপয়েন্টমেন্ট- এসবের মাঝেও তাদের সঙ্গে ভাব তো জমলোই, ভাব জমে উঠল বাংলা ভাষাভাষী আরও অনেকের সঙ্গে। বিদেশ বিভুঁইয়ের ব্যাপারটা এমনই– বাংলাদেশি দেখলেই, বাংলাভাষাী হলেই মনটা আকুল হয়। সহযোগিতা-সহানুভূতির ব্যাপারগুলো উগড়ে পড়তে চায়।
চিকিৎসার আনুষঙ্গিতকার ফাঁকে বিদেশভূমির এসব স্বজনদের মুখে বার বার উঠে আসছে টিপু সুলতান দুর্গের কথা; পায়ে হাঁটলে সিএমসি (ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিজ কলেজ) থেকে এর দূরত্ব ২০ মিনিটের, আর অটোতে চড়লে ৫০ রুপি ভাড়া। ক’দিন ধরে ওই দুই দম্পতিসহ আমাদের টিপু সুলতান দুর্গ দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে এবং উদ্যোগ দুটোই ঘুরছিল। কিন্তু সময়টা মেলানোই যায় না। প্রতিদিন কারো না কারো চিকিৎসক অ্যাপয়েন্টমেন্ট অথবা ডায়াগনোসিস থাকেই।
তিনদিন আগে রাত ১১টার দিকে অন্নপূর্ণা রেস্টুরেন্টের সামনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা মেলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও ফুটবলার মাহবুবুর রহমান পাভেলের। ২০০১-২০০২ সালে চট্টগ্রাম আইন কলেজের এজিএস ছিলেন তিনি। বললেন, আমি আর রানু দুজনেই তার বেশ ঘনিষ্ঠ আপনজন। তার লজ-এ আমাদের নিয়ে গেলেন, আফসোস করলেন পরেরদিন রাতে দেশে চলে যাবেন বলে। গেল একমাসে কত মানুষেরই না উপকার করেছি, পাশে দাঁড়িয়েছি। আপনাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না- ভাবতেই ভীষণ খারাপ লাগছে। সত্যি সত্যি একবুক কষ্ট নিয়ে বললেন পাভেল ভাই।
সেই তিনিই আচমকা পরদিন বিকেলে ফোন করে আমাদের লজ (এল কে রেসিডেন্স) এর সামনে হাজির। বলেন, ভাই আজ রাত ১টায় রওয়ানা দেবো। আমি চাই এখনই আপনাদের নিয়ে অন্তত টিপু সুলতান দুর্গটা দেখে আসি।
তিনি বললেন, টিপু সুলতান, দ্য টাইগার অব মহীশুরের ফোর্ট (দুর্গ) না দেখলে শুধু ইতিহাস নয়, সাহসের চূড়া কাকে বলে তা সত্যিই মিস করবেন। তার কথাকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ হলেও ভ্রু উঁচিয়ে বলার মেজাজকে পাশ কাটানো কঠিন। এই ভঙ্গিমার মধ্যে একধরনের গর্ব আছে! তাই আর দেরি নয়, ছুটেছিলাম পড়ন্ত বিকেলে টিপু সুলতানের দুর্গে।
প্রথমেই বলে নেওয়া জরুরি, টিপু সুলতান দুর্গ মূলত স্থাপন করেছেন বিজয়নগর সাম্রাজের রাজা বিজয়নগর। টিপু সুলতানের মূল প্রাসাদ বেঙ্গালুরুর মহীশুরে। বর্তমানে সেই গ্রামের নাম শ্রীরঙ্গপত্তনম। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলায় অবস্থিত এটি-বলছে নেটদুনিয়া।
নেটদুনিয়া ঘেঁটে জানা গেল- রাজা বিজয়নগর ষোড়শ শতকে জলঘেরা দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন ভেলোরে। এর মধ্যে টিপু সুলতানের নাম আসার কারণ, ১৭৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় টিপু সুলতান নিহত হওয়ার পর তার পরিবারকে এখানেই বন্দি করে রাখা হয়। তখন দুর্গে ছড়িয়ে পড়ে বিয়োগান্তক আবহ। তার জীবনের শেষ সময়ের টানাপোড়েনের সঙ্গে এই দুর্গ যুক্ত।
দেখা গেল-এই দুর্গের সবকিছুই পাথর দিয়ে বানানো। এর নির্মাণশৈলী বিস্ময়ে ভরা। অনন্য একটি স্থাপত্য। বিভিন্ন করিডোর আর দুর্গের ছাদেও চাইলে যাওয়া যায়। এত সুরক্ষিত ও শক্তিশালী দুর্গ বা প্রাসাদ সচরাচর দেখা মেলে না! ভেতরে প্রবেশ করতে হলে সেতু পেরিয়ে যেতে হয়। কারণ চারদিকে পরিখা (শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক সুড়ঙ্গ বা লেক)। এরপরই চোখে পড়বে নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রহরীদের মূর্তি।
শুধু বাইরের সৌন্দর্যই নয়, দুর্গের ভেতরে আছে অসাধারণ একটি জাদুঘর। বিকেল ৫টায় এটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেখা হয়নি ৯০০-১৪০০ বছর আগের ব্রোঞ্জের দেব-দেবীর মূর্তি-ভাস্কর্যগুলো। যারা এই জাদুঘর দেখেছে তাদেরই ভাষ্য- জাদুঘরে সংরক্ষিত সেই সময়কার প্রাণীদের অবয়ব দেখে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে! জানা গেল, জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশ্রণ দিয়ে কাচের জারে রেখে দেওয়া হয়েছে জন্তু-জানোয়ার।
জাদুঘরের আরও অনেক কিছু নাকি আছে দেখার মত। এর মধ্যে খ্যাপাটে দেশপ্রেমিক টিপু সুলতানের ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র! ‘ভেল’ অর্থ বলা হয়ে থাকে ‘যুদ্ধাস্ত্র’। ‘অর’ মানে জায়গা। এই হলো সংক্ষেপে শহরটির নামের অর্থ। মানে টিপু সুলতানকে ঘিরেই ভেলোরের নামকরণ। আবার ‘ভেল’ অর্থ উত্তাপ, ‘অর’ মানে জায়গা। দাঁড়ায় উত্তাপের জায়গা। কিন্তু চিকিৎসা নিতে আসা গেল ১২ দিনে এই শহরে কোনোধরনেরই উত্তাপ চোখে পড়েনি, গায়ে লাগেনি। তাই মনে হলো যুদ্ধাস্ত্র’র শহরই যথার্থ।
রণক্ষেত্রে টিপু সুলতান কতটা প্রতাপশালী ছিলেন, সেটা নাকি বোঝা যায় জাদুঘরে ঢুকলে। প্রজাদের প্রতি তার প্রেম আর বাঘপ্রীতির নানান উদাহরণও আছে। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিল ডোরা দাগ, হাতলে ছিল খোদাই করা বাঘের মূর্তি। তার ব্যবহৃত রুমালও ছিল বাঘের মতো ডোরাকাটা। এমনকি রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোশাকে থাকতো বাঘের ছবি। সৈন্যদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারও এই খোদাই থেকে বাদ যেতো না।
টিপু সুলতানকে বলা হতো শের-ই-মহীশূর; অর্থাৎ মহীশূরের বাঘ। মজার ব্যাপার হলো, তাকে এই উপাধি দিয়েছিল তারই আজন্ম শত্রু ইংরেজরা। তার এই বাঘ হয়ে ওঠার পেছনে অনেক কারণে আছে। বরাবরই ইংরেজরা তার কৌশল, অসাধারণ ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তার কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছে। বাঘ বলার আরেকটি বড় কারণ, ছোটবেলা থেকেই বাঘের গল্প শুনতে ভালো লাগতো টিপুর। বাবা মহীশূর রাজ্যের সেনাপতি হায়দার আলী তাকে বাঘের গল্প শোনাতেন। গল্প শুনতে শুনতে কিশোর বয়সেই টিপু সুলতান বাঘ পোষা শুরু করেন। সেই যে বাঘপ্রীতি মৃত্যু অবধি তিনি বাঘের মতোই সাহসী, হার না মানা পুরুষ।
পাভেল ভাই জানালেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে মীর জাফরের ষড়যন্ত্রে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লার পতনের পর ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া শেষ মানুষ টিপু সুলতানই ছিলেন স্বাধীনতাকামী মানুষগুলোর আশাআকাক্সক্ষার প্রতীক। সেই মানুষটিও যখন তার বিশ্বস্ত মীর সাদিকের ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের গুলিতে কুপোকাত, মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটপট করছেন, তখনও এই টিপু সুলতান রক্তাক্ত, গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে তরবারি চালিয়ে গেছেন, ফলা ফলা করে কেটেছেন ইংরেজ সৈন্যদের। আরেকটু মজা করে বললেন, তিন মীর-এর বিশ্বাস ঘাতকতায় এই উপ মহাদেশে অস্তমিত হয়েছিল তিন সূর্য- মীর জাফর, মীর সাদিক ও মীর মোশতাক (খোন্দকার মোশতাক)। প্রথমোক্ত দুইজনের চরিত্রের সঙ্গে মিল বলে খোন্দকার মোশতাকের নামের আগে ‘মীর’ লাগাতে চান মাহবুবুল আলম পাভেল। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, বিশ্বস্ত খোন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্রে বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক বিয়োগান্তক ঘটনা বাংলাদেশের ১৫ আগস্ট। পাভেল ভাই-এর ‘মীর মোশতাক’ উপাধি সেই অর্থে মন্দ হয়নি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাবার মৃত্যুর পর টিপু সুলতান সিংহাসন নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন। রাজ্যের শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের ফ্রেমের ওপর সোনার পাত বসিয়ে সেখানে মণিমুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন। আট কোণার ওই আসনের ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বাঘের মূর্তি। ৮ ফুট চওড়া আসনটির রেলিংয়ে মাথায় বসানো হয় সোনা দিয়ে তৈরি দশটি বাঘের মাথা। আর ওপরে ওঠার জন্য ছিল দুধারে রূপার তৈরি সিঁড়ি। পুরো আসনই ছিল বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। এই ব্যাঘ্রাসনে বসেই মাঝে মধ্যে হুঙ্কার ছাড়তেন টিপু সুলতান।
কণ্ঠ ঝাঁঝালো করে বলতেন- ভেড়া বা শিয়ালের মতো ২০০ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দুদিন বেঁচে থাকাও ভালো! মূলত এই বাক্যেই সভাকক্ষ গা ঝাড়া দিয়ে উঠতো! জন্ম থেকে চির পরিচিত এই ঝাঁঝালো, সাহসসঞ্চারী এই বাক্য যে টিপু সুলতানের সাহসের চূড়া থেকে উত্থিত তা আমার জানা ছিল না। এটি নিঃসন্দেহে সংবাদকর্মী হিসেবে আমার অজ্ঞতা, ব্যর্থতা।
ব্রিটিশদের রক্ত হিম করে দেওয়া এই যোদ্ধাকে ভোলেনি ভেলোরের মানুষ। নয়তো বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নানান কীর্তির পরও এই স্থাপনাকে লোকে টিপু সুলতানের দুর্গ বলতো না। শক্ত পাথরের এই দুর্গেই মিশে আছে ভারতের স্বাধীনতাকামী প্রচণ্ড প্রতাপশালী বীরের নাম। মহীশুরের ক্ষিপ্র বাঘ টিপু সুলতান সত্যিকার অর্থেই হৃদয় থেকে হৃদয়ে বেঁচে থাকা যোদ্ধার নাম।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, টিপু সুলতান জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এভাবে বাঘের মতই লড়াই করে নিজের জীবন দিয়েছেন। তাকে ভারতের স্বাধীনতাকামিদের প্রতিক বলা হতো। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য একমাত্র তিনিই অবশিষ্ট ছিলেন। তাই ভারত দখলে বার বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ইংরেজরা আশ্রয় নেয় কূটকৌশলের। নিজ সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাস ঘাতকতায় অবশেষে ভারতের সূর্যের শেষ আলোটা ১৭৯৯ সালে চিরতরে নিভে যায়। আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় পুরো ভারত বর্ষ।
টিপু সুলতান নিহত হওয়ার পর ইংরেজরা চরম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি করে। চারিদিকে ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়। যা বিভিন্ন ঐতিহাসিকের লেখনীতে উঠে আসে। ভগবান এস গিদোয়ানী তার ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ লিখেছেন, ওই সময় ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিচালক রিচার্ড ওয়েলেসলি ‘মহীশূরের বাঘ’ টিপু সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর উল্লাস করে মন্তব্য করেন, ‘গোটা ভারতবর্ষই এখন আমাদের’। পরবর্তীতে টিপুর পরিবার, স্ত্রী সন্তানদের বন্দি করে নিয়ে আসা হয় ভেলোরের এই দুর্গে।
টিপু সুলতানের পরিবারের লোকজনকে যেখানে বন্দি রাখার পর কারো কারো মতে অনেককে হত্যা করা হয়, (টিপু সুলতানের চার স্ত্রী এবং ১৫ সন্তান, আত্মীয় ও মন্ত্রী পরিষদের অনেককেই এখানে বন্দি রাখা হয়) সেই জায়গাটি কখনোই খোলা হয় না। বছরের পর বছর তালাবদ্ধই থাকে।
টিপু সুলতানের সন্তানদের আত্মচিৎকার এসব দেয়ালের অন্ধকারে মিশে যায়। বেগম মহলের বেগমদের অশ্রু আর রক্তের স্রোতধারা যেসব পাথরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে তা আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। আমরা বেগম মহলের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কল্পনায় দেখতে পেলাম সুলতানের শিশু সন্তানগুলো জড়োসড়ো হয়ে যেন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সূর্য ডুবে গেছে, চারদিকে অন্ধকার। নিকষকালো অন্ধকারে পথ হাতড়ে আমরাও সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। আর ভাবছিলাম এমন অন্ধকারেই হারিয়ে গেছে একটি পরিবার, একটি ইতিহাস, একটি বাঘের গর্জন।