শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

আমেরিকার পথে পথে

| প্রকাশিতঃ ২৯ মে ২০১৬ | ৪:২০ অপরাহ্ন

:: আজাদ তালুকদার ::

azad-1১.

নিউইয়র্ক সিটিতে তিন ডাব্লিউকে নাকি সহজে বিশ্বাস করা যায় না ‘ওয়েদার’, ‘ওয়ার্ক’, ‘ওমেন’। এরা ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টায়। ‘ওয়েদার’ এই ভালো, এই খারাপ। ‘ওয়ার্ক’ এই আছে, এই নাই। আর ‘ওমেন’, সে তো ‘এমিবা’ প্রাণী! মুহূর্ত্বেই তারা রূপ পাল্টাতে পারেন। এই ধারণা আমার নয়, যারা নিউইয়র্কে বাস করেন তাদের। পরের দুটি বিষয় নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। ক্ষণিকের অতিথি আমি এই শহরে। ‘ওয়েদার’টা আজ বিট্রে না করলেই চলে। সেই আশায় বুধবার সকালে নিউইয়র্ক সিটি দেখতে বের হওয়া। সঙ্গী কক্সবাজারের উখিয়ার সন্তান শিপন বড়ুয়া আবু। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই নিউইয়র্কে ভালো অবস্থান টগবগে এই তরুণের। তিনি বলেন, অনেকদূর যেতে হবে তাকে। তার যে সাধনা, সংগ্রাম- যাবেনই তিনি। সেই যাই হোক, তার দেখানো পথে হাঁটছি নিউইয়র্ক শহরে। মেট্রোতে চড়ে, পায়ে হেঁটে নিমিশে আমাদের অবস্থান দাঁড়ালো টাইম স্কয়ার। ২৪ ঘণ্টা জেগে থাকা নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে একদল বিবস্ত্র নারী তাদের শরীরে নানা আঁকিবুকি নিয়ে নানা রঙে, ঢঙে পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যস্ত থাকে। লোকজনের সঙ্গে ছবি তোলার বিনিময়ে তারা বকশিস নেয়। এ নিয়ে নানা মহলের আপত্তির মুখে কিছুদিন আগে রীতিমতো ক্ষেপে গিয়েছিলেন নিউইয়র্কের মেয়র ডি ব্লাজিও। তাদের তৎপরতা বন্ধে উপায় খুঁজতে গিয়েও ব্যর্থ হন তিনি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে নাগরিকদের মত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

সেই যাই হোক, নিউইয়র্কের ভবনগুলো যতটা না উচ্চতার জন্য তার চেয়ে বেশি নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আকর্ষণীয়। এই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু আর বিস্ময়ের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের ঠিকানা হলো সারা বিশ্বের অগ্রগতি নিয়ে ভাবে যে প্রতিষ্ঠান-জাতিসংঘ সদর দপ্তর। অনেকের জন্য জটিল হলেও খুব লাকিলি আমরা পেয়ে গেলাম সেখানে প্রবেশের টিকেট। বিভিন্ন ইস্যুতে পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ৪৫ টি রাষ্ট্র নিয়ে ১৯৫১ সালের ৯ জানুয়ারি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইস্ট নদীর তীরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের প্রায় ১৬ একর আয়তনের এই জায়গাটি ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে দেন জন ডি রকফেলার জুনিয়র। সদর দপ্তরের মূল ভবনের নক্সা করেন লে করবুসিয়ে, অস্কার নিয়েমেয়ারসহ কয়েকজন খ্যাতিমান স্থপতি। বর্তমানে দ্বিতীয়দফায় জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দক্ষিণ এশিয়ার বান কি মুন। এই যাবত দায়িত্ব পালনকারী ৮ মহাসচিবের ছবি রাখা হয়েছে জাতিসংঘের প্রবেশপথে।

বিভিন্ন উইংসের কর্মকা-ের প্রচার প্রদর্শনী, মালালা ইউসুফজাইয়ের উক্তির ব্র্যান্ডিং ইত্যকার বিষয়গুলো বেশ দৃষ্টিনন্দন, প্রণোদনাদায়ক। এসবের ছবি তোলে ভিজিটরস বইয়ে ছোট্ট মতামত লিখে তাতে নিজের নাম ও বাংলাদেশ জুড়ে দেয়ার চমৎকার অনুভূতি সঙ্গী করে ফিরতি পথেই ঢুঁ মারি সেন্ট্রাল পার্ক সাউথে। বিশাল এলাকা নিয়ে অবস্থিত এই পার্কে আধুনিক বিনোদন দুনিয়ার সব উপাদানই হাজির। পাশের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এখানে এসে সময় কাটাতেন। প্রেসিডেন্ট হবার পরও একবার এই পার্কে স্মৃতি হাতড়াতে এসেছিলেন ওবামা। ওবামার স্মৃতিঘেরা পার্ক ধরে এবার আমরা হাঁটতে থাকি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী পত্রিকা নিউইয়র্কস টাইম ভবনের দিকে। এরপর একে একে দেখার সুযোগ হয় সিএনএন ভবন, নিউজ কর্পোরেশন, নিউইয়র্ক স্পোর্টস কর্পোরেশন, বিশ্ববিখ্যাত অ্যাপল কোম্পানির সদর দপ্তরসহ দৃষ্টিনন্দন নিউইয়র্ক। যখন ফিরে আসছিলাম তখনো ‘ওয়েদার’ ছিলো সকালের মতো পরিষ্কার। না আজ সে বিট্রে করেনি। যেহেতু সে বিট্রে করেনি আমার মনে হলো ‘ওয়ার্ক’ আর ‘ওমেন’ও বিট্রে করতে পারে না। বিশ্বাস করতে চাই, বিশ্বের সর্বাধিক মানবাধিকারের এই শহরে বিশ্বমানবের অলংকারখ্যাত ওমেনরা আর রূপ পাল্টাবে না!

২.

টুইনটাওয়ারে আত্মঘাতি বিমান হামলার পর বলা হয়েছিলো এখানে মানুষ থাকবে না। থাকবে না প্রাণচাঞ্চল্য। কিন্তু ক্ষত সরিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যাবার জীবন্ত নজির হিসেবে দেখা হচ্ছে লোয়ার ম্যানহাটনকে। মার্কিনীরা কীভাবে ভয়কে জয় করতে পারে এটি তার বড় প্রমাণ। কাল সেই টুইনটাওয়ার এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো বেশ জমজমাট অবস্থা। ধ্বংসপ্রাপ্ত টুইন টাওয়ারের স্থলে গড়ে তোলা হয়েছে ফ্রিডম টাওয়ার। হামলায় সাড়ে তিন হাজার নিহতের স্মরণে সমাধি ও মিউজিয়াম দেখতে বৃষ্টির মাঝেও পর্যটকে ঠাসা। বছরে অন্তত ১০ লাখ পর্যটক আসছে টুইনটাওয়ারের এই রেনেসাঁ দেখতে।

বিস্ময়ভরা এই পুনর্জাগরণ দেখতে দেখতে আমরা হেঁটে চলেছি হার্ডসন নদীর পাড় ধরে। সঙ্গে আছেন শিপন আবু, তার ভাগ্নে টিপু। সমস্ত কাজ ফেলে দুদিন ধরে আমার ফুলটাইম সঙ্গী আবু। উইক্যানড্ ছাড়া আমেরিকায় এমন আটার মতো সঙ্গ কল্পনাও করা যায় না। সে দিক দিয়ে এই যুবক ব্যতিক্রম। সত্যি আমার ঋণ জমা হয়েছে তার দৃষ্টিভঙ্গির কাছে। সেই আবু কেবল আমার আগ্রহ মেটানোর জন্যই জীবনে যা হাঁটেনি তা হেঁটে, বাদলমুখর দুপুরে আমাকে নিয়ে গেলেন হার্ডসন নদীর কাছে। নিউইয়র্ক শহরের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা ‘স্ট্যাচু অফ লিবাটির্’কে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর স্থাপত্য হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয় তেমনি সেটি হয়ে উঠেছে ‘পর্যটকতীর্থ’। জানা গেলো, মার্কিনীদের সঙ্গে ফরাসীদের মৈত্রীর স্বীকৃতি দিতে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া উপহার এটি। এই স্থাপত্যটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয় ১৮৮৬ সালে। এই স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে আছে হার্ডসন নদীর মুখে, যা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনকারী এবং অন্য দেশ থেকে ফিরে আসা আমেরিকানসহ সকল পর্যটককে স্বাগত জানায়। এটি দেখার জন্য ফেরিতে চড়তে হয়।

কিন্তু বৈরী আবহাওয়ায় আমরা সেই ঝুঁকি নিলাম না। এর পাশেই নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে নৌ কাস্টমসের সেই পুরান কীর্তি। এক সময় নদীপথের একচেটিয়া ব্যবহার হতো এখানে। বাণিজ্য, অভিবাসন, বৈশ্বিক যোগাযোগ সবই হতো নদীপথে। এই স্থাপনাটি কাস্টমস কার্যক্রম হিসেবে ব্যবহার হতো। সেটিও দেখার বিষয়। এই হার্ডসন নদী বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির মাঝখানে। অবশ্য মার্কিন সরকার সেই বিভাজন মিটিয়ে দিয়েছে নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করে। এই টানেল দিয়েই ৩০ মিনিটে যাওয়া যায় নিউজার্সিতে। যাওয়া যায় আধুনিক ফেরি কিংবা বোটের সাহায্যে। যেতে না পারলেও বৃষ্টিস্নাত, মেঘময় ওপারের নিউজার্সি আমাকে যেন ডাকছিল হাতছানি দিয়ে। ট্যুরের শেষ মুহূর্তে¡ তার ডাকে সাড়া দেব সেই অঙ্গীকারে ফিরে এলাম সেদিন। তা না হলে মায়াময় নিউজার্সি যেন ছাড়েই না আমাকে!

Screenshot_21৩.

নিউইয়র্ক ছেড়ে এবার পা বাড়াই বোস্টনের দিকে। বাহন পেটার পেন বাস। দুদিন আগেই সে টিকেট কেটেছিলেন আমার নিউইয়র্ক-এর ছায়াসঙ্গী আবু। শনিবার সকাল সকাল মেনহাটন টার্মিনালে আমাকে পৌঁছে দেন সেই শিপন আবুই। বিমানের মতো ফর্মালিটিস সেরে সাড়ে ৮ টায় ছাড়ে বাস। ছবির মতো সুন্দর পুরোপথ। প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টায় চোখের ‘সুন্দর’ আর মনের ‘আনন্দ’ এই দুইয়ের সখ্যতায় বোস্টন সাউথ স্টেশনে কখন যে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারিনি। কোনো উত্তেজনা ছাড়াই দুপুরে যখন বোস্টন স্টেশনে নামলাম তখন হাত-পা পুরোপুরি জমে গেছে ঠা-ায়।

গাড়ি থেকে নেমেই সেই স্মিত হাসির মুখখানি, যিনি আজও চট্টগ্রামে ফটো সাংবাদিকতার ‘আইকন’ হয়ে আছেন সেই তাপস বড়ুয়া। স্টেশনে নিজের গাড়ি নিয়ে দাদা অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। স্টেশন থেকে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্বে তাপসদার বাসা। তনুশ্রী ভাবি, দুই বাচ্ছা নিয়ে থাকেন তিনি। ঢুকেই এক ঘণ্টার মধ্যে চা-নাস্তা, ভাত সবই খেতে হলো চটজলদি। কারণ বিকেলটা আমাদের হাতছাড়া করা যাবে না। পড়ন্ত বিকেলে চার্লস নদীর পরিবেশটায় অন্য আমেজ, অন্য এক মাদকতা।

গ্রেটার বোস্টনের বুক চিড়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী। নদীর উপর ব্রিজ। ১২৯ কি.মি. দীর্ঘ চার্লস নদীর এই পাড়ে বোস্টন, ওপাড়ে ক্যামব্রিজ। সেই ক্যামব্রিজে সমগ্র বিশ্বের উন্নত শিক্ষার মহান সলতেটি জ্বালিয়ে রাখা বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাচাসুসেটস ইনস্টিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাকা ওবামা, বিল গেটস, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ, বেনজির ভুট্টোসহ সারা বিশ্বে শিক্ষায়, গবেষণায়, রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমনসব মানুষ পড়েছেন হার্ভার্ডে। রেংকিংয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় সারা বিশ্বে এখনো দ্বিতীয় অবস্থানে। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ দিয়ে চলে গেছে বিশ্বের ২য় বৃহত্তম সাগর আটলান্টিক। তার কোলেই আমেরিকার ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম। আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় এই প্রেসিডেন্টের জন্মশহর বোস্টন। অসম্ভব পড়ুয়া এই প্রেসিডেন্ট কবি ও কবিতা ভালোবাসতেন। তাই তার নামে জন্মশহরের সাগরপাড়ে এই মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে। সেই স্বপ্নময়, কাব্যিক সৃষ্টির মাঝে চট্টগ্রামের এক সময়কার স্বাপ্নিক, সেলিব্রেটি ফটো সাংবাদিক তাপস বড়ুয়ার হাতে ছবি তুলে আমার বোস্টন সফরের প্রথম দিনটা কাটলো। অতপর রাতে তাপসদার পরিবারের সাথে বোস্টন প্রবাসী ব্যবসায়ী করিম সাহেবের বাসায় জম্পেস খাবার আর চুটিয়ে আড্ডায় আরেকবার মনে হলো আমি প্রবাসে নই, যেন নানাবাড়ি।

৪.

বোস্টনের রাস্তায়…

শনি-রোববারের হলিডে দারুণ উপভোগ করেন মার্কিনীরা। এই দুটা দিনের জন্য মুখিয়ে থাকেন এখানকার বাংলাদেশিরাও। কেউ ঘুরতে বেরিয়ে যান, কেউবা দাওয়াত, আড্ডাবাজিতে ব্যস্ত সময় কাটান আবার কেউ সময় কাটান গানে গানে।

তাপসদার বাসায় রোববারের সকালটা শুরু হয়েছিল মূলত গানে গানে। শুরুটা করে দিয়েছিলেন তাপসদাই। আর সেটাকে সত্যিকারের বিনোদনে টেনে নিয়ে যান তনুশ্রী ভাবি, মানে তাপসদার সহধর্মিণী। নিয়ে যাবেনইতো। ভাবি সুরের মানুষ, সুন্দরের মানুষ। একসময় গান, নাচ, টিভি অ্যাঙ্করিং, সুন্দরী প্রতিযোগিতা, মডেলিংয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর পর এয়ার হোস্টেস হিসেবে কুয়েত এয়ারওয়েজে চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন। আর সেই মানুষটি যখন সুরের গন্ধ পান, তখন সেই সুরকে ছেড়ে না দিয়ে টেনে নিয়ে যাবেন এটাই স্বাভাবিক।

ভাবি গান করলেন। তাপসদা তো করলেনই, আমাকেও করালেন। অশিল্পীকে শিল্পী বানানোর সব চেষ্টাই করলেন তনুশ্রী ভাবি। চমৎকার একটা সকাল কাটিয়ে তাপসদার মাজদা সিক্স নাইনে চড়ে বেরিয়ে গেলাম। ড্রাইভিং সিটে যথারীতি তাপসদা। আটলান্টিক সাগরের কোলে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামে তাপসদার হাতে ফটোসেশন শেষে হোলসেল মার্কেট কসকোতে এলাম আমরা। এই মার্কেট থেকে খুচরা জিনিসও পাইকারি দরে কেনা যায়। তবে এজন্য ৫৫ ডলার দিয়ে একটা মেম্বারশিপ নিতে হয় পুরো বছরের জন্য। সেই মার্কেট ঘুরে আমরা গেলাম বোস্টনের সাউথেন্ড এলাকায়।

এই সাউথেন্ড সমকামি দম্পতিদের আবাস হিসেবে খ্যাত। বলে রাখি, এই বোস্টনেই আজ থেকে ১২ বছর আগে আমেরিকায় প্রথম সমকামি বিয়ের অনুমতি দেয় এখানকার আদালত। আমেরিকায় সমকামি বিয়ে হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু এক অঙ্গরাজ্যের মানুষ অন্য অঙ্গরাজ্যের মানুষকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে রেসট্রিকশন ছিল। গত বছরের ২৬ জুন এই বোস্টনের সুপ্রিম কোর্ট আমেরিকার সবখানে সমকামি বিয়ের চূড়ান্ত বৈধতা দান করেন। সেই থেকে সমকামি বিয়ের হিড়িক পরে বোস্টনে। যারাই সমকামি বিয়েতে জড়াচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই থাকছেন সাউথেন্ড এলাকায়।

নিউইয়র্কের রাস্তায় স্নেহাস্পদ শিপন আবুর হাত ধরে হাঁটার সময় শিপনই আমাকে বললেন, এভাবে হাত ধরাধরি করে হাঁটলে মানুষ সমকামী ভাববে। মূলত তখন থেকেই সমকামি নিয়ে আমার কৌতূহল। আর সে কৌতূহলে চূড়ান্ত পানি ঢাললেন তাপসদা। তার বদৌলতে জানা গেলো, সমকামি দম্পতি দুরকমের। ‘গে কাপল’ আর ‘লেসবিয়ান কাপল’। ‘গে কাপল’ হচ্ছে ছেলে ছেলে বিয়ে। আর লেসবিয়ান কাপল হচ্ছে মেয়ে মেয়ে বিয়ে। এদের মধ্যে চালচলনে একজন পুরুষ আর অন্যজন মেয়ের মতো থাকতে এবং চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সমকামি দম্পতিদের কেউ কেউ সন্তান দত্তক নিয়ে থাকেন। দত্তক সন্তানেরা সমকামি দম্পতির সমস্ত সহায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়। তাপসদা জানালেন, সমকামি দম্পতিরা অনেক হৃদয়বান হয়ে থাকেন। এমন এক দম্পতি তাপসদার প্রতিবেশি ছিলেন কিছুদিন।

Screenshot_22৫.

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজমের ১৩ ব্যাচের স্টুডেন্ট বেলাল রেডিও টুডের চট্টগ্রাম অফিসে যখন কাজ করতেন তখনই তার সাথে আমার পরিচয়। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই তরুণ কখন আমেরিকার বোস্টনে চলে এলেন আমার জানা ছিল না। নিউইয়র্ক আসার পর আমার ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে কমেন্ট অপশনে বেলাল জানালেন তিনি বোস্টনে আছেন সস্ত্রীক, আমি যেন একবার ঘুরে আসি। তাপসদার সঙ্গে এর মধ্যেই বোস্টন আসা নিয়ে আমার কথা হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হলো তাপসদার বাসায় দুদিন, বেলালের বাসায় থাকবো দুদিন। তাপসদার বাসার দুদিন শেষ হতেই সোমবার বেলাল এসে হাজির। আমাকে তার বাসায় যেতে হবে। একই সময়ে তাপসদার বাসায় আমাকে দেখতে এসেছেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের ছোটভাই তাসাদ্দুক। নাছির ভাইদের পরিবারের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট, বিনয়ী চশমা পড়ুয়া ছেলেটি কখন থেকে বোস্টনে তাও আমার জানার বাইরে। শনিবার বোস্টন আসার পথে হাছান ভাইয়ের কাছে (ড. হাছান মাহমুদ) ফোনে জানলাম তাসাদ্দুক ভাই এখানে।

তাপসদার বাসায় ছোটখাট একটা আড্ডাই হয়ে গেল তাসাদ্দুক ভাইসহ। তারপর বেলালের ড্রাইভে সোজা তার বাসা। আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য সোমবার ছুটি নিয়েছেন বেলাল। স্বামী-স্ত্রী দুজন থাকেন চার রুমের বিশাল এক বাসায়। আমার জন্য বরাদ্দ হলো সেই চার রুমের একরুম। সেই রুমে কিছু সময় বিশ্রামের পর ডাইনিং টেবিলে এসে দেখি টেবিলভর্তি খাবার। আমেরিকান স্যালমন ফিশ, পাম্পিয়া ফিশ, গরুর মাংস, মুরগি, বাংলাদেশি কোয়েলের মাংস, সবজি, ঢেড়শ কিছুই বাদ রাখেননি বেলালের স্ত্রী সাথী। একটু ঝোল ঝোল করে মজাদার ঢেড়শ রান্না দেখে মা’র কথা মনে পড়ে গেলো। বেঁচে থাকতে মা ঢেড়শের এমন রান্না বেশ পছন্দ করতেন।

উদরপূর্তির পর বেলালের গাড়ি চেপে আমাদের গন্তব্য স্থির হলো সোজা আটলান্টিক সাগরের মাঝখানে ডিয়ার আইল্যান্ডে। সাগরের মাঝখানে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দ্বীপ এটি। এখানে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্রকল্প। এখান থেকে বোস্টনের প্রায় ৭০ লাখ মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অন্য অঙ্গরাজ্যেও পানির চাহিদা মেটাচ্ছে বর্জ্য থেকে উৎপাদিত এই পানিপ্রকল্প। সাগরের মাঝখানে উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা পথ আর সাগরের ঢেউয়ের শান্ত-অশান্ত ধ্বনিতে দক্ষিণ-পশ্চিমের বোস্টন শহর অন্যরকম এক মায়াবি আবেদন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এখান থেকে বোস্টনের ‘সুন্দর’ পরখ করা যায় অনায়াসেই। সেই ‘সুন্দর’ যখন দেখছিলাম, তখনই ভয়ংকর এক কুকুর এসে কামড় বসিয়ে দেয় আমার পরণের কাপড়ে। এই বুঝি বিশাদে ছেয়ে যাবে সবকিছু! ভাবতেই মনিব এসে হাজির। ভাগ্যিস মনিবের কথা শুনেছে সে। তা না হলে স্বপ্নের আমেরিকা ট্যুরটা হয়তো অন্যভাবে রচিত হতো আজ। অ্যাডভাঞ্চারাস ও ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা সঙ্গী করে এবার গেলাম হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। আগের দুদিন তাপসদার সঙ্গে গিয়েও গাড়ি পার্কিং না পেয়ে চলে আসতে হলো। আজ সেই অভিজ্ঞতা মনে রেখেছিলাম। তাই এসেম্বলি এলাকায় গাড়ি পার্ক করে মেট্রো রেলকেই ভরসা করি আমরা।

সেই ভরসাতে এবার কাজ হলো। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছবি তুলি ঘুরে ঘুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জন হার্ভার্ডের স্ট্যাচুর পায়ের নিচের অংশের কালার অনেকটা সরে গেছে। জানা গেলো, ভাগ্যবদলের আশায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক হার্ভার্ডের পা স্পর্শ করতে গিয়ে এমন হাল করেছে। ফেরার পথে হার্ভার্ড স্কয়ারে সেই কফি হাউজে কফি খেলাম। ১৬৩৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটা হার্ভার্ড শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থল, মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ের নোবেল লরিয়েট, বিজ্ঞানী, গবেষক, বিশ্বনেতারা তাদের আত্মজীবনীতে নানাভাবে এই কফি হাউজের আড্ডার বিষয়গুলো তুলে এনেছেন।

Screenshot_23৬.

বোস্টনের চূড়ায় চট্টগ্রামের জয়গান!

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রায় একবছর কারাভোগের পর জেল থেকে বেরিয়ে শেখ হাসিনা সোজা চলে এসেছিলেন আমেরিকার বোস্টনে ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়ের কাছে। জয় তখন হার্ভার্ডে পড়ছেন। এই সময় শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সিপাহশালার যিনি, তার নাম ড. হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রামের সন্তান। পাশেই একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে রেখেছিলেন হাছান মাহমুদকে। সে সময় প্রথম ১৫ দিন কাউকেই সাক্ষাৎ দেননি মানসিকভাবে ক্ষুব্ধ, বিধ্বস্ত শেখ হাসিনা। আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশিদের কী ধর্ণা হাছান মাহমুদের কাছে! ঢাকা থেকে বাঘা বাঘা নেতাদের ফোন আসত নেত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলা ও কুশলাদি জানার জন্য। কিন্তু হাছান মাহমুদ কাউকেই কথা বলার সুযোগ দিতেন না! নিউইয়র্ক, বোস্টন প্রবাসীরা দেখেছেন এই সময় চাটগাঁর সন্তান হাছান মাহমুদের প্রতি নেত্রীর আস্থা, উচ্চকিত অবস্থান।

এ প্রসঙ্গে বোস্টন প্রবাসী সাংবাদিক তাপস বড়ুয়া বললেন, হাছান ভাইয়ের এমন ভূমিকায় চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে আমরাও গৌরব অনুভব করেছিলাম তখন। তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, সাহারা খাতুনসহ বাঘা বাঘা নেতাদের ফিরিয়ে দিতে দেখেছি তাকে। নেত্রী তখন সিনিয়র অনেক রাজনীতিবিদের আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলেন।

বলা বাহুল্য, হাছান ভাইকে দিয়ে শুরু হওয়া চট্টগ্রামের জয়গান এখনো বাজছে বোস্টনে। আওয়ামী লীগের দুই কমিটির বর্তমান সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি চট্টগ্রাম। বড় বড় প্রায় সব ব্যবসায়ীর বাড়িও চট্টগ্রামে, যাদের প্রায় সবারই বাড়ি-গাড়ি, একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বোস্টনে। তনুশ্রী বড়ুয়া চট্টগ্রামের পাহাড়তলী মহামুনির মেয়ে। এখানকার বিদেশি সন্তানদের নাচ শিখিয়ে বাংলাদেশি সংস্কৃতির পতাকা উড়াচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী উচ্চশিক্ষিত এই নারী শেখ হাসিনারও নজর কেড়েছিলেন বোস্টনে থাকাকালে। তার স্বামী চট্টগ্রামের খ্যাতিমান ফটো সাংবাদিক তাপস বড়ুয়া বোস্টনে সুপরিচিত। ব্যাংকিং পেশা, ব্যবসা ছাড়াও এখানকার বিভিন্ন ডিগনিটিফুল সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছবি তুলতে ডাক পড়ে তাপস বড়ুয়ার। শেখ হাসিনাও ব্যক্তিগতভাবে চিনেন তাপস বড়ুয়াকে। সজিব ওয়াজেদ জয়ের একবার দুঘণ্টার জন্য গাড়ি দরকার হয়েছিলো। আর কারো নয়, লিফট নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সন্তান তাপসদার কাছ থেকে। বোস্টনে প্রচলিত আছে, শেখ হাসিনাকে বোস্টন থেকে ওয়াশিংটন ডিসি পর্যন্ত গাড়িতে লিফট দিয়ে নিউইয়র্ক প্রবাসী আব্দুস সোবহান গোলাপ এখন শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী, আর বাসায় একবেলা ভাত খাওয়ানোর চান্স নিয়ে মোমেন সাহেব জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। সেই তুলনায় তাপস বড়ুয়া অবৈষয়িক, অন্তর্মুখী স্বভাবের। সেই রকম পদ-পদবিতে না থাকলেও চিন্তা ও মননে অনেক উচ্চতায় আছেন চট্টগ্রামের সন্তানেরা।

গত ক’দিন ধরে সেই উচ্চতার কথা গায়ে মাখতে মাখতে মঙ্গলবার বোস্টনের সমতল কিংবা নিচুতে আর নামতেই ইচ্ছা হয়নি। দুপুরে দারুল কাবাবে চারজনে (তাপসদা, তাসাদ্দুক ভাই, বেলাল আর আমি) বাংলাদেশি মেন্যুর বুফে লাঞ্চ সেরে আমি আর বেলাল আলাদা হয়ে যাই। এরপর আমরা উঠে যাই বোস্টনের চূড়ায়, প্রোডেন্সিয়াল টাওয়ার বা স্কাই ওয়াকে। ৭৫৫ ফুট উচ্চতা ও ৫২ তলার এই টাওয়ারটি বোস্টনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাওয়ার। ১৮ ডলারের বিনিময়ে এই টাওয়ারের ৫০ তলা থেকে চার্লস নদী, আটলান্টিক সাগর, পার্ক, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সকল স্থাপনা, অবকাঠামো, হার্ভার্ড-এমআইটি সবকিছুই মুহূর্তে¡ মুঠোবন্দী করা যায়! চূড়া থেকে হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় যে নদী সেই চার্লস নদীতে প্রতি অক্টোবর মাসে বিশ্বের নারী অ্যাথলেটদের মেলা বসে। এই শহরের নানা কিংবদন্তি ও বিখ্যাতজনদের গল্পগাথা শোনা যায় বোস্টনের এই চূড়া থেকে।

চট্টগ্রাম থেকে বোস্টনের উচ্চতা ছুঁয়ে মনে হলো সেই উচ্চতার অংশীদার আমিও। তাই তীব্র এক রোমাঞ্চ, আবেগ আর ভালোলাগার পথ ধরে স্নেহভাজন বেলালের বাসায় পৌঁছে বসতে না বসতে দেখি বাসমতি চালের আগনি বিরিয়ানি হাজির টেবিলে। খেয়েই বুঝতে পারলাম বিরানি রান্নায় অনেক সিদ্ধহস্ত বেলাল। এজন্যই তো বড় কোনো অনুষ্ঠানের বিরিয়ানি রান্নার জন্য এই বোস্টনেও বেলালের ডাক পড়ে। বিরিয়ানির সাথে বৈশাখীয় ইলিশ ফ্রাই খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম এই বলে, শেখ হাসিনা খেতে পারেননি যে ইলিশ, তা বোস্টনে বসে আমরাই খেলাম। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বাজারে ইলিশের আগুন দেখে এবার বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার পণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। (চলবে)