মেয়াদোত্তীর্ণ দেওয়ানহাট ওভারপাসের এখন মরণদশা


জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : গত ২ ডিসেম্বর নিজের মোটরসাইকেলে চট্টগ্রাম নগরের লালখানবাজার থেকে বারেক বিল্ডিং যাচ্ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবি ইরফাত হাসনাত। দেওয়ানহাট ওভারপাসের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ভাঙাচোরা রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যান তিনি। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরজুড়ে পান গভীর চোট। পরবর্তীতে পথচারীরা তাকে পার্শ্ববর্তী একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান।

তার ঠিক দুদিন পর ৪ ডিসেম্বর একই ওভারপাসে পাশাপাশি সংঘর্ষ হয় দুটি লেগুনার। খানাখন্দে ভরা সড়কে গাড়ি চালাতে গিয়ে গাড়ি দুটির চালকও হারিয়েছিলেন নিয়ন্ত্রণ। তারা জানান, চট্টগ্রামের প্রায় সড়ক বেহাল দশায় থাকলেও এই ওভারপাসের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। রাস্তার প্রায় জায়গা থেকে কার্পেটিং উঠে ছোট-বড় গর্ত হয়ে গেছে। গাড়ি চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

এভাবেই নগরের টাইগারপাস ও দেওয়ানহাটের মধ্যবর্তী ওভারপাসের বেহাল দশার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ভুক্তভোগী গাড়িচালকেরা। সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওভারপাসটি বেশ জরাজীর্ণ। শুধু সড়কের উপরই নয়, এর বিভিন্ন পিলারেও দেখা দিয়েছে ফাটল। এই ওভারপাসের ওপর দিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন চলাচল করছে ৫০ হাজারের বেশি যানবাহন। টাইগারপাস ট্রাফিক পুলিশ বক্স সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ দিনে অন্তত ৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে দেওয়ানহাট ওভারপাসে।

জানা যায়, আধা কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের ওভারপাসটির মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ শুরু হয় ষাটের দশকে। পরে আশির দশকে ওভারপাসটি সংস্কারের পর এর মেয়াদ ধরা হয় ২০ বছর। সেই হিসেব অনুযায়ী ২০০০ সালেই মেয়াদোত্তীর্ণের তালিকায় চলে গেছে দেওয়ানহাটের এ ওভারপাসটি।

৮ ও ৯ নভেম্বর সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ওভারপাসের টাইগারপাস মোড় থেকে দেওয়ানহাট সড়কের প্রায় স্থানে ভাঙাচোরা আর খানাখন্দে ভরা। সড়কের কিছু কিছু জায়গায় পড়ে আছে বড় পিচের টুকরো। এছাড়া সড়কজুড়ে পাথর আর ইটের টুকরো ছড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়। ওভারপাসে সৃষ্ট গর্তে গাড়ি আটকে যেতেও দেখা যায়।

ওভারপাসের নিচের অংশের অবস্থা আরও বেহাল। বেশ কয়েকটি পিলারের পলেস্তারা উঠে গিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে লোহার রড। মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে এসব লোহার রড। একইভাবে গার্ডার ও ক্রসগার্ডারে দেখা গেছে ছোট-বড় ফাটল।

অভিযোগ উঠেছে, তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সেবা সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সঠিক তত্ত্বাবধান না থাকায় বেহাল দশা হয়েছে ওভারপাসটির। কখনো আস্ত ইট, আবার কখনো ইটের টুকরো ফেলে জোড়াতালি দিয়ে দায়সারা সংস্কার করছে চসিক। যার কারণে সংস্কারের পরপরই আগের অবস্থায় চলে যাচ্ছে ওভারপাসটি।

অনেকটা একই অভিযোগ নগর পরিকল্পনাবিদদের। তারা বলছেন, এমনিতেই ওভারপাসটি মেয়াদোত্তীর্ণ, তার উপর নিয়মিত তদারকি না থাকায় বেহাল অবস্থা হয়েছে এই ওভারপাসটির। মাঝেমধ্যে সংস্কার প্রচেষ্টা করলেও তা অপরিকল্পিত হওয়ায় এর কোনো সুফল পাচ্ছেন না ব্যবহারকারীরা। প্রতিনিয়ত যানবাহন চলাচল করা ওভারপাসটিতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন তারা।

পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের ওভারপাসের সংস্কার করতে হলে সড়কের কার্পেটিং সম্পূর্ণ প্রলেপ তুলে তার উপর নতুন করে বিটুমিন-পাথরের ঢালাই দিতে হবে। এর একটা কারণও আছে। একটা ওভারপাস কতটা চাপ নিতে পারবে, কি পরিমাণ ওজনের ভার নিতে পারবে তার একটা নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান রয়েছে। একের এর এক পিচের প্রলেপ দিতে থাকলে তা সহনসীমার বাইরে চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘ওভারপাসটির তদারকি কিংবা সংস্কার নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থার। নিয়ম না মেনেই সংস্কারের নামে যত্রতত্র ঢালাই দিয়ে দায় সারছে তারা। অপরিকল্পিতভাবে সংস্কারের কারণে ওভারপাসটির ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেড়ে গিয়েছে। ফলে মেয়াদ চলে যাওয়ার পরও ওভারপাসটি টিকে থাকলেও চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।’

এদিকে চসিকের প্রকৌশল বিভাগ জানায়, জাইকার মূল প্রজেক্টে ৭টি সড়কের সংস্কারের সিদ্ধান্ত আসে। সেসময় ওভারপাসটি এই সংস্কার কাজের তালিকাভুক্ত ছিল না। তালিকাভুক্ত না থাকা সত্ত্বেও নগরবাসীর কথা চিন্তা করে সেই প্রকল্পের আওতায় পরবর্তীতে এই ওভারপাসের সংস্কারের বিষয়টি আলাদাভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

চসিকের দাবি, ওভারপাসটি রেলওয়ের হওয়ার পরও তারা এর কোন কাজ করছে না। নিয়ম অনুযায়ী রেলওয়ের মেরামত ও সংস্কার কাজ করার কথা। কিন্তু রেলওয়ের উদাসীনতার কারণেই চসিক-কে এর তদারকির ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। জনগণের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করেই এই সংস্কার কাজ করছে সংস্থাটি।

এ প্রসঙ্গে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ওভারপাসটির সংস্কারের ওয়ার্ক অর্ডার করা আছে। এখনও কাজটি শুরু করা হয়েছে কিনা আমি জানি না। যেহেতু ওয়ার্ক অর্ডার করা আছে এই ওভারপাসে কার্পেটিং করে দেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে ওভারপাস সংস্কার প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ও চসিকের প্রকৌশল বিভাগের ডিভিশন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী বিপ্লব দাশ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ওভারপাসের সংস্কারের কাজ আমরা হাতে নিয়েছি। ওখানে কিছু লুজ কার্পেটিং আছে, সেগুলো আমরা তুলে ফেলছি। এরপর সেসব স্থানে কার্পেটিং করা হবে। যানচলাচল বিঘ্নিত না হয় সেজন্য আমরা গর্তগুলো আপাতত ভরাট করে দিচ্ছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংস্কারের কাজটি আরও আগেই শুরু করা যেত। কিন্তু কার্পেটিং তোলার জন্য যে স্কেভেটরগুলো আমরা এনেছিলাম সেগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা কাজটি ঠিকমতো করতে পারিনি। অন্য একটি স্কেভেটর আমরা আনার পরিকল্পনা করেছি। এছাড়া বিটুমিনেরও সংকট রয়েছে। আমাদের বিটুমিন দেওয়া হচ্ছে না। তারপরও আমরা অন্য কোনোভাবে বিটুমিন ম্যানেজ করে কার্পেটিং করে দিবো।’