ঝকঝকে সড়কে ওয়াসা-পিজিসিবির কোপ


জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : উন্নয়ন আর সংস্কারের নামে চট্টগ্রাম নগরের প্রায় সর্বত্র চলছে নির্বিচার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। সরকারি সেবা সংস্থা গুলোর এক্সকাভেটরের কোপ পড়ছে সদ্য নির্মিত সড়কেও। কোথাও কোনো সমন্বয় নেই। সড়ক কাটা-ছেঁড়ার এই মহাযজ্ঞে জনদুর্ভোগের বিষয়টি মোটেই আমল পাচ্ছে না।

এবার নগরের আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কে একই সাথে কোপ বসিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি)। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নির্মিত এক্সেস সড়ক খুঁড়ে রাখার ফলে সাধারণ মানুষের পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ, ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক যানবাহন চলাচল করা প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কটি এখন পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে।

অনুমতি সাপেক্ষে এমন খোঁড়াখুড়ির চললেও পিজিসিবি এমন খনন কাজের বিষয়ে জানেন না দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা। অন্যদিকে ওয়াসার এই খনন কাজ চলছে নতুন ‘ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের’ আওতায়। সড়কটির বিভিন্ন পয়েন্টে আরও ৫টি খনন কাজ চালাবে সংস্থাটি। ফলে সহসা এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না নগরবাসী।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সদ্য নির্মিত আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কটিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে অপরিকল্পিত খনন কাজ করছে এসব সেবা সংস্থা। সড়কে তৈরি করা বড় গর্তের ঠিক পাশেই চালাচল করছে গাড়ি, সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নামমাত্র একটি ফিতা টাঙিয়ে দায় সারছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা।

ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের বাদামতলী থেকে বড়পুল পর্যন্ত সড়কের মোট ৭টি স্থানে ‘জয়েন্ট চেম্বারের’ খননকাজ করবে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে সড়কটির পুলিশ লাইন সংলগ্ন ছোটপুল অংশে একটি চেম্বারের কাজ শেষ করেছে ওয়াসা। দ্বিতীয় চেম্বারের কাজ চলছে সড়কের বেপারিপাড়া অংশে। এক্সেস রোডের আরও ৫টি অংশে পর্যায়ক্রমে ‘জয়েন্ট চেম্বারের’ খননকাজ করবে তারা। এক্ষেত্রে প্রতিটি চেম্বারের কাজ শেষ করতে সময় লাগবে প্রায় দেড় মাস।

অন্যদিকে পিজিসিবি জানায়, ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভলাপমেন্ট (এনপিটিএনডি) প্রকল্পের আওতায় এক্সেস রোডে হাজীপাড়া অংশে এই খনন কাজ করা হয়েছে। সড়কে খনন কাজে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) অনুমতি না পাওয়ায় আটকে ছিল এই প্রকল্পের কাজ। সম্প্রতি চসিক থেকে অনুমোদন পেয়ে কাজটি শুরু করেছে পিজিসিবি।

সরেজমিনে আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের হাজীপাড়া অংশে পিজিসিবির খননকৃত অংশ ঘুরে দেখা যায়, বেশ কিছু অনিয়ম। সড়কে প্রায় ১৫ ফুট দীর্ঘ ও ৪ ফুট প্রশস্ত ও ৭ ফুট গভীর এই আয়তকার খনন কাজটি করা হয়েছে সড়কের মাঝখানে। শুধু তাই নয়, গর্তের দুপাশের একটি বড় অংশজুড়ে রাখা হয়েছে খনন করা মাটি, যন্ত্রপাতি ও বিদুৎ বিভাগের গাড়ি। ফলে ১৫ ফুট সড়কের মিড আইল্যান্ড সংলগ্ন ৫ ফুট সরু জায়গা দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন।

এই খনন কাজের ও সড়ক দখলের ফলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। এছাড়া খননকৃত অংশে নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত দেখা যায়। একটি পাতলা ফিতা দিয়েই দায় সেরেছে সংস্থাটি। রাতের অন্ধকারে এই ফিতা তেমন দৃশ্যমান হয় না গাড়িচালকদের কাছে। নিয়ম অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে তাদের নির্দিষ্ট ফলক বা সাইনবোর্ড রাখার কথা। কিন্তু এখানে এমন কিছুই দেখা যায়নি।

এসময় সাইটে খনন কাজে নিয়োজিত তিনজন শ্রমিক ছাড়া কোনো দায়িত্বশীলকে (ঠিকাদার ও প্রকৌশলী) দেখা যায়নি। কর্মরত শ্রমিকেরা জানান, খনন কাজ শুরুর আগেই ঘন্টাখানেক দায়িত্বশীলরা ছিলেন। এরপর গত দুদিন, তারা কেউই আসেননি। ফলে নিজেদের অনুমান অনুযায়ীই কাজ করতে হচ্ছে তাদের।

এদিকে, এক্সেস রোডের বেপারিপাড়া অংশে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের আওতায় গেইট বাল্ব স্থাপনে খনন কাজ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ ফুট ও প্রস্থ ৭ ফুট। ওই অংশে ইতোমধ্যে খনন কাজ শেষে চলছে ‘কানেকশন চেম্বার’ স্থাপনের কাজ। গত ৩ দিন আগে শুরু হওয়া এই খনন কাজে গতকাল সকাল পর্যন্ত সংস্থাটির সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। পরবর্তী বিকেলে সাইনবোর্ড লাগানো হয় এই সাইটে। তবে নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে দেওয়া হয়েছে টিনের বেষ্টনী।

এদিকে দীর্ঘ সময় ও নানা ভোগান্তির পর নির্মিত এক্সেস সড়কে সেবা সংস্থাগুলোর খোঁড়াখুঁড়িতে ক্ষুব্ধ আগ্রাবাদের বাসিন্দারা। তাদের মতে, নগরজুড়ে প্রায় পরিপাটি সড়কে সেবা সংস্থার হানা যেন রীতিমতো নিয়মে পরিণত হয়েছে।

আগ্রাবাদের হাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোমিন হোসেন বলেন, দীর্ঘ ৪ বছর কষ্ট ভোগ করার পর এরকম একটা সড়ক আমরা পেয়েছিলাম। বছর না পেরুতেই ভোগান্তি দিতে সেবা সংস্থাগুলো হাজির। খোঁড়াখুঁড়ি তো করছে, এমনকি যারা এই খননকাজ করছে তারা নিজেদের সাইনবোর্ড পর্যন্ত দেয়নি। সবকিছুতেই চরম অব্যবস্থাপনা।

একই এলাকার বাসিন্দা আরেফিন রনি বলেন, ফ্রি রোড হওয়ায় এই রোডে খুব দ্রুত যানবাহন চালাচল করে। এতবড় একটা খনন কাজ করা হচ্ছে, অথচ নিরাপত্তার বিষয়ে কোন নজরই দেওয়া হয়নি। দুই ইঞ্চির পাতলা একটা হলুদ ফিতা দিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সেরেছে, কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনীও দেয়নি। যে কোনো সময় এখানে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বেপারিপাড়া এলাকার দোকানদার আব্দুল হাকিম বলেন, বর্তমানে রাস্তার শত্রু ওয়াসা। ভালো সড়ক দেখলেই তারা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। রাস্তা বানানোর আগে তারা এই কাজগুলো কেন করতে পারেনি? অনেক বছর ধুলোবালি খেয়ে আমরা স্বস্তির অপেক্ষায় ছিলাম। রাস্তা কাটার পর থেকেই যানজট, আর আমাদের ভোগান্তি শুরু। এর প্রভাব তো ব্যবসায়ও পড়ছে।

জানতে চাইলে পিজিসিবির এনপিটিএনডি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী চিরঞ্জীব দেওয়ানজী এ বিষয়ে কোনো তথ্যই দিতে পারেননি। কিছু জানার থাকলে চসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন তিনি। চিরঞ্জীব দেওয়ানজী বলেন, যেহেতু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে আমরা অনুমোদন নিয়ে এই কাজ করছি, তাই কিছু জানার থাকলে তাদের সাথে কথা বলুন।

পরবর্তীতে পিজিসিবি চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী সুবির কান্তি নাথ একুশে পত্রিকাকে বলেন, বছরখানেক আগে এনপিটিএনডি প্রকল্পে একটি ত্রুটি পেয়েছিলাম। এজন্য সড়ক খননের প্রয়োজন থাকলেও সেসময় চসিক থেকে আমরা অনুমোদন পাইনি। সম্প্রতি খননের অনুমতি পাওয়ার পর এই কাজ শুরু করি। আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়াসহ সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা আমরা ঠিকাদারকে দিয়েছিলাম। বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে কিনা খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম ওয়াসার সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, বেপারিপাড়ায় আমাদের কে-১ পাইপ লাইন আছে, সেখানে ডিএমএ জয়েন্ট চেম্বার স্থাপনের কাজ করছি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি পাওয়ার পরই আমরা খনন কাজ শুরু করেছি। সকল নিয়ম মেনেই এই কাজ করা হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন পানি জনগণের কাছে পৌঁছে দিতেই আমাদের এই কাজ। তবে জনগণের সাময়িক এই ভোগান্তির জন্য আমরা দুঃখিত।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিজেদের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বক্তব্যে। একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, এতবছর ধরে যখন সড়কটির নির্মাণ কাজ চলছিল তখনই তারা এই কাজগুলো করতে পারতো। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের স্বার্থে বাধ্য হয়ে এসব সংস্থাকে আমাদের সড়ক খননের অনুমতি দিতে হচ্ছে। এর জন্য তারা ক্ষতিপূরণ দিলেও এর মাধ্যমে করা সংস্কার কাজে সেই লেভেলটি মেইনটেইন করা যায় না। এগুলো সমন্বয়হীনতার উদাহরণ।

প্রসঙ্গত, জাইকার অর্থায়নে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কের বাদামতলী থেকে বড়পুল পর্যন্ত সড়কের নির্মাণকাজ। দীর্ঘ ৪ বছর নানা দুর্ভোগ ও ভোগান্তির পর ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগ্রাবাদবাসী পায় কাঙ্খিত এই সড়ক।